পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছে যারা চকলেট ভালবাসে না। জীবনে একটিবারের জন্য চকলেটের স্বাদ নেয়নি, এমন মানুষ হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। চকলেটের নাম শুনলেই জিভে জল চলে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে, চকলেটে রয়েছে বিশেষ গুণ। ডার্ক চকলেট প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ক্যান্সারসহ নানাবিধ রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে। এছাড়া কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে আনা, হার্ট সবল রাখা ও ব্রেইনের জন্য ডার্ক চকলেট খুবই উপকারী।
কিন্তু এই সুস্বাদু ডার্ক চকলেটের পেছনে রয়েছে একটি অন্ধকার, তেতো জগত। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে কোকো উৎপাদিত হয় পশ্চিম-আফ্রিকার দেশগুলোতে (IITA-2001)। প্রতিবছর সারাবিশ্বে মোট কোকোর শতকরা ৭০ ভাগই আসে আইভরিকোস্ট ও ঘানা থেকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই কোকো অধিকাংশ আসছে শিশুশ্রম দিয়ে। পৃথিবীতে ১৫২ মিলিয়ন শিশু-শ্রমিক আছে, যেখানে কৃষিতে নিয়োজিত ১০৭.৫ মিলিয়ন। এর ভেতর শুধুমাত্র আফ্রিকাতেই নিযুক্ত আছে ৬১ মিলিয়ন শিশু, যেখানে প্রায় ২.১ মিলিয়ন শিশু এই দুই দেশের কোকো ফার্মের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত আছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, শতকরা ১০ ভাগ ঘানা ও ৪০ ভাগ আইভরিকোস্টের শিশুরা কখনো স্কুলের চৌকাঠ পেরোয়নি। শিশুরা তাদের স্বপ্নে ভরা শৈশবকে আপনার-আমার মুখে সুস্বাদু ডার্ক চকলেট তুলে দিতে বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি চকলেট দানার অন্তরালে লুকায়িত আছে শিশুদের অস্ফুট আর্তনাদ, কান্না, অমানবিক নির্যাতিত জীবন; আছে প্রতিটি জীবনের একেকটি তেতো গল্প।
আইভরিকোস্ট ও ঘানার পার্শ্ববর্তী দেশগুলো, যেমন- বুরকিনা ফাসো, টোগো, নাইজেরিয়া, চিলিসহ পশ্চিম-আফ্রিকার দেশগুলো থেকে প্রতিনিয়ত পাচার হয়ে আসছে হাজার হাজার শিশু। দারিদ্র্যের নিম্নসীমায় থাকা অঞ্চলগুলো থেকে খুব সহজেই শিশুদেরকে পাচার করে বা অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়। অনেক হতদরিদ্র বাবা-মা তাদের সন্তানকে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে দালালদের হাতে তুলে দেয়। পাচারকারী চক্র ছোট পিকআপে কিংবা লরিতে করে খুব সহজেই সীমান্ত অতিক্রম করে পৌঁছে যায় আইভরিকোস্ট ও ঘানার ফার্মগুলোতে, যেখানে অল্প কিছু অর্থের বিনিময়েই শিশুদেরকে ফার্ম মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। এখানে যারা আসে তাদের অনেকেই বাবা-মায়ের কাছে কখনও যেতে পারে না। এখানে নয় থেকে ষোল বছর বয়সী শিশুরা সংখ্যায় বেশি।
ফার্মগুলোতে প্রতিদিন তাদেরকে সকাল থেকে রাত অবধি বিরতিহীনভাবে কাজ করে যেতে হয়। অমানুষিক পরিশ্রম তাদের শারীরিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ পরীক্ষা নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা তাদের পরিশ্রমের বিনিময়ে কিছুই পায় না। বরং অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে তারা জীবন অতিবাহিত করে, ক্ষুধার যন্ত্রণা প্রকটাকার ধারণ করে। আর আহারে জোটে ভুট্টা সেদ্ধ আর কলা, এবং রাতে ঘুমানোর জন্য বদ্ধ চালাঘর।
প্রত্যেকটি বাচ্চাকেই ৬০-৬৫ কেজি ওজনের বস্তা বহন করে বিরামহীনভাবে জঙ্গলের দুর্গম অঞ্চল দিয়ে চলতে হয়। চলার পথে একটুখানি ক্লান্তিও যেন অভিশাপ, কারণ বিশ্রাম নিতে গেলেই নেমে আসে ভয়ানক চাবুকের নৃশংস আঘাত। চর্মরোগ সকল বাচ্চার মাঝেই দেখা যায়। ধারালো ছুরি দিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই শারীরিক আঘাতের শিকার হয়। খুবই বিপদজ্জনক এই চাপাতি গিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই গুরুতর আঘাতের শিকার হয়। সকল বাচ্চার শরীরেই চাপাতির জখমের দাগ পাওয়া যায়।
সকাল থেকে তারা বিরামহীনভাবে কাজ করে যায়; একদল চাপাতি দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে, আরেক দল গাছে চড়ে ধারালো চাপাতি দিয়ে কোকো পাড়ে। এরপর কোকোগুলোকে বস্তায় ভরা হয় এবং সেই ভারি বস্তাটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বহন করে নিয়ে আসতে হয়। কিছু কিছু বস্তা বাচ্চাদের থেকেও বড়। বস্তা নিয়ে তারা দ্রুত না হাঁটলেও তাদেরকে আঘাত করা হয়। এভাবেই একেকটি দিন তারা পার করে। শারীরিক নির্যাতন ও আঘাত যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। এখানে একবার আসলে আর বের হবার কোনো সুযোগ নেই। পালাতে গিয়ে যদি কোকো ফিল্ডের চারদিকে পাহারাদারদের হাতে ধরা পড়ে, তাহলে নেমে আসে আরো ভয়ংকর শাস্তি।
অনেকে দুর্গম অঞ্চল থেকে কোকো সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। অনেক কিশোরীই নিয়মিত ধর্ষিত হয় ফার্ম মালিক, কর্মী ও মজুরদের কাছে। খুব অল্প বয়সেই গর্ভবতী হয়ে পড়ে। আক্রান্ত হয় নানাবিধ দুরারোগ্য যৌনরোগে। কোকো ফিল্ডের দুর্গম অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করে নেয়, বিষাক্ত পোকামাকড়ের আক্রমণের শিকার হয়, চোখ অন্ধ হয়ে যায়। বিষাক্ত কীটনাশক, যেমন- Ridomil (Metalaxyl + cuprous oxide), Cocostar, Nordox super 75(Copper oxide), Unden 20(Propoxur), Thionex(Lindane) বাচ্চাদের দ্বারা স্প্রে করানো হয় কোনোপ্রকার শারীরিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই। ফলে খুব সহজেই কীটনাশকের বিষক্রিয়া দ্বারা বাচ্চারা আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক সময় এরকম দুর্বিষহ প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে না পেরে, রোগাক্রান্ত হয়ে, নির্যাতনের শিকার শিকার হয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। মৃতদেহটা ঠাই পায় কোনো নর্দমা বা খালে, কিংবা চলে যায় কুকুরের পেটে।
এসব অঞ্চলে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ যে গ্রহণ করা হয়নি এমনটা নয়। অনেক বড় বড় কোম্পানির চুক্তি স্বাক্ষর হয় শিশুশ্রম নিয়ে, তবে তা শুধু কাগজ-কলমের স্বাক্ষরের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোকোর দাম কম রাখতেই শিশুশ্রম ব্যবহৃত হচ্ছে, কারণ শিশুদের পরিশ্রমের কোনো মজুরী দেয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই শিশুশ্রম নিয়ে সাংবাদিকেরা কিছু রিপোর্ট করলে তা সকলের সামনে তুলে ধরতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে, অনেকেরই জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। এই কোকো ফার্মের পেছনে সরকারের যে একটি বিশাল দুর্নীতি রয়েছে তা তুলে ধরার ফলে ২০০৪ সালে হত্যা করা হয় আইভরিকোস্টের এক সাংবাদিককে, এবং ২০১০ সালে এই কোকো ফার্মে অবস্থানরত শিশুশ্রম নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য আইভরিকোস্ট সরকার ৩টি সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে দেয়। এ থেকেই বোঝা যায় এই কোকো ফার্মের পেছনে দুর্নীতির অবস্থা।
বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন চকলেট কোম্পানির অধিকাংশ কোকো আসে এসব কোকো ফার্ম থেকে। আশার আলো এটাই যে, ইন্টারন্যাশনাল কোকোয়া ইনিশিয়েটিভ (আইসিআই) শিশুশ্রম বন্ধে কাজ করছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যেই তারা শিশুশ্রম বন্ধ করার এই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন তা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে এটাই দেখার পালা। আদৌ কি এসকল দেশের শিশুরা তাদের শৈশবকে ফিরে পাবে? নাকি এভাবেই দিনের পর দিন অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আপনার-আমার মুখে ডার্ক চকলেট পৌঁছে দেয়ার পেছনে নিজেদের বিলিয়ে দেবে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, এখানের অধিকাংশ বাচ্চাই জানে না আসলে এই চকলেটের স্বাদ কেমন! তাদের চোখে শুধুমাত্র একটি স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন, এই বর্বর জীবন থেকে বেরিয়ে একটি সুন্দর-সাবলীল জীবনের স্বপ্ন। অনেকে হয়তো এই মিথ্যা স্বপ্নটি দেখাও ভুলে শিখে গিয়েছে।