এই ম্যাচের আবেদন বদলে গেছে আগের দিনই। যে ম্যাচের আবহে মিশে নেতা মাশরাফি মুর্তজার বিদায়ের সুর, সেখানে বাকি সব পারিপার্শ্বিকতাই তো গৌণ! লিটন দাস ও তামিম ইকবাল যেন নেমেছিলেন প্রিয় অধিনায়ককে বিদায়ী শ্রদ্ধার্ঘ্য দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেই। রেকর্ড বই চুরমার করা রান উৎসবে দুজন রাঙালেন উপলক্ষ। প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করা দিনটি পূর্ণতা পেল অধিনায়কের পঞ্চাশতম জয়ের অনন্য অর্জনে।
অধিনায়ক মাশরাফির গৌরবময় পথচলা শেষ হলো বড় জয় দিয়ে। শেষ ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়েকে ১২৩ রানে হারিয়ে বাংলাদেশ সিরিজ জিতল ৩-০ ব্যবধানে।
সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের ২২ গজে শুক্রবার লিটন ও তামিম ব্যাট হাতে হয়ে উঠেছেন বিধ্বংসী। সেই ঝড়ে এলোমেলো রেকর্ড বইও। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ৪৩ ওভারেই বাংলাদেশের রান ৩২২। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে পাওয়া ৩৪২ রানের লক্ষ্যে ছুটে জিম্বাবুয়ে থেমেছে ২১৮ রানে।
আগের ম্যাচেই গড়া তামিমের ১৫৮ রানের রেকর্ড ভেঙে লিটন করেছেন ১৭৬। ১৪৩ বলের ইনিংসে ছিল ৮ ছক্কা। এখানেও পেছনে ফেলেছেন তামিমকে (৭ ছক্কা)।
খুব পিছিয়ে ছিলেন না তামিমও। ৬ ছক্কায় অপরাজিত থাকেন ১০৯ বলে ১২৮ রান করে। এই নিয়ে দুই দফায় পেলেন টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি।
দুজনের জুটিও জায়গা করে নিয়েছে রেকর্ড বইয়ে। ২৯২ রানের জুটি যে কোনো উইকেটে বাংলাদেশের সেরা অনায়াসেই। দুই ওপেনারের ব্যাটে সেঞ্চুরিও এই প্রথম দেখল বাংলাদেশ।
এই রেকর্ড রথেই চাপা পড়েছে জিম্বাবুয়ে। সোনায় সোহাগা হয়ে এসেছে বাংলাদেশের বোলিং ইনিংসের প্রথম ওভারেই মাশরাফির উইকেট। নিজেকে নিজের বিদায়ী উপহার। তার অধিনায়কত্বকে বিদায় জানাতে গ্যালারিতে ভীড় জমানো দর্শকদেরও উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার মুহূর্ত!
ক্যারিয়ারের শেষ টস অবশ্য হেরেছেন মাশরাফি। শুরুটায় ছিল না ঝড়ের ইঙ্গিত। প্রথম ৫ ওভারে তামিমই যা একটু এগিয়ে নিয়েছেন দলকে, লিটনের ব্যাট ছিল প্রায় নিশ্চুপ। ষষ্ঠ ওভারে চার্লটন সুমাকে দুটি বাউন্ডারিতে যেন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন লিটন। চলতে থাকে নান্দনিক সব শটের মহড়া। তামিমকে ২৯ রানে রেখে লিটন পৌঁছে যান পঞ্চাশে। ৫৪ বলে স্পর্শ করেন ফিফটি। পরের বলেই দুর্দান্ত ছক্কায় তামিম জানান দেন, তিনি স্রেফ দর্শক হয়ে থাকবেন না।
রান আসতে থাকে বানের জলের মতো। চার-ছক্কা এসেছে প্রায় প্রতি ওভারেই। দুজনের জুটি ছাড়িয়ে যায় উদ্বোধনী জুটির আগের রেকর্ড। ১১৪ বলে লিটন ছুঁয়ে ফেলেন তৃতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি।
পরের ওভারেই বৃষ্টির হানা। ৩৩.২ ওভারে বাংলাদেশের রান তখন ১৮২। সেঞ্চুরি থেকে ২১ রান দূরে তামিম।
এরপর বৃষ্টি থামার দীর্ঘ অপেক্ষা। একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ বুঝি আর ব্যাটিংয়ে নামতেই পারবে না।
আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় পর শুরু হয় খেলা। প্রথম বলেই লিটনের ক্যাচ ছাড়েন ব্রেন্ডন টেইলর। খেসারত দিতে হয় জিম্বাবুয়ের বোলারদের। তাদের ওপর দিয়ে বয়ে যায় তাণ্ডব। চার-ছক্কার বৃষ্টিতে বল উড়তে থাকে মাঠের নানা প্রান্তে।
৯৮ বলে তামিম পা রাখেন ত্রয়োদশ সেঞ্চুরিতে।
লিটন জীবন পান আরও দুই দফায়। ১২২ রানে ক্যাচ ছাড়েন সিকান্দার রাজা, ১৪৪ রানে ওয়েসলি মাধেভেরে। তুলোধুনো করতে থাকেন বোলারদের। আসতে থাকে একের পর এক ছক্কা।
প্রথম একশ রানে ছক্কা ছিল না একটিও। সেঞ্চুরির পর মারেন ৮টি ছয়! ইনিংসে চার ছিল ছক্কার দ্বিগুন।
শেষ পর্যন্ত আরেকটি ছক্কার চেষ্টায় থেমেছে লিটনের ইনিংস। অপরাজিত থেকে গেছেন তামিম।
অভিষেক ম্যাচে মোহাম্মদ নাঈম শেখ ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি। শেষ দিকে উইকেটে গিয়েছিলেন আরেক অভিষিক্ত আফিফ হোসেন।
বৃষ্টি বিরতির পর ৫৮ বলে বাংলাদেশ তুলেছে ১৪০ রান। দলের মোট সংগ্রহ ছাড়িয়ে গেছে ৩০০।
এই প্রথমবার টানা তিন ম্যাচে তিনশ রানের দেখা পেল বাংলাদেশ। আগের দুই ম্যাচে ছিল ৩২১ ও ৩২২।
লক্ষ্য এমনিতেই ছিল জিম্বাবুয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রথম ওভারে মাশরাফির উইকেটে আরও চাপে পড়ে যায় তারা।
এরপর রেজিস চাকাভা একপ্রান্ত আগলে রেখেছেন কিছুক্ষণ। ওয়েসলি মাধেভেরে আবার রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। মিডর অর্ডারে সিকান্দার রাজা খেলেছেন ৫০ বলে ৬১ রানের ইনিংস। কিন্তু জিম্বাবুয়ে জয়ের সম্ভাবনাও জাগাতে পারেনি কখনও।
ওয়ানডে অভিষেকে দ্বিতীয় বলেই শন উইলিয়ামসকে বোল্ড করেছেন আফিফ হোসেন। ওয়ানডেতে প্রথমবার ৪ উইকেটের স্বাদ পেয়েছেন সাইফ উদ্দিন, কয়েকদিন আগেই মাশরাফি যাকে বলেছেন দলের সম্পদ।
বৃষ্টির চোখরাঙানির পর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি পেয়েছেন জয়ের ফিফটি।
জয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই সবাই ছুটে গেছেন মাশরাফির দিকে। ‘হাই ফাইভ’, পিঠ চাপড়ে দেওয়া আর আলিঙ্গনের পালা চলেছে। অধিনায়ককে কাঁধে তুলে নিয়েছেন তামিম ইকবাল, মাঠ প্রদক্ষিণ করেছে গোটা দল। নেতৃত্বে যিনি হয়ে উঠেছেন মহানায়ক, এমন বিদায়ই তো তার প্রাপ্য!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৪৩ ওভারে ৩২২/৩ (তামিম ১২৮*, লিটন ১৭৬, মাহমুদউল্লাহ ৩, আফিফ ৭; মুম্বা ৮-০-৬৯-৩, সুমা ৬-১-৪৮-০, রাজা ৭-০-৬৪-০, মাধেভেরে ৫-০-২৯-০, টিরিপানো ৮-০-৬৫-০, উইলিয়ামস ৯-১-৪৬-০)।
জিম্বাবুয়ে: (লক্ষ্য ৪৩ ওভারে ৩৪২) ৩৭.৩ ওভারে ২১৮ (কামুনহুকামউই ৪, চাকাভা ৩৪, টেইলর ১৪, উইলিয়ামস ৩০, মাধেভেরে ৪২, রাজা ৬১, মুটুমবামি ০, মুটুমবোদজি ৭, টিরিপানো ১৫, মুম্বা ৪*, সুমা ০; মাশরাফি ৬-০-৪৭-১, সাইফ ৬.৩-০-৪১-৪, মিরাজ ৮-০-৪৭-০, মুস্তাফিজ ৬-০-৩২-১, আফিফ ২-০-১২-১, তাইজুল ৯-০-৩৮-২)।
ফল: বাংলাদেশ ১২৩ রানে জয়ী
সিরিজ : ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ৩-০তে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: লিটন দাস
ম্যান অব দা সিরিজ: তামিম ইকবাল ও লিটন দাস