বিশেষ প্রতিনিধি : বেসামাল অবস্থা ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে। এদের ওপর সরকার, ক্ষমতাসীন দল, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারো কারো একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা এখন বুমেরাং হতে বসেছে। মাস কয়েক আগ পর্যন্তও এরা ছিল বশ্যতার মধ্যে। এরা কেউ সরকারবিরোধী নয় বলে সরকারের দিক থেকেও উদ্বেগ ছিল না। কৌশল হিসেবে এরা বিরোধী দল বা মতের কারো সঙ্গে জড়াচ্ছে না। থাকছে সরকারি দল ঘেঁষেই। কিন্তু তাদের একের পর এক সরকারের অস্তিত্ব ও ক্ষমতার সিন্দুকে থাবা বসানোয় পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, খালেদ ভুইয়া, জি কে শামীম, সেলিম প্রধানসহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের কয়েক শিরোমণিকে ধরা ছাড়া আর গতি থাকেনি সরকারের। এতে বাধে আরেক বিপত্তি। তাদের কারো কারো জীবন সংকটে পড়েছে। দাপট ও ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে কোন্দলে ভেতর-বাইরের সন্ত্রাসীরা এখন খুনের উন্মাদনায়। জেলে থাকা ডনকে মেরে ফেলার আয়োজন চলছে। আবার বাইরে মাঠ দাবড়ানো কয়েকজনকে ‘নাই’ করে দেওয়ার সিগন্যাল আসছে জেলে থাকা ডনের কাছ থেকে।
গোয়েন্দাদের তথ্যের ভিত্তিতে কারাবন্দী সম্রাট, খালিদদের নিরাপত্তা বাড়াতে হয়েছে। একইভাবে মুক্ত থাকা কয়েকজনের জীবনরক্ষায়ও নজর দিতে হচ্ছে। এর বাইরে ভিন্ন অবস্থান রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতায় জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফের। গোটা পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণ তার। উদ্দেশ্যও দীর্ঘমেয়াদি। বিশেষ জায়গার সংকেত না পেলে এবং গোটা পরিস্থিতি আয়ত্তে আসার গ্যারান্টি না থাকলে তার এখনই ফ্রন্টে আসার পরিকল্পনা নেই। কোনোক্রমেই গণমাধ্যমে যেন শিরোনাম না আসেÑসেই সতর্কতার মধ্যে ঘুরছে জোসেফের বর্তমান-ভবিষ্যৎ। জিসানের দেশে আসা-না আসা, সামনে বাড়া বা থমকে যাওয়া নির্ভর করছে তার ওপর। এর বাইরেও জোসেফকে নিয়ে রয়েছে আরো কিছু ফ্যাক্টর।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান অপরাধজগতে একটি মেরুকরণ তৈরি করেছে। শীর্ষ কয়েকজন ধরা পড়লেও খরস্রোতা হয়ে বেড়ে ওঠে সেকেন্ড-থার্ড সারির কয়েকজন। আবার বিদেশ থেকেও ছুটে আসে দুর্ধর্ষ কয়েকজন। পুলিশের খাতায় ছিঁচকে-খুচরা হলেও কয়েকজনের আসল তথ্য ভয়ংকর। বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার করা এ তালিকা সরকারের শীর্ষমহলকে ভাবিয়ে তোলে। এতে উঠে আসে পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীর বাইরে কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাওয়া তথ্য। কর্মক্ষেত্র কেবল ঢাকায় নয় তাদের। অবিশ্বাস্য শক্ত গাঁথুনি দেশের নানা প্রান্তে। কেউ কেউ অর্থ, দাপট, ক্ষমতা, হাইচ্যানেল যোগাযোগে সম্রাট, খালিদদের ছাড়িয়ে গেছে। এদের কেউ কেউ নির্দিষ্ট এলাকায় পরাক্রমশালী। কারো কারো কাছে রয়েছে র্যাব-পুলিশের ব্যবহার করা অস্ত্রের মতো মারণাস্ত্র। বাসা এবং অফিসে ক্যাশ কোটি কোটি টাকা, যা কোনো কোনো ব্যাংকেও থাকে না। মাদক, চোরাচালান, মেগা প্রজেক্টের টেন্ডারের বিশাল ভাগ তাদের। পুরনো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেককে টপকে গেছে এরা। নিজেদের একটা আলাদা অবস্থান করে নিয়েছে তারা। এত দিন কিছু নিয়ন্ত্রণ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো অংশের সঙ্গে বোঝাপড়ায় চললেও এখন তারা বেপরোয়া।
খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ব্যাংকে হ্যাকিং, লুটপাটসহ নানা কুকর্মে নতুন দিগন্ত খুলেছে তারা। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, পাপিয়া স্টাইলের ভোগবিলাসী ব্যবস্থার এলাহি আয়োজনে বহু রথি-মহারথি তাদের কবজায়। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে তারা সরকারের ভেতর আরেক সরকার চালানো শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে দেহব্যবসা, অস্ত্র-মাদক ব্যবসা করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা কিছু নারীও জুগিয়েছে তারা। জাল টাকার ব্যবসাও রয়েছে তাদের কারো কারো। অবস্থাটি সরকারের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে ওঠায় আবার শুরু করতে হয়েছে ‘শুদ্ধি’ নামের অভিযানটি। মহিলা লীগ রাজনীতির মক্ষিরানি পাপিয়াকে পাকড়াও, তার হেরেমখানায় অভিযান, পুরান ঢাকার এনু-রুপম সহোদরের বাড়ি থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা-সোনাদানা উদ্ধার ওই অভিযানেরই অংশ।
সংস্থাটির তথ্যের আলোকেই ধরা হয়েছে দুবাই-ফেরত শাকিলকে। খুনসহ ঢাকায় বড় ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার টার্গেট ছিল তার। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কখনো গোপনে, কখনো ছদ্মবেশ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে শাকিল। রোগী সেজে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছিল। সুযোগ খোঁজে সেখানে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে খতম করে দেওয়ার। তাকে পেছন থেকে মদদ জোগায় দেশান্তরিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। কিন্তু এগোতে পারেনি বেশি দূর। দ্রুত তাকে পাকড়াও করে আপাতত সেই টার্গেট ভণ্ডুল করে দেওয়া হয়েছে। কারাবন্দী কিলার আব্বাস ও মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানো জিসান সমর্থিতরা এ মাঠে জায়গা নেওয়ার পরিকল্পনা নেয়। আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশ-বিদেশে এমনকি জেলখানায়ও বৈঠক হয়। বিদেশে গিয়ে জিসানের সঙ্গেও দেখা করে আসে কেউ কেউ।
দক্ষিণ যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা মিল্কীর হত্যাকাণ্ডের পর সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে ছিল আন্ডারওয়ার্ল্ড। মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল, বাড্ডা এলাকায় অপরাধজগতের একক আধিপত্য তৈরি করেন সম্রাট। তিনি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের সঙ্গে মিলে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্রে জানা যায়, এখন সম্রাটের জায়গা নিয়ন্ত্রণ নিতে এসেছিল জিসানের সহযোগী শাকিল। এর জন্য সম্রাটকে হত্যার পরিকল্পনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাই কাউকে কিছু না বলেই পরদিন সহযোগীদের নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করে। হাসপাতালে ভর্তির উদ্দেশ্য ছিল কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু কঠিন নিরাপত্তায় থাকা যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে নিয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি শাকিলের। আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরেক রানি আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সদ্য বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ (২৮)। শাকিলকে গ্রেপ্তারের পরই ২২ ফেব্রুয়ারি দেশত্যাগের সময় পাপিয়াসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরও ভয়ংকর তথ্য।
সুত্র: ঠিকানা অনলাইন