বায়ুদূষণ, ধূলিকণা, অতিবেগুনি রশ্মি… ত্বকের শত্রুর শেষ নেই। তবে শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে নিজের ত্বকের রক্ষাকবচ তৈরি করাও সম্ভব
দূষণের ভয়ে জানালা-দরজা বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকলে তো আর চলবে না। প্