নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী : যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত করোনা ভাইরাস বিস্তারের কারণে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। স্টুডেন্টদের করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য ইতোমধ্যে নিউইয়র্ক, নিউজার্সিসহ বেশ কয়েকটি স্টেটের কিছু কিছু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে বাসা থেকে যাতে স্টুডেন্টরা হোম ওয়ার্ক করতে পারে ও অনলাইনে এ সময়ের লেখাপড়া সম্পন্ন করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ালেখায় যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে সেই জন্য এই বিকল্প ব্যবসা করার জন্য ইতোমধ্যে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ইমেইল বার্তা পাঠানো হয়।
যারা ইউনিভারসিটিতে স্টুডেন্ট ওয়ার্কার হিসাবে কাজ করতো তাদেরকেও কাজে যাওয়ার জন্য নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত তাদেরকে বাসায় থাকার জন্য ও পাবলিক সমাগম হয় তেমন জায়গায় না যাওয়ার জন্য।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মেজর বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অন্য সময়ের চেয়ে বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ারের মূল্য কমার কারণে অনেকেই তাদের মূলধন এর একটি বড় অংশ হারিয়েছেন। এদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্টাফদেও কর্মঘন্টা কম হওয়ায় তাদেও আয় কমে গেছে। ওইসব মানুষেরা হঠাৎ করেই বড় ধরণের সমস্যার মধ্যে পড়েছেন।
এদিকে করোনা ভাইরাসের কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চাইনিজ দোকানগুলোতে ভিড় কমেছে। ভিড় বেড়েছে বাংলাদেশি ও ভারতীয় গ্রোসারিগুলোতে। খাবার সংকট দেখা দিতে পারে কিংবা দাম বাড়তে পারে এই আশঙ্কায় অনেকেই বর্তমান মূল্যে বাজার থেকে চাল, ডাল, তেল, মাছ মাংসসহ বিভিন্ন পণ্য স্টক করছেন।
জ্যামাইকা ও জ্যাকসন হাইটসে বিভিন্ন গ্রোসারি শপে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে কেনার কাটার ভিড় বেড়েছে। আগামী সাত থেকে পনের দিনের জন্য যে পরিমাণ বাজার প্রয়োজন এর চেয়ে মানুষ অনেক বেশি বাজার করছে। বিশেষ করে চাল কিনছেন বেশি। চাল ও ডাল শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এই ব্যাপারে একজন ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে পণ্য সরবরাহ আছে। এখনও এমন পরিস্থিতি হয়নি যে পন্য কিনে স্টক করতে হবে। পর্যন্ত সরবরাহ রয়েছে। কিন্তু মানুষ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পন্য কিনে স্টক করে রাখার কারণে হোল সেলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের কেউ কেউ আগের আনা পণ্যেরই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এই জন্য আমাদেরকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। দোকানে সেল দেওয়া বন্ধ। চলমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে সেল দেওয়া সম্ভব হবে না। তিন বলেন, যার যতটুক প্রয়োজন সেই অনুযায়ী পন্য কিনলে মনে হয় সংকট পড়বে না। অতিরিক্ত পণ্যেও চাহিদা না থাকলে ডিস্ট্রিবিউটরা আমাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না। আমরা বেশি দামে কিনছি বলে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
ট্রাভেল এজেন্সী, হজ এজেন্সী, এয়রলাইসেন্সের ব্যবসাসহ রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, পার্টি হল থেকে শুরু করে সর্বত্র করোনার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন থেকে পার্টি হলগুলোতে ব্যবসার মৌসুম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তেমন বুকি মিলছে না। নিউইয়র্কে জনসাধারণ চলাচল কমিয়ে দিচ্ছেন। নেহাত প্রয়োজন ছাড়া তেমন বাইরে বের হচ্ছেন না। তাই অন্যান্য সময়ের চেয়ে রাস্তায় ভিড় কম।
ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনার ম্যানেজার হাসান বলেন, শীত মৌসুম শেষে এই সময়ে ব্যবসার শুরু হওয়ার কথা। প্রতিদিন পার্টি থাকার কথা। হল বুকিংও পাওয়ার কথা। সাধারণত ১৫ মার্চ থেকে বুকিং ও অনুষ্ঠান শুরু হয়। তবে এবার বুকিং তুলনামূলকভাবে কম।
তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে অনেক মানুষ বাইরে বের হচ্ছে না। আবার অনেকেই পার্টিতে যাচ্ছেন না। এড়িয়ে চলছেন অনুষ্ঠান। বাইরের অন্যান্য গেদারিংয়েও যাচ্ছেন না। যারা চিন্তা করছিলেন এই সময়ে অনুষ্ঠান করবেন, তাদের অনেকেই করোনার কারণে হয়তো অনুষ্ঠান পিছিয়ে দিচ্ছেন। এই কারণে বলা যায় করোনা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে সমস্যা বাড়তে পারে।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছেন। মানুষ এখন বাসা বাড়ি কেনার বিষয়ে রিয়েলটরদের সাথে খুব বেশি প্রয়োজন ও জরুরি না হলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে বাসা দেখতে বা বাড়ি দেখতে যাচ্ছেন না।
এই ব্যাপারে রিয়েলটর মোর্শেদা জামান বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে এখন ব্যবসা খুব ভাল না। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলেও ব্যবসা আরও খারাপ হতে পারে। শুধু এই সেক্টরেই যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে তাই নয় অন্যান্য সেক্টরেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (১০ মার্চ) নিউইয়র্ক সিটিতে করোনা ভাইরাসে পজিটিভ ব্যক্তির সংখ্যা ২৫, নেগেটিভ ২০১, পেন্ডিং রয়েছে ৮৬, সর্বমোট ৩১২ জনের শরীরে এই ভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখার ও এখনও যেখানে প্রবেশ করতে পারেনি, সেখানে যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সকল বিমানবন্দরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এত সতর্কতার মধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী নিউইয়র্কে প্রবেশ করছে। ও অন্যদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ছে। চলতি সপ্তাহে নিউইয়র্কে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।
নিউইয়র্ক স্টেটের অ্যান্ডু কুমো ও সিটির মেয়র বিল ডি ব্লাজিও আপডেট পরিস্থিতি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছেন। ও জরুরী পরিস্থিতি জানাচ্ছেন। সেই সঙ্গে এই ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য যে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ও এই রোগ হলে কি করতে হবে সেই সব বিষয়ে সতর্কতামূলক নির্দেশনাও প্রদান করা হচ্ছে।
জ্যাকসন হাইটসের একটি ট্যাক্স অফিসে গিয়ে দেখা যায় সেখানে কোন কাস্টমার নেই। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট বলেন, ট্যাক্স ফাইল করার জন্য হাতে কেবল একমাস পাঁচদিন সময় আছে। এই সময়ে অনেক মানুষ ট্যাক্স ফাইল করার কথা, কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষ ঘর থেকে তেমন বের হচ্ছেন না। ফলে আমাদের কাস্টমার কম। অথচ আমাকে প্রতিদিন অফিস খোলা রাখতে হচ্ছে। অফিস ও স্টাফ খরচ আছে দিন প্রতি পাঁচ হাজার ডলার। কিন্তু সেই অর্থতো আয় হচ্ছে না। স্টাফরা বসে আছেন। আমাকে বেতন গনতে হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই।
এদিকে জ্যামাইকার একজন চিকিৎসকের অফিসে গিয়ে দেখা যায় সেখানে এক দুইজন রোগি এসেছেন। সেখানকার চিকিৎসকের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডাক্তার বলেন, আসলে এখন অনেকেই ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। প্রয়োজন না হলে চিকিৎসকের কাছেও আসছেন না।
করোনা ভাইরাসের বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি হিসাবে জানা গেছে, আমেরিকাতে এই ভাইরাসের মৃত্যের সংখ্যা ২৭ ছাড়িয়েছে। ভাইরাসে আক্রান্ত মোট পজিটিভ ব্যক্তির সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়েছে। মার্কিন নার্সিং হোমগুলিতে দর্শনার্থীদের উপর কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে বলা হয়েছিল। এখন তা অব্যাহত রয়েছে। বলা হয়েছে, নার্সিং হোমগুলি বেশিরভাগ পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব দর্শনে বাধা দেওয়া উচিত। কেউ আক্রান্ত হলে না যাওয়াই ভাল। নার্সিং হোমস এবং সহায়ক লিভিং সেন্টারগুলিকে সর্বাধিক সামাজিক দর্শন কমাতে অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এবং এমনকি কিছু কর্মচারীকে দূরে রাখতে, নতুন করোনভাইরাসটির প্রসার কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
আমেরিকান হেলথ কেয়ার এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক পার্কিনসন বলেছিলেন, মৃত্যুর হারটি হতাশাজনক। তিনি বলেছিলেন যে সংক্রামিত ৮০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের জন্য চীনে রিপোর্ট করা মৃত্যুর হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সূত্র: ঠিকানা