বরিস জনসন এবং তার বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডস ঘোষণা দিয়েছেন যে, তারা পরস্পর অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন এবং সন্তানের পিতামাতা হতে চলেছেন।
গত বছর মি. জনসন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের দায়িত্ব নেয়ার পর এই যুগল হলো ডাউনিং স্ট্রিটের প্রথম অবিবাহিত যুগল।
কিন্তু কে এই ক্যারি সিমন্ডস? পূর্বসূরিদের তুলনায় কীভাবে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবন প্রভাবিত করছেন?
ক্যারি সিমন্ডস কে?
মিজ সিমন্ডস হচ্ছেন ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ম্যাথু সিমন্ডস এবং সংবাদপত্র আইনজীবী জোসেফিন ম্যাকাফি’র কন্যা।
৩১ বছর বয়সী মিজ সিমন্ডস লন্ডনের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে বড় হয়েছেন। পরবর্তীতে তিনি ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস এবং থিয়েটার নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।
রিচমন্ড পার্ক ও নর্থ কিংস্টনের এমপি জ্যাক গোল্ডস্মিথের জন্য কাজ করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে তার প্রথম চাকরী হয় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ”তার জন্য কাজ করার সুযোগ না হলে আমার টোরিদের জন্য কাজ করা হতো কিনা সন্দেহ রয়েছে।”
২০১০ সালে কনজারভেটিভ পার্টিতে প্রেস অফিসার হিসাবে যোগ দেন। দুই বছর পরে বরিস জনসনের নির্বাচনী প্রচার শিবিরে কাজ করেন, যে নির্বাচনে লন্ডনের মেয়র হিসাবে মি. জনসন পুনর্নির্বাচিত হন।
এর পরে তিনি কাজ করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী জন হোয়াইটিংডেলের জন্য। তারপর ডিপার্টমেন্ট ফর কম্যুনিটিস এন্ড লোকাল গভর্নমেন্টের তৎকালীন প্রধান সাজিদ জাভিদের দপ্তরে মিডিয়া স্পেশাল অ্যাডভাইজর হিসাবে দায়িত্ব নেন।
তিনি দলের যোগাযোগ বিষয়ক প্রধান হয়ে ওঠেন। কিন্তু ২০১৮ সালে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রের জৈববৈচিত্র রক্ষায় কাজ করা প্রতিষ্ঠান ওসেনার জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসাবে কাজ শুরু করেন।
সংরক্ষণ বিষয়ে মিজ সিমন্ডের আগ্রহ রয়েছে। পশুপাখির ওপর নির্মমতা ও প্লাস্টিক বর্জ্য বিষয়ক খবর তিনি প্রায়ই তার টুইটার একাউন্টে শেয়ার করে থাকেন।
তিনি একবার বলেছিলেন, একটি পশু রক্ষা দাতব্য সংস্থায় শিক্ষানবীশ হিসাবে কাজ করার ফলে জীব-জন্তুর অধিকার রক্ষার বিষয়টি তার ভেতরে কাজ করতে শুরু করে।
ব্রিটেনের সংবাদ মাধ্যমগুলো শেয়াল শিকারে মি. জনসনের বিরোধিতা, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রথম বক্তৃতায় জীব-জন্তুর কল্যাণের বিষয়টি থাকার পেছনে মিজ সিমন্ডের অবদান রয়েছে বলে আখ্যা দিয়ে থাকে।
২০০৯ সালে মিজ সিমন্ডস ডেইলি টেলিগ্রাম পত্রিকাকে বলেন যে, ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় একবার তাকে ব্ল্যাক ক্যাব ধর্ষণকারী জন ওরবয়েজ গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়েছিল।
পত্রিকাকে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় তিনি নাম গোপন রাখার অধিকার নাকচ করে বর্ণনা করেন যে, ২০০৭ সালের জুলাই মাসে যখন তিনি পশ্চিম লন্ডনে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তখন জন ওরবয়েজ তার সামনে ক্যাব থামিয়ে পাঁচ পাউন্ডের বিনিময়ে বাসায় পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি তাকে এক গ্লাস শ্যাম্পেন খাওয়ার প্রস্তাব করেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি। তবে তিনি এক শট ভদকা খেয়েছিলেন।
তবে পরবর্তীতে ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি প্রচার করেছিলেন।
কতদিন ধরে এই যুগল একত্রে রয়েছেন?
২০১৯ সালের প্রথম দিকে প্রথমবার মি. জনসনের সঙ্গে মিজ সিমন্ডসের সম্পর্কের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে।
মি. জনসন এবং তার স্ত্রী, ছোটবেলার বন্ধু ম্যারিনা হোয়েলার ২০১৮ সালে ঘোষণা করেন যে, ২৫ বছরের বিবাহিত সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে তারা আলাদা হতে যাচ্ছেন। তাদের চারটি সন্তান রয়েছে।
১২ই জুনে মি. জনসনের নেতৃত্ব নেয়ার প্রচারণার সময় মিজ সিমন্ডসকে দর্শক সারিতে বসে থাকতে দেখা যায়।
সেই মাসেই কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার আগেই, ওই যুগলের দক্ষিণ লন্ডনের বাড়িতে যেতে হয় পুলিশকে। কারণ প্রতিবেশীরা অভিযোগ করেছিলেন যে, বাড়ি থেকে তীব্র বাক-বিতণ্ডা শোনা যাচ্ছে।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে যখন মি. জনসন প্রথমবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হন, মি. জনসনের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রবেশের সময় সাইড লাইনে থেকে দেখেছেন মিজ সিমন্ডস।
তার পূর্বসূরিদের তুলনায় ঘটনাটি ব্যতিক্রম। কারণ পূর্বসূরিদের সবাই তাদের স্বামীদের সঙ্গে একত্রে ডাউনিং স্ট্রিটে পা ফেলেছিলেন।
কিন্তু ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর এই যুগল একত্রেই ডাউনিং স্ট্রিটে প্রবেশ করেন।
১১ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন এই যুগল। দক্ষিণ ওয়েলসের একটি পশু উদ্ধার দাতব্য সংস্থা থেকে তারা একটি কুকুর ছানা নিয়ে পালন করেন, যার নাম দেয়া হয়েছে ডিলান।
গ্রীষ্মের শুরুর দিকে তাদের সন্তান হতে যাচ্ছে। তার মানে ধারণা করা যায় যে, শরতের সময় তিনি গর্ভধারণ করেছেন। সময়টি হতে পারে ৩১শে অক্টোবরের আশেপাশে যখন ব্রেক্সিট সময়সীমা বর্ধিত হয়।
কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবন বদলেছে?
যখন মি. জনসন দপ্তরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন এটা অভূতপূর্ব একটা ব্যাপার ছিল যে, একজন প্রধানমন্ত্রী তার মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে ডাউনিং স্ট্রিটে বসবাস করবেন।
৫৫ বছর বয়সী বরিস জনসন হচ্ছেন ১৭২১ সালের পর ব্রিটেনে তালাকপ্রাপ্ত তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। আর মিজ সিমন্ডস হচ্ছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর ১৭৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী সঙ্গিনী।
মিজ হোয়েলারের আগে মি. জনসন অ্যালেগ্রা মস্টিন-ওয়েনকে ১৯৮৭ সালে বিয়ে করেছিলেন। সেই বিয়ে টিকেছিল ছয় বছর।
২০০৪ সালে তাকে কনজারভেটিভ পার্টির সামনের সারি থেকে সরিয়ে দেয়া হয় কারণ সাংবাদিক পেট্রোনেলা ওয়াটের সঙ্গে কথিত প্রেমের ব্যাপারে তিনি দলের নেতাকে বিভ্রান্ত করেছিলেন বলে দাবি করা হয়।
২০১৩ সালে আদালতের একটি শুনানির সময় বেরিয়ে আসে যে, ২০০৯ সালে লন্ডনের মেয়র থাকাকালীন একটি সম্পর্কের মাধ্যমে মি. জনসন একটি কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছিলেন।
যদিও ১৯৫০ এর দশকে বিচ্ছেদের ব্যাপারটিকে কেলেঙ্কারি হিসাবে দেখা হতো, কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গীর ব্যাপারে সেই ধারণারও বদল ঘটেছে বলে বলছেন রাজনৈতিক প্রভাষক ড. নিকোলাস অ্যালেন।
ওএসএসের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে এটা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয় - দেশটিতে এখন এ ধরণের পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে।
যদিও মিজ সিমন্ডসের চেয়ে মি. জনসন ২৪ বছরের বড়, কিন্তু বয়সের বড় পার্থক্যের ঘটনা আগেও দেখা গেছে।
গর্ভধারণের সংবাদ প্রসঙ্গে বলা যায়, দায়িত্বরত প্রধানমন্ত্রীর সন্তান জন্ম দেয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়।
টনি এবং চেরি ব্লেয়ারের ছেলে লিও-র জন্ম হয়েছিল ২০০০ সালের মে মাসে আর ডেভিড ও সামান্থা ক্যামেরনের মেয়ে ফ্লোরেন্সের জন্ম হয়েছিল ২০১০ সালে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গীরা সাধারণত কী দায়িত্ব পালন করে থাকেন?
রয়্যাল হলোওয়ে ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ড. অ্যালেন বলছেন, এই দায়িত্বের ব্যাপারটিকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
তিনি বলছেন, সব সঙ্গীরাই কোন না কোন সময়ে এমন একজন যার সঙ্গে রাতে কথা বলা যায়, সেই সঙ্গে সরকারি নানা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী হওয়া।
অনেক সঙ্গী নীতি বা রাজনৈতিক ভূমিকা নেন, আবার অনেকে দপ্তরের কাজে সহায়তা করেন।
টেরেসা মে তার স্বামী ফিলিপ মে’কে ‘বরফে’র সঙ্গে তুলনা করেছেন, যিনি তার কঠিন সময়ে তাকে হুইস্কি ঢেলে দেন আর টোস্টের ওপর বীন ছড়িয়ে দেন।
মি. মে এখনো তার স্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশের বড় সফরগুলোয় সঙ্গ দিয়ে থাকেন।
তার ভূমিকাকে তুলনা করা যেতে পারে আরেকজন পুরুষ পূর্বসূরির সঙ্গে, ডেনিস থ্যাচার, যিনি তার দায়িত্বকে তুলনা করেছিলেন এভাবে ‘ সবসময়েই উপস্থিতি, আবার কখনোই নেই।”
লেখক মার্ক হিচিন্স ‘প্রাইম মিনিস্টারস ওয়াইফস এন্ড ওয়ান হাজব্যান্ড’ বইতে লিখেছেন যে, তাদের নিজস্ব কোন পেশা নেই।
চেরি ব্লেয়ারের আগে শুধুমাত্র অড্রে ক্যালাহান আর ডেনিস থ্যাচারের নিজস্ব পেশা ছিল।
যখন মানবাধিকার আইনজীবী এবং খণ্ডকালীন বিচারক চেরি ব্লেয়ার স্বামী টনির সঙ্গে দশ নম্বর ডাইনিং স্ট্রিটে আসেন, তার আগে আর কোন প্রধানমন্ত্রীর এতো বড় প্রোফাইলের সঙ্গী সেখানে আসেনি।
একজন আইনজীবী হিসাবে নিজের পেশা অব্যাহত রেখেছিলেন মিসেস ব্লেয়ার এবং কখনো কখনো শিরোনামও হয়েছেন।
তিনি একবার টিভি উপস্থাপক রিচার্ড এবং জুডিকে ফোন করে অভিযোগ করেছিলেন যে, তার স্বামী কখনোই তার জন্য ফুল কেনেনি। কখনো কখনো তিনি সরকারের নীতিগত বিষয় নিয়েও কথা বলেছেন।
মিসেস ব্লেয়ারের উত্তরসূরী সারাহ ব্রাউন এবং সামান্থা ক্যামেরন দাতব্য নানা কর্মকাণ্ডের জন্য কাজ করেছেন।
জনসংযোগ নির্বাহী এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা মিসেস ব্রাউন তার সেবামূলক কাজ অব্যাহত রেখে গিয়েছেন। ২০০৯ সালে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন।
পরবর্তীতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হিসাবে জীবনযাপন নিয়ে একটি বই লিখেছেন।
অন্যদিকে স্বামী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেয়ার পর, ব্যবসায়ী মিসেস ক্যামেরন- যিনি তখন ছিলেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা- ঘোষণা দেন যে তিনি বিলাসবহুল পণ্য প্রতিষ্ঠান স্মিথসনসের ক্রিয়েটিভ পরিচালকের পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।
পরবর্তীতে তিনি স্বেচ্ছাসেবীদের নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন এবং ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিলের দূত হিসাবে ভূমিকা রেখেছেন।
ড. অ্যালেন বলছেন, সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গীদের ভূমিকার পরিবর্তন এসেছে। এখন আর একজন স্ত্রীকে শুধুমাত্র তার স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত হতে হয় না।