সপ্তাহ তিনেক আগে ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি। উদ্দেশ্য, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে বিএসসি ডিগ্রির আবশ্যকতা পূরণকারী একদল শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল রেখে নিজের ক্যারিয়ারে তাঁরা কী করতে চান, সেটি জানা। স্বভাবতই আলোচনার অনেকখানিজুড়ে ছিল তথ্যপ্রযুক্তি, মানুষ ও যন্ত্রের মিথস্ক্রিয়া, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে বিশ্বজুড়ে চাকরির প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ার ব্যাপার। ২০৩০ সাল নাগাদ ৮০ কোটি কর্মের বিলুপ্তির কথা যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি নতুন ১০০ কোটি চাকরি সৃষ্টির কথাও বলা হচ্ছে। আশা না হতাশা, কোন দিকে পাল্লা ভারী, সেটি জানতে গিয়ে টের পেলাম আশার পাল্লা ভারী।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, আজতক নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে বেশি, পুরোনোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার চেয়ে। এখনো তা–ই হবে। কিন্তু সে জন্য প্রস্তুতিটা হতে হবে বিপ্লবী! শুধু পাঠ্যবইয়ে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখলে হবে না; কারণ, এখন প্রযুক্তি ও মূল দক্ষতার পাশাপাশি চাওয়া হচ্ছে তুরীয় চিন্তা, সমস্যা সমাধান, যোগাযোগ ও জনব্যবস্থাপনার দক্ষতা। আর কে না জানে, এসব বিষয়ে নিজেকে তৈরি করার জন্য শিক্ষার্থীকে পাঠ্যপুস্তক, পরীক্ষা আর অ্যাসাইনমেন্টের বেড়া ডিঙাতে হয়। সেই আলোচনায় আরও একটি বিষয় আমি লক্ষ করেছি। অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী বলেছেন, তাঁরা চাকরি খুঁজতে চান না, অন্যকে চাকরি দেওয়ার জন্য উদ্যোক্তা হতে চান!
তাঁদের এই চাওয়ার সঙ্গেই যেন মিলেছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক আহ্বান। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের এক সভায় ঠিক এমন কথাই বলেছেন। ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলায় তাঁর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের জন্য আরও বেশি অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। যাতে তাঁরা চাকরির পেছনে না গিয়ে নিজেরা উদ্যোক্তা হতে পারেন। ট্রাস্টের প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেখ হাসিনা বলেন, “চাকরির পেছনে ছোটার যে আমাদের মানসিকতা, সেটার পরিবর্তন করতে হবে।” তিনি যুবসমাজকে চাকরি করার চেয়ে চাকরি দেওয়ায় মনোযোগী হওয়ারও আহ্বান জানান।’ (‘তরুণদের উদ্যোক্তা হতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান’, প্রথম আলো অনলাইন, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০)।
দেশের সরকারপ্রধানের এই আহ্বান আমাদের তরুণদের আশারই প্রতিরূপ। দেশে প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ তরুণ-যুবা কর্মবাজারে প্রবেশ করেন। বিদেশে পাঠিয়ে, সরকারি-বেসরকারি চাকরি দিয়ে এবং নানা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার পরও প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ ছেলে–মেয়ে নিজেদের জন্য একটি শোভনীয় কাজের ব্যবস্থা করতে পারেন না। বলা বাহুল্য, এই ২২ লাখ তরুণের ১০ শতাংশকেও যদি উদ্যোক্তাতে পরিণত করা যায়, তাহলে তাঁরাই বাকিদের কর্মসংস্থান করতে পারবেন।
এই আশাবাদের জায়গায় আমরা বরং দেখি আমাদের সমাজে উদ্যোক্তা হওয়ার ‘হ্যাপা’ কেমন। শুরু হয় পরিবার ও সমাজ থেকে। আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের কোনো সামাজিক বা পারিবারিক স্বীকৃতি নেই। এমনকি নেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। স্বাধীনতার এত বছর পর এখন পর্যন্ত আমরা একজন উদ্যোক্তাকেও স্বাধীনতা পদক দিতে পারিনি। আমাদের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের পুরোধা, দেশ গার্মেন্টসের উদ্যোক্তা নুরুল কাদের কেবল দেশের প্রধানতম রপ্তানি পণ্যের বিকাশের পথের সূচনা করেননি, বরং একই সঙ্গে আমাদের দেশে শিল্পের সম্ভাবনাকেও সামনে এনেছেন। আশির দশকে তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে তাঁর ৯ ঘণ্টার ম্যারাথন সভা শেষে আমরা পেয়েছি ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্রের ধারণা, যা এ দেশে পুঁজি সৃষ্টিতে বিশাল অবদান রেখেছে। না, আমরা তাঁকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার যোগ্য ভাবিনি।
আমাদের তরুণ উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বস–এর তিরিশের নিচে ৩০ তালিকায় স্থান নিয়েছেন। তবে আমরা দেখলাম না আমাদের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান তাঁদের একদিন চা খেতে নেমতন্ন জানিয়েছেন। খুলনার একজন উদ্যোক্তা দুঃখ করে একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘স্যার, আমার অফিসের ২৪ জন প্রকৌশলীই বিয়ের বাজারে পাত্র হিসেবে ভালো, কিন্তু আমারই কোনো দাম নেই!’
