ভারতের রাজধানী দিল্লির উত্তর-পূর্ব প্রান্তে যমুনার তীরে এক বিশাল শ্বেতশুভ্র ভবনের নাম মজনু-কা-টিলা গুরুদুয়ারা। এই শহরের শিখদের কাছে অন্যতম প্রধান উপাসনালয় এটি। কিন্তু, গত চার-পাঁচদিন ধরে এটি এখন দিল্লির দাঙ্গাকবলিত মানুষজনের জন্য সবচেয়ে বড় আশ্রয়কেন্দ্রি
মজনু-কা-টিলা এমনিতে দিল্লির একটি খুব আকর্ষণীয় জায়গা। তিব্বতি শরণার্থীদের বড় একটি কেন্দ্র বলে পরিচিত এই জায়গাটি, গুরুদুয়ারার ঠিক উল্টোদিকে তিমরপুর কলোনিতেও ভারতের নানা প্রান্ত থেকে আসা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত লোকজনের বাস। নানা ধরনের খাবার দাবার মেলে বলে দিল্লির বাসিন্দারা এই তল্লাটে আসেন মুখ বদলাতে – কিন্তু এখন সেখানেই শত শত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন প্রাণভয়ে।
বস্তুত দিল্লিতে এ সপ্তাহের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পীড়িত মানুষদের বাঁচাতে যে সম্প্রদায়টি সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তারা হলেন শিখ। বিপন্ন মানুষ কোন ধর্মের সেটা না-দেখে তারা একের পর এক গুরুদুয়ারার দরজা খুলে দিয়েছেন, অভুক্ত নারী-শিশু-পুরুষদের জন্য সেখানে চালু করেছেন লঙ্গরখানা। পুরো দিল্লি শহরের শিখরা এসে ‘সেবা’ বা স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন, সাধ্যমতো দান করছেন।
অথচ এই গোটা কাজটাই করা হচ্ছে সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখভাবে। প্রায় ১২শ’ মানুষ (যাদের বেশির ভাগই মুসলিম) মজনু-কা-টিলার গুরুদুয়ারাতে আশ্রয় নিয়েছেন, কিন্তু তাদের একটা ছবি পর্যন্ত মিডিয়াতে বেরোয়নি।
শনিবার সকালে যখন মজনু-কা-টিলা গুরুদুয়ারাতে গিয়েছিলাম, সেখানে স্বেচ্ছাসেবকরা অনুরোধ জানালেন, ‘যত খুশি ঘুরে দেখুন, চাইলে দাঙ্গাপীড়িত মানুষের সঙ্গে কথাও বলুন। কিন্তু দয়া করে ছবি তুলবেন না বা কারও নাম-ধাম জিজ্ঞেস করবেন না। আমরা চাই না যাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি, তাদের ছবি কোনোভাবে বাইরে বের হোক বা পরিচয় ফাঁস হোক।’
শুধু এই একটিই নয়, দিল্লির ওই অঞ্চলে ছোট-বড় প্রায় সব গুরুদুয়ারাই দাঙ্গাপীড়িত মানুষের জন্য তাদের দরজা খোলা রেখেছে। অমৃতসরের অকাল তখতের প্রধান জ্ঞানী হরপ্রীত সিংয়ের কাছ থেকে হুকুম এসেছে, দাঙ্গার ত্রাণে শিখদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
দিল্লি শিখ গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটির (ডিএসজিএমসি) প্রধান মনজিন্দর সিং সিরসা নির্দেশ দিয়েছেন, কোনও গুরুদুয়ারাতে কেউ আশ্রয়প্রার্থী হয়ে এলে, তাকে যেভাবেই হোক জায়গা করে দিতে হবে। মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে একটু ঠাঁই দিতে হবে, লঙ্গরে খাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
বস্তুত যে গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতালে (এটিও একজন শিখ গুরুর নামাঙ্কিত) সবচেয়ে বেশি দাঙ্গাপীড়িত মানুষ ভর্তি আছেন, সেখানেও তাদের আত্মীয়স্বজনদের জন্য ডিএসজিএমসি একটি লঙ্গরখানা চালু করে দিয়েছে সেই বুধবার থেকেই।
নিহত পরিজনের লাশ বুঝে নিতে কিংবা চিকিৎসাধীন স্বজনদের খোঁজ নিতে যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাসপাতাল চত্বরে অন্তহীন অপেক্ষা করছেন, সেই লঙ্গর থেকেই তাদের পাতে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি কিংবা ডাল-রুটি তুলে দিচ্ছেন শিখ ভলান্টিয়াররা।
মনজিন্দর সিং সিরসা নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরও দিয়ে রেখেছেন, যাতে বিপদে পড়া মানুষ সরাসরি সেখানে ফোন করে সাহায্য চাইতে পারেন। ওই নম্বরগুলো যেন দাঙ্গায় অলিখিত হেল্পলাইনের কাজ করছে।
