চীন-ভারত স্নায়ুযুদ্ধের ফাঁকে সর্বোচ্চ কৌশলে এগিয়েও সম্প্রতি আগের মতো কুলাতে পারছে না বাংলাদেশ। চেষ্টা করছে কোনো পক্ষেই অবস্থান পরিষ্কার না করে দুদিকেই সমান্তরালে এগোতে। এ চেষ্টায়ও সাফল্য কমে এসেছে। উপরন্তু নানা ঘটনায় হালে বাংলাদেশের ত্রিভুজ প্রেম জটিল হয়ে আসছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইনকে ঢাকার প্রতিক্রিয়ায় এত দিন দিল্লির অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে পাস কাটানো হয়েছে। সেই সুযোগও কমে আসছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই বলতে হচ্ছে, ভারত কেন এটা করল তা বুঝছি না।
সবাই যা বোঝে তাকে কেন সেটা না বোঝার অবস্থা নিতে হচ্ছে-এ নিয়ে কূটনৈতিক পাড়ায় অন্তহীন কথাবার্তা। এর মাঝেই বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে একের পর এক তির্যক কথার তীর ছোড়া হচ্ছে ভারতের ক্ষমতাসীন মহল থেকে। এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ বলা হয়েছে, এক কোটি বাঙালি মুসলমানকে ঘাড় ধরে খেদানো হবে ভারত থেকে। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি দিলীপ ঘোষ এ হুমকি দিয়েছেন। কোনো রাখঢাক না রেখে চব্বিশ পরগনায় এক সমাবেশে তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে এক কোটি অবৈধ মুসলিম সরকারের দুই রুপির ভর্তুকির চাল খেয়ে বেঁচে আছে।
পায়ে পা দিয়ে একের পর এক এ ধরনের কথা ও পদক্ষেপকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে পাশ কাটানোর সুযোগ সংকীর্ণ হতে হতে এখন সন্ধিক্ষণে। আবার চীনের বিষয়েও বাংলাদেশের আগের মতো এঁকেবেঁকে পিছলে যাওয়ার দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে আসছে। বরং উল্টো চীনই এটা করছে বাংলাদেশের সঙ্গে। চীন অব্যাহতভাবে জাল বুনছে ভারতকে ঘিরে। সুযোগ পেলে কম যাচ্ছে না মিয়ানমারও। চীনা প্রেসিডেন্ট শির সাম্প্রতিক মিয়ানমার সফর ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশায় ফেলেছে। এটি ১৯ বছরের মধ্যে প্রথম কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের মিয়ানমার সফর।
সফরে শি চিন পিং রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একটি কথাও বলেননি। চীন-মিয়ানমার সম্পর্কে ৭০ বছর পূর্তিতে, বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সফর অং সাং সু চিকে উদ্বেলিত করেছে। উদাত্তকণ্ঠে সু চি বলেছেন, পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত মিয়ানমার চীনের বন্ধু হিসেবে থাকবে। চীনের সাথে মিয়ানমার ৩৩টি চুক্তি করেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের চুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম আরাকান অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর, ভারত মহাসাগর পর্যন্ত রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ইয়াঙ্গুনে একটি বিশেষ শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা। এর সবই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ। চীন-মিয়ানমারের এই রাখীবন্ধন ভারত-বাংলাদেশ উভয়কেই বেকায়দায় ফেলেছে। ভারত আবার মিয়ানমারের পক্ষ নিচ্ছে। বাংলাদেশও ভারত-চীন দুদিকেই পা রাখতে চায়। এই ত্রিভুজ প্রেম বাংলাদেশকে ত্রিশঙ্কুলে নিয়ে যাচ্ছে।
নানা চুক্তি ও কেনাকাটায় চীনের সঙ্গে ভারতকেও আয়ত্তে রাখার কৌশলে শেখ হাসিনা সরকার কূটনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পাশাপাশি দৃষ্টান্তও তৈরি করেছে। যার কোনো কোনোটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরআইর সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে। চীন একমুখিতায় থাকছে না। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর করতে না দেওয়ার কথা ভোলে না। সাবমেরিন কেনাসহ অন্যান্য অফুরান দান ভুলে যায়। বিকল্প খুঁজে নেয় দ্রুত। এরই মধ্যে তারা শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতা, জিবুতি, পাকিস্তানের গোয়েদার ও মালদ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন করেছে। মিয়ানমারের কিয়কপিউ দ্বীপেও গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন পাকাপাকি হয়ে গেছে। এসবের মধ্য দিয়ে চীন ভারত মহাসাগরে শক্ত অবস্থান গেড়েছে।
এমন এক সময়ে চীনের প্রেসিডেন্ট মিয়ানমার ঘুরে গেছেন, যখন মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে কোণঠাসা ও যে কোনো সময় আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে গাম্বিয়ার করা রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে। সারা দুনিয়ার মতামতকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ ওই সময়ে চীনের পরামর্শ অনুযায়ী রোহিঙ্গা ফেরতের বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছিল। চুক্তিটি সইয়ের অল্প কদিন আগে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে সফর করেন। তিনি বাংলাদেশকে চাপ দেন চুক্তি সই করতে। বাংলাদেশ থেকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি যান নেপিডোতে। বাংলাদেশ ব্যাপক আশাবাদী হয়েছিল চীনের কথা মিয়ানমার রক্ষা করবে বলে। শুধু আশাহত করেনি, রীতিমতো পিঠ দেখিয়েছে বাংলাদেশকে। অন্যদিকে ভারত প্রকাশ্যে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে আসছে। জাতিসংঘেও চীন, রাশিয়া ও ভারত মিয়ানমারের পক্ষে ছিল। এর মাঝেই ওআইসির পক্ষে গাম্বিয়ার আইজেসিতে মামলা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু মিয়ানমার দমছে না। এগিয়ে যাচ্ছে ডেমকেয়ারে। কুটবুদ্ধিতে চীনা মেগা প্রকল্পের কয়েকটি ফেলেছে রোহিঙ্গাদের বসতিস্থল রাখাইন রাজ্যে। পাশে রাখছে ভারতকেও। এতে চীনা মতিগতি পরিষ্কার। একইভাবে বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের নীতি-কৌশলও আর ধামাচাপার মধ্যে নেই। দিল্লি-বেইজিং এই দুই বন্ধন থেকে চাইলেই বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই ঢাকার। যে কোনো এক প্রেম থেকে পা খসলেই মহাবিপদ।