গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইটে সোমবার ঢাকা থেকে সৌদি আরব যাচ্ছিলেন ৬৮ বাংলাদেশী শ্রমিক। ট্রানজিট ছিল বাহরাইনে। বিপত্তির সূত্রপাত সেখানেই। কারণ চলমান নভেল করোনাভাইরাসের সংকটে বাহরাইনের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে সৌদি আরব। দীর্ঘ সময় বিমানবন্দরে আটকা থাকেন শ্রমিকরা। পরে বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফেরত পাঠানো হয় তাদের।
চলমান করোনা পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিদেশীদের ঢুকতে দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছে। বিদেশীদের নিজ সীমায় প্রবেশই করতে দিচ্ছে না কাতার ও কুয়েত। শ্রমিক ভিসা ইস্যু করা কমিয়ে দিয়েছে বাহরাইন, লেবাননসহ অন্য দেশগুলোও। দেশগুলোর কয়েকটিতে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি যাওয়া শ্রমিকদের প্রবেশে কোনো বাধা আরোপ হয়নি। তবে অন্য দেশে ট্রানজিট নিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের কোনোভাবেই ঢুকতে দিচ্ছে না দেশগুলো। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেলে শ্রমিকদের সরাসরি গমনও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রেমিট্যান্স আয়ের বৃহৎ ক্ষেত্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিকে বিপন্ন করে তুলেছে কভিড-১৯। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বর্তমানে অন্তত ৪০ লাখ বাংলাদেশী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। অভ্যন্তরীণ চলাচল সীমিত করে দেয়ার কারণে ব্যাঘাত ঘটছে তাদের পেশাগত জীবনযাত্রায়ও। অচিরেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে দেশের রেমিট্যান্স আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা খাতসংশ্লিষ্টদের।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরও দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী গিয়েছিলেন সৌদি আরবে, প্রায় ৫৭ শতাংশ। তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানের দেশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যের। দেশ দুটি হলো যথাক্রমে ওমান (১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ) ও কাতার (৭ দশমিক ১৮ শতাংশ)।
এরই মধ্যে সৌদি আরব করোনা আতঙ্কে সব ওমরাহ ও পর্যটন ভিসা বাতিল করেছে। দেশটিতে বাংলাদেশী রয়েছে ২০ লাখের মতো। সৌদি সরকারের কড়াকড়িতে অনেকে দেশটিতে বৈধ হওয়ার জন্য দূতাবাসে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে মঙ্গলবার থেকে বিভিন্ন শহরে কনস্যুলার সেবা বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভিসা, পাসপোর্ট, ইকামা নবায়নসহ নানা ধরনের কার্যক্রম। এতে নির্ধারিত সময়ে নিজ নিজ কাগজপত্র বৈধ করতে না পারা এবং এর ধারাবাহিকতায় আটক হওয়ার আতঙ্ক কাজ করছে প্রবাসীদের মধ্যে।
এছাড়া যারা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ছুটি কাটাতে বাংলাদেশে এসেছেন, তারাও ফিরতে পারছেন না। তবে এক্ষেত্রে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বাংলাদেশী কর্মীরা যারা দেশে এসেছেন, তারা আবার ওইসব দেশে যেতে পারবেন। তাদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হবে।
ঢাকায় গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।
ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির নিশ্চয়তার পরও দেশগুলো থেকে ছুটিতে আসা প্রবাসী শ্রমিকরা এখনো শঙ্কায়। তাদের আশঙ্কা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে একসঙ্গে অনেক শ্রমিক কর্মস্থলে ফিরে যেতে উড়োজাহাজের টিকিটের খোঁজ করবেন। ফলে চাহিদা বেড়ে সে সময় দাম বাড়তে পারে টিকিটের।
সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। ধস নেমেছে দেশগুলোর পর্যটন, ওমরাহ ও এয়ারলাইনস ব্যবসায়। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও। ফলে সামনের দিনগুলোয় কাজ হারানোরও আশঙ্কা রয়েছে প্রবাসীদের মধ্যে। এছাড়া পুঁজি হারানোর ভয় করছেন বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশীরা।
