দারিদ্র এবং দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান অমর্ত্য সেন।
দু’হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো - সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।
বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের ভোটে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ১৪তম স্থানে আসেন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। আজ তাঁর জীবন-কথা।
১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাঙালিদের মন জয় করেছিলেন অমর্ত্য সেন। দারিদ্র এবং দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণার জন্য পৃথিবী জুড়েই তিনি শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।
অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন নিজেকে ঢাকা এবং কলকাতা দুই শহরেরই সন্তান হিসাবে গণ্য করেন।
অমর্ত্য সেন নোবেল ওয়েবসাইটে তাঁর আত্মজীবনী শুরু করেছিলেন এই বলে যে “আমার জন্ম একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এবং সারা জীবনই আমি ঘুরে বেড়িয়েছি এক ক্যাম্পাস থেকে আরেক ক্যাম্পাসে।”
শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবন। কর্মসূত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্যাম্পাসের সঙ্গে তাঁর জীবন জড়িয়ে গেলেও, তিনি বলেছেন শিকড়ের টান তিনি সবসময়ই অনুভব করেছেন।
“আমার পৈত্রিক বাড়ি হচ্ছে পুরানো ঢাকার ওয়ারি অঞ্চলে- রমনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছেই। আমার বাবা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি পড়াতেন। আমার জন্ম অবশ্য শান্তিনিকেতনে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসে। আমার মাতামহ সেখানে অধ্যাপক ছিলেন,” নোবেল ওয়েবসাইটে লিখেছিলেন অমর্ত্য সেন।
অমর্ত্য সেন বলেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্কুলে পড়ার সমেয়ই প্রধানত শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী প্রথম একটা রূপ লাভ করে।
শান্তিনিকেতনে মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেনের বাড়িতে তাঁর জন্ম ১৯৩৩ সালের তেসরা নভেম্বর।
শান্তিনিকেতনের আচার্য অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের একজন পণ্ডিত এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগী।
পৌত্র অমর্ত্য সেনের প্রথম স্কুল ছিল ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিস্। তারপর লেখাপড়া শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে।
অমর্ত্য সেন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “শান্তিনিকেতনে প্রধানত রবীন্দ্রনাথের স্কুলেই শিক্ষার ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গী প্রথম একটা রূপ লাভ করে। সেখানে ছেলে মেয়ে একসঙ্গে পড়ত, শিক্ষার পরিবেশ ছিল অনেক উদার।”
“প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি করা বা কে কাকে টপকে যাবে সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়ার বদলে তাদের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলাটাই ছিল সেখানে শিক্ষাদানের মূল আদর্শ। পরীক্ষায় ভাল করা বা ভাল নম্বর পাওয়ার ব্যাপারে কখনই উৎসাহ দেওয়া হতো না।”
১৯৯৮ সালে নোবেল পাওয়ার সময় প্রফেসর অমর্ত্য সেন ইংল্যাণ্ডে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের ‘মাস্টার’ ছিলেন। অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের কোন কলেজের তিনিই প্রথম এশীয় প্রধান।
বাবা আশুতোষ সেন ১৯৪৫ সালে পরিবার নিয়ে পাকাপাকিভাবে চলে গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে।
শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া শেষ করে অমর্ত্য সেন পড়তে যান কলকাতায়।
“ছেলেবয়স থেকে কলকাতা যাওয়ার তো সবারই খুব উৎসাহ থাকে। আমারও খুব উৎসাহ ছিল,” লিখেছেন অমর্ত্য সেন।
১৯৫১ সালে আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তিনি ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। এবং তারপর অর্থনীতি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন ইংল্যাণ্ডে কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে।
তাঁর মেধা ও নিজস্বতায় অমর্ত্য সেন কলকাতার মন জয় করেছিলেন সেই ছাত্রাবস্থাতেই।
প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর সহপাঠী ঐতিহাসিক বরুণ দে এই অনুষ্ঠান তৈরির সময়ে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন অমর্ত্য সেন একজন অন্যধরনের মানুষ ছিলেন।
“কলেজে যখন এলেন দেখতে লম্বা, সুন্দর চেহারা, লোককে মুগ্ধ করার মতন কথাবার্তা বলার ধরনধারণ। অমর্ত্য যেখানে সবাইকে জয় করলেন, সেটা হচ্ছে সকলের সঙ্গে মিশ খেয়ে যাওয়ার তাঁর বিশেষ ক্ষমতা। মেয়েরা তো একেবারে কুপোকাত ছিল তাঁকে দেখে।”
বিতর্কে অমর্ত্য সেনের তুখোড় দক্ষতা ছিল। এমনকী তাঁর প্রথম স্ত্রী নবনীতা দেবসেন বলেছেন তাঁদের দুজনের প্রথম আলাপও ছিল বিতর্কের সূত্রে।
“তখন সাহিত্য চর্চ্চাতে তিনি যুক্ত ছিলেন। ডিবেট করতেন। ছাত্র বয়সে বিখ্যাত ডিবেটার ছিলেন। তারপর ১৯৫৩ সালে তিনি চলে যান ইংল্যাণ্ডে। আবার ১৯৫৬ সালে ফিরে এসে যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, তখন তিনি যাদবপুর ডিবেটিং সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন মাস্টার। আমি ডিবেট করতাম। সেভাবেই আমাদের আলাপ।”
অমর্ত্য সেন তাঁর শিক্ষকতা শুরু করেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং লণ্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে অধ্যাপনার মধ্যে দিয়ে তিনি আরোহন করেছেন শিক্ষকতার জগতে একটার পর একটা চূড়ায়।
তবে ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারই তাঁকে বাঙালির হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান করে দিয়েছিল।
অমর্ত্য সেন নিজেই বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন কিসের স্বীকৃতিতে এই সম্মান।
“নোবেল পুরস্কার যে কারণে আমাকে দিল সে বিষয়ে নোবেল কমিটির লিখিত বক্তব্যে ছিল কাজটা প্রধানত ওয়েলফেয়ার ইকনমিক্স-এর জন্য। এবং সোস্যাল চয়েস। কাজটা আমি প্রধানত করি দিল্লিতে। বিষয়টা তত্ত্বভিত্তিক হলেও নোবেল কমিটি লিখেছিল যে এই থিয়োরি বাস্তব জগতের নানা সমস্যার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তার উদাহরণ দিতে গিয়ে নোবেল কমিটি দুর্ভিক্ষ বিষয়ে আলোচনা করেছে।”
বাংলায় ১৯৪৩-এর মন্বন্তর প্রত্যক্ষ করেছিলেন অমর্ত্য সেন। ওই দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর গবেষণার সূত্রপাত।
জনকল্যাণ অর্থনীতি এবং গণদারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বিষয়ে তাঁর গবেষণার জন্য তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
অমর্ত্য সেন বলেছেন জনকল্যাণ অর্থনীতিতে একদিকে রয়েছে অর্থনৈতিক অসমতা ও দারিদ্রের বিষয়, আর অন্যদিকে রয়েছে যুক্তিসঙ্গত, সহনীয় ও গণতান্ত্রিক সামাজিক সিদ্ধান্তের সুযোগ ও সম্ভাবনার দিক।
বাংলায় ১৯৪৩-এর মন্বন্তর প্রত্যক্ষ করেছিলেন অমর্ত্য সেন। ওই দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর যে গবেষণার সূত্রপাত, নোবেলজয়ী সেই কাজের পেছনে ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের পরিশ্রম।
“সমাধান বিষয়ে কাজ আমি অবশ্য অনেক পরে করেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন অমর্ত্য সেন।
“শান্তিনিকেতনের আশেপাশে বাস করা মানুষের আয় কত ছিল, চালের দাম কত ছিল, এসব তথ্য সাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে, শান্তিনিকেতনে এবং তার আশপাশের অঞ্চলে।”
“কলকাতার মানুষ যদি মনে করেন আমি কলকাতার সেটা তারা ঠিকই মনে করবেন। কিন্তু শুধু কলকাতা নয়, শান্তিনিকেতনের সঙ্গেও আমার একই রকম যোগাযোগ আছে। পাশাপাশি ঢাকার সঙ্গেও আমার যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ।”
অমর্ত্য সেন বলেছেন তিনি কোন একটা শহরের বা একটা দেশের পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে চান না।
তাই বাঙালির গর্ব হয়েও আজ তিনি বিশ্বনাগরিক।