বটে, এটাই সত্য। এই কঠিন বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে যে লড়াকু তরুণ উদ্যোক্তা হতে আসেন, তার জন্য প্রতিটি পদে আমরা বাধার বিন্ধ্যাচল বসিয়ে রেখেছি। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রথমেই দরকার একটি ট্রেড লাইসেন্স। আমাদের লড়াকু তরুণ ইন্টারনেটে নানা কাজ করতে পারেন, অন্যের ওয়েবসাইট বানিয়ে দিতে পারেন, তার জন্য সফটওয়্যার বানাতে পারেন, অনলাইনেই সহকর্মীদের দেখভাল করতে পারেন, কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স পেতে হলে তাঁকে একটি ‘ঘর’ ভাড়া করতেই হয়। নতুবা একটি জাল বাড়িভাড়ার দলিল বানিয়ে ট্রেড লাইসেন্স জোগাড় করতে হয়। এরপর শুরু হয় তাঁর বিরাট সংগ্রাম। ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮। দক্ষিণ এশিয়ার তালিকায় যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান কেবল আমাদের নিচে! তাহলে বোঝেন তার দৈনন্দিন সংগ্রাম কেমন।
এরপর শুরু হয় নানা দপ্তরের হয়রানি। সম্প্রতি এক উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, একজন কর্মকর্তা নিয়মিতভাবে তাঁদের শোরুমে গিয়ে দামি পণ্য হাতে করে নিয়ে যান, মূল্য পরিশোধ করেন না। মিরপুর থেকে হাজারীবাগে অফিস স্থানান্তর করলে ভ্যাটের কাগজপত্র স্থানান্তর করতে কমপক্ষে এক মাস সময় লাগে, যথাযথ স্পিড মানি দেওয়ার পরও!
এক কারখানার উদ্যোক্তা জানালেন আরও অদ্ভুত কথা। কারখানা থেকে মালামাল নিয়ে চার জায়গায় পাঠানোর জন্য তাঁর কাভার্ড ভ্যান বের হয়েছে। রাস্তার জ্যাম ঠেলে তিন জায়গায় মালামাল দিতে দিতে রাত ১২টা পার হয়ে গেছে। ৪ নম্বর দোকানে পৌঁছানোর পথে ভ্যাট পরিদর্শক গাড়ি আটকে দাবি করেছেন, ভ্যাট চালানের তারিখ ঠিক নেই। কারণ, এটা গতকালের। কী করতে হবে? ‘কারখানায় গিয়ে নতুন চালান করে আনেন অথবা আমারে ম্যানেজ করেন।’
আরেকজন উদ্যোক্তা উত্তরবঙ্গে নিজের গ্রামকে শহরে পরিণত করেছেন একটি আউটসোর্সিং ফার্ম স্থাপন করে। গ্রামের তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। খেলাধুলা আর পড়াশোনার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর গ্রামে পৌঁছায়নি উচ্চগতির ইন্টারনেট। রেডিও লিংক বসিয়ে তাঁকে ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। ‘শুধু ফাইবার অপটিক কানেকশন হলেই আমি আরও এগিয়ে যেতে পারতাম।’ এই তরুণদের সাশ্রয়ী মূল্যে ব্যান্ডউইডথ দিতে পারলেই তাঁরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে ফেলতে পারতেন। হিসাব বলে, প্রতি এক হাজার ব্রডব্যান্ড কানেকশন নতুন আটটি কর্মের সৃষ্টি করে।
আপনি যদি ঢাকার বাইরে যান, তাহলে দেখবেন, উদ্যমী তরুণেরা কতভাবে নিজেদের ভাগ্য বদলের চেষ্টা করছেন। ব্রডব্যান্ড আর জ্ঞান কী করতে পারে, তার উদাহরণ ভূরি ভূরি বিশ্বজুড়ে। মাত্র ৫৫ জন তরুণ-তরুণী মিলে হোয়াটসঅ্যাপ নামে অ্যাপ্লিকেশন বানাতে পারেন, যার মূল্য মাত্র ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা! আমাদের তরুণদের বানানো ‘দোকান’ নামের
ই-কমার্স সলিউশনে বিশ্বের ৩৫ হাজার ই-কমার্স সাইট চলে। আমরাও পারি। আমরা জানিও। কিন্তু সারা দেশের তরুণদের হাতে সাশ্রয়ী মূল্যে ব্রডব্যান্ড সেবা আমরা নিশ্চিত করতে পারি না।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আমাদের তরুণদের উৎসাহ দিতে চান, বিনিয়োগও করেন। কিন্তু ২০১৯ সালে আফ্রিকার ছোট্ট দেশ কেনিয়ার স্টার্টআপে যেখানে বিনিয়োগ হয়েছে ৪২৮ মিলিয়ন ডলার, সেখানে আমরা ১০০ মিলিয়ন ডলারও জোগাড় করতে পারিনি। কেউ কি এর কারণ অনুসন্ধান করছেন? এর একটি প্রধান কারণ হলো স্টার্টআপদের শেয়ারবাজারে যাওয়ার পথটি আমাদের এখানে সুগম নয়।
অথচ সরকার কত কিছুই না করছে। এ বছরের বাজেটে স্টার্টআপদের জন্য ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। স্টার্টআপ বাংলাদেশ নামে একটি বিনিয়োগ কোম্পানি গঠনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। আইসিটি বিভাগ, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থা উদ্যোক্তাদের জন্য কাজ করছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্টার্টআপ ওয়ার্ল্ড কাপ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) মতো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানও।
কিন্তু যে হারে অগ্রগতি হলে তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আশাবাদ তৈরি হতো, সেটি কি হচ্ছে?
সূত্র: প্রথম আলো