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার কাতার। কাতারের রাজধানী দোহার নাজমা এলাকায় সবজির ব্যবসা করেন মো. ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দোহায় কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ায় তিনি আতঙ্কিত। করোনার কারণে বাজারে প্রয়োজন ছাড়া ক্রেতা আসেন না। বিক্রিও নেমে এসেছে আগের তুলনায় অর্ধেকে। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে শেষ পর্যন্ত এখানে থাকব কিনা বলতে পারছি না।
চরম আতঙ্কে রয়েছেন দেশটির বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মরত বাংলাদেশীরাও। কভিড-১৯-এর কারণে যেকোনো মুহূর্তে কোম্পানি বন্ধ হয়ে কাজ হারানোর শঙ্কা করছেন তারা।
এ বিষয়ে কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর ড. মুস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা যাতে শান্ত থাকেন; সেজন্য কাতারের বিভিন্ন কোম্পানিতে গিয়ে আমরা সচেতনতা তৈরি করছি। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কর্মীদের মার্কেটে বা জনসমাগম এলাকায় না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।
নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে তীব্র আতঙ্কে কুয়েতও। এরই মধ্যে বাংলাদেশসহ সাত দেশের সঙ্গে এক সপ্তাহের জন্য ফ্লাইট বাতিল করেছে কুয়েত সরকার। এসব ফ্লাইটে কুয়েতগামী যেসব যাত্রী ছিলেন, তারা বিপদে পড়েছেন। এছাড়া নয় দেশের নাগরিকদের দেশটিতে ঢুকতে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত নন এমন ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দিয়েছিল দেশটি। যদিও পরবর্তী সময়ে সেটি প্রত্যাহার করা হয়।
কুয়েতে বর্তমানে আড়াই লাখের মতো বাংলাদেশী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ছোট-বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন অন্তত পাঁচ হাজার। দীর্ঘদিন কুয়েত সিটি, হাসাবিয়া, আবদালি, সোলভিয়া ও সুয়েক এলাকায় ব্যবসা করে আসছেন তারা। মূলত সুপারশপ, কসমেটিকস, আতর, কাপড় ও সবজির ব্যবসা করছেন এসব প্রবাসী ব্যবসায়ী। তারা জানান, করোনা আতঙ্কে বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। আগে যেখানে প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতি ও শুক্রবার প্রচুর লোকসমাগম হতো, সেখানে এখন প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাজারে আসেন না। বেচাকেনা নেমে এসেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশে।
একই অবস্থা আরেক শ্রমবাজার ওমানেও। স্থানীয়দের মতো বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরাও বিপদে রয়েছেন সেখানে। বিশেষ করে সেখানকার ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় ধস নেমেছে। এমনই এক ব্যবসায়ী আবু ইউসুফ বণিক বার্তাকে বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে তার ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। বিশেষ করে ওমানে করোনার ভয়ে পর্যটকরা আসছেন না। নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েও যাত্রী টানতে পারছে না ওমান এয়ারলাইনস।
ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম সারোয়ার জানান, করোনার কারণে ওমান সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, তা যথেষ্ট। এর বাইরে আমরাও কাজ করছি। ওমানে বাংলাদেশীদের আতঙ্কে না থেকে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের আরেক শ্রমবাজার লেবানন। করোনার কারণে এ দেশটিরও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। করোনার প্রভাবে আতঙ্কিত না হয়ে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীরা সতর্কতার সঙ্গে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। তবে দেশটিতে নারী শ্রমিক বেশি থাকায় উদ্বেগ বেশি বলে জানান সেখানকার কমিউনিটি নেতারা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আবুধাবিতে অবস্থিত প্রবাসী অধ্যুষিত মোচ্ছাফফা বাজার (বাংলা বাজার) বন্ধ ঘোষণা করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। চার সপ্তাহের জন্য বন্ধ করা হয়েছে ইউএইর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আবুধাবি, দুবাই ও আজমান এলাকায় বড় ধরনের সভা-সেমিনার কিংবা অনুষ্ঠান তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, যারা অফিস-আদালতে যেতে অনিচ্ছুক, তারা বাসায় থেকে অনলাইনের মাধ্যমে অফিস করতে পারবেন।