অথচ প্রায় ছত্রিশ বছর আগে দিল্লিতে শেষবার যখন এরকম ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে কিন্তু নরসংহারের বলি হয়েছিলেন এই শিখরাই।
ত্রাণ বিতরণ
১৯৮৪-র অক্টোবরের শেষ দিনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হওয়ার পর মুহূর্ত থেকে গোটা দিল্লিজুড়ে শিখদের ওপর হত্যালীলা চালানো হয়েছিল টানা চার-পাঁচদিন ধরে। শিখদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের অনেককে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বহু শিখ নারী পাশবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন।
‘দাঙ্গার ক্ষত আমাদের হৃদয় থেকে কখনও মুছে যায়নি বলেই আমরা জানি এই হিংসার আঘাত কতখানি চরম। আজ দিল্লি শহরের শিখরা যে মুসলিমদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে, তার পেছনে অবশ্যই সেই চুরাশির স্মৃতিই কাজ করেছে’, এই প্রতিবেদককে বলছিলেন পাঞ্জাবিবাগের ব্যবসায়ী রঞ্জিৎ সিং কালরা – যিনি নিজের দোকান ছেড়ে এসে গত তিনদিন ধরে মজনু-কা-টিলা গুরুদুয়ারায় দাঙ্গা ত্রাণের কাজ করছেন।
‘আর শুধু মুসলিমরাই বা বলবো কেন, আমাদের এখানে বহু হিন্দুও এসে ঠাঁই নিয়েছেন–আশ্রয় দেওয়ার আগে কখনও শিখরা জিজ্ঞেস করেননি তোমরা কোন ধর্মের’, বলছিলেন প্রবীণ ওই শিখ ব্যবসায়ী।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম হাফিংটন পোস্ট প্রকাশ করেছে গোকুলপুরী অঞ্চলের এক শিখ দোকানদার মহিন্দর সিংয়ের কাহিনি। দাঙ্গার বীভৎসতা যখন তুঙ্গে, তিনি ও তার ছেলে ইন্দরজিৎ সিং মিলে বাইক ও স্কুটিতে চাপিয়ে প্রায় শখানেক মুসলিম নারী-পুরুষ-শিশুকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।
গোকুলপুরী একটি হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকা। গত সোমবার যখন সেই এলাকার হিন্দুরা হাতেগোনা মুসলিমদের ওপর চড়াও হয়, মহিন্দর সিং ও তার ছেলে মিলে সেই আক্রান্ত মানুষগুলোকে এক কিলোমিটার দূরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা কারদামপুরীতে পৌঁছে দেন।
বাবা ও ছেলে মিলে নিজেদের মোটরবাইক ও স্কুটিতে গোকুলপুরী থেকে কারদামপুরী অন্তত কুড়িটা করে ট্রিপ দিয়েছেন–প্রতিটা ট্রিপে তারা অন্তত দুই-তিনজন মুসলিমকে পেছনে বসিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন তাদের জন্য নিরাপদ এলাকায়।
মহিন্দর সিং
শুধু তা-ই নয়, গোকুলপুরীতে ফিরে এসে মহিন্দর সিং যখন দেখেন তার মহল্লার এক মুসলিম দোকানে আগুন লাগানো হয়েছে, তখন হাইড্রেনের পাইপ খুলে নিজের হাতে জলের হোস নিয়ে তিনি সেই আগুন নেভান।
মহিন্দর সিংয়ের হিন্দু প্রতিবেশীরা এ কাজ যথারীতি ভালো চোখে দেখেননি, কিন্তু তিনি সেটাকে পাত্তাও দিচ্ছেন না।
‘চুরাশির দাঙ্গার সময় আমার বয়স ছিল মাত্র তেরো বছর। বরাতজোরে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম, হয়তো আজকের দিনটির জন্যই গুরু নানকজি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।’
‘আর আজ সেই আমি যদি কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ পাই, সেখানে থেকে কীভাবে পালিয়ে যাই বলুন তো?’, মহিন্দর সিং টেলিফোনে বলছিলেন এই প্রতিবেদককে।
শিখ ধর্মে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘নানক নাম চারদি কালা, তেরে বাহনে সারবাত দা ভালা’। সারবাত দা ভালা কথাটার অর্থ হলো সবার সমৃদ্ধি, সবার মঙ্গল।
দিল্লির এক অতি কলঙ্কিত অধ্যায়ে এই শহরের শিখরা কিন্তু সেই সবার ভালো করার মহান আদর্শকে সামনে রেখেই বিপন্ন মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার নৃশংসতার মধ্যে আজ যেন তাদের পাগড়ির রঙ আরও ঝলমল করছে, আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে!