অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুণ্ঠনের ভার বইতে পারছিল না ফারমার্স ব্যাংক। যাত্রার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রায় ধসে পড়েছিল ব্যাংকটি। ধারাবাহিকভাবে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় দুই বছর আগে ফারমার্স ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ, অপসারণ করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। পরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থে টেনে তুলে নতুন নামে চালু করা হয় কার্যক্রম। যদিও ধরাছোঁয়ার অনেকটাই বাইরে থেকে গেছে ব্যাংকটি লুণ্ঠনে যুক্ত পরিচালক, ব্যাংকার ও গ্রাহকরা।
বাংলাদেশের ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথা আবারো আলোচনায় তুলে এনেছে ভারতের ইয়েস ব্যাংক বিপর্যয়ের ঘটনা। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে ব্যাংকটি। পতন ঠেকাতে ৩ লাখ কোটি রুপি সম্পদের বেসরকারি এ ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল সকালে গ্রেফতার হয়েছেন ব্যাংকটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রানা কাপুর। লন্ডনে পালানোর সময় বিকালে মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে রানা কাপুরের কন্যা রোশনি কাপুরকে।
লুণ্ঠনে বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংককে টেনে তুলতে এগিয়ে এসেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের সিদ্ধান্তেই বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এজন্য ঢালতে হয়েছে ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি। বেঁচে থাকতে নাম পরিবর্তন করে ফারমার্স থেকে ব্যাংকটি এখন পদ্মা হয়েছে। যদিও ৭২ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে এখনো হাবুডুবু খাচ্ছে পদ্মা ব্যাংক।
ভারতে বিপর্যস্ত ইয়েস ব্যাংককে টেনে তোলার প্রক্রিয়াও অনেকটা ফারমার্স ব্যাংকের মতোই। বেসরকারি ব্যাংকটিকে ভরাডুবি থেকে উদ্ধার করতে নামানো হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে (এসবিআই)। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) পরিকল্পনার খসড়া অনুযায়ী, ইয়েস ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ মালিকানা কিনে নেবে স্টেট ব্যাংক। সেজন্য তাদের ঢালতে হবে প্রায় ১১ হাজার ৭৬০ কোটি রুপি। ইয়েস ব্যাংককে টেনে তুলতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংক ও ইয়েস ব্যাংকের বিপর্যয় এবং উদ্ধার প্রক্রিয়া প্রায় একই। কিন্তু দুটি বেসরকারি ব্যাংককেই টেনে তোলার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে এ দুটি ক্ষেত্রে ভিন্নতাও অনেক।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরীর মতে, বাংলাদেশে ফারমার্স ব্যাংককে টেনে তোলার দায় যেসব ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা নিজেরাই বিপর্যস্ত। অনিয়ম-দুর্নীতি আর বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে এসব ব্যাংক দিশেহারা পরিস্থিতি পার করছে। অন্যদিকে ভারতের স্টেট ব্যাংক খুবই শক্তিশালী। অন্য বিপর্যস্ত ব্যাংককে টেনে তোলার সামর্থ্য থাকার কারণেই ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংককে দায়িত্ব দিয়েছে। দেশে আরো দু-চারটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিস্থিতি যদি ফারমার্সের পর্যায়ে যায়, তাহলে তার দায়িত্ব কে নেবে, সেটিই দেখার বিষয়।
অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংককে টেনে তুলতে ২০১৭ সালের শেষের দিকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বছরের ২৭ নভেম্বর ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। একই দিন ব্যাংকটির অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীও পদচ্যুত হন। পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। ব্যাংকটির আরেক পরিচালক ড. মোহাম্মদ আতাহার উদ্দিন ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর বৈঠকে ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদকে চেয়ারম্যান ও মারুফ আলমকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। নতুন করে ব্যাংকটির সবকয়টি কমিটি পুনর্গঠন করে ঢেলে সাজানো হয়। পরে মোহাম্মদ মাসুদকে সরিয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে চৌধুরী নাফিজ সারাফাত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর থেকে শুরু হয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অর্থ ঢেলে ব্যাংকটিকে টেনে তোলার প্রক্রিয়া।
সরকারের সিদ্ধান্তে ফারমার্স ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং আইসিবি। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রত্যেকে জোগান দেয় ১৬৫ কোটি টাকা করে। বাকি ৫৫ কোটি টাকা দেয় আইসিবি। সব মিলিয়ে ফারমার্স ব্যাংকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেয়। পরে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে চারটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা যোগ দেন। বিদায়ী বছরের শুরুতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডে রূপান্তর করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে পদ্মা ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৯০ কোটি টাকাই নাম লিখিয়েছে খেলাপির খাতায়। সে হিসেবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৭২ দশমিক ২৯ শতাংশ। পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি হওয়া ঋণের মধ্যে ৩ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকাই মন্দ মানের খেলাপি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এ ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কতদিন পদ্মা ব্যাংকের মালিকানায় থাকবে এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়নি। বিপর্যস্ত ব্যাংকটির সম্পদ ও দায় নিরূপণে একটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হলেও সে কাজও এখনো শেষ হয়নি। এ বিষয়ে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক ও রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ বলেন, পদ্মা ব্যাংকের মালিকানায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কতদিন থাকবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ব্যাংকটির সম্পদ, দায়সহ সব বিষয়ে নিরীক্ষা করার জন্য একটি অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানটি এখনো ফাংশনাল অডিট শেষ করতে পারেনি। অডিট শেষ হলে তবেই পদ্মা ব্যাংকের সম্পদ ও দায়ের হিসাব জানা যাবে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব, কতদিন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পদ্মা ব্যাংকের মালিকানায় থাকবে।
এদিকে প্রথমে আইএল অ্যান্ড এফএস, ডিএইচএফএলের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তার পরে পিএমসি ব্যাংক। এবার ইয়েস ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে তোলপাড় চলছে ভারতজুড়ে। একের পর এক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ার ঘটনায় দেশটির পুরো অর্থনীতিই নড়বড়ে পরিস্থিতিতে পড়েছে।
ঝুঁকির মুখে থাকা কোম্পানিগুলোকেই বড় অংকের ঋণ দিয়ে বিপদে পড়েছে ইয়েস ব্যাংক। ব্যাংকটির পতনে দায়ী এসব কোম্পানির তালিকায় রয়েছে অনিল আম্বানি-সুভাষ চন্দ্রের মতো প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান। তারা দুজনই আবার নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। শুধু অনিল আম্বানি গোষ্ঠীই ইয়েস ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৩১ হাজার কোটি রুপি। ৬ হাজার কোটি রুপি ঋণ নিয়েছে ভোডাফোন। ডিএইচএফএল ৩ হাজার ৭০০ কোটি রুপি ও এসেল গোষ্ঠী ৩ হাজার ৩০০ কোটি রুপি ঋণ নিয়েছে ইয়েস ব্যাংক থেকে। খেলাপি ঋণের বোঝায় ৩ লাখ রুপির বেশি সম্পদের ইয়েস ব্যাংকের নিট ওয়ার্থ নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। বিষয়টির দায়ভার পরিচালকদের কাঁধে তুলে দিয়ে ব্যাংকটির গোটা পরিচালনা পর্ষদকে বরখাস্ত করেছে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)। এরপর ইয়েস ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্টেট ব্যাংককে। সেজন্য তাদের প্রায় ১১ হাজার ৭৬০ কোটি রুপি ঢালতে হচ্ছে।
তবে লুণ্ঠন প্রক্রিয়া একই হলেও ফারমার্স ব্যাংক ও ইয়েস ব্যাংকের উদ্ধার প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ভিন্নতা রয়েছে বলে মনে করেন পিডব্লিউসি বাংলাদেশের ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশীদ। তিনি বলেন, আরবিআই ইয়েস ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য ব্যাংকটির পুরো পর্ষদকে অভিযুক্ত করে বরখাস্ত করেছে। ব্যাংকটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রানা কাপুর ও তার কন্যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রানা কাপুরের সব বাড়ি ও অফিসে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়েছে। ইয়েস ব্যাংকে সংঘটিত সব অনিয়ম ও দুর্নীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুঁজে বের করেছে। তার পরই স্টেট ব্যাংককে মূলধন জোগান দেয়ার জন্য বলেছে। পুরো কর্মযজ্ঞটাই হচ্ছে আরবিআইয়ের নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বাংলাদেশে ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি চিহ্নিত করা এবং ব্যাংকটির উদ্ধার প্রক্রিয়ায় আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা সেভাবে দেখিনি। ফারমার্স ব্যাংকের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো গাইডলাইন নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক বাস্তবায়ন করেছে মাত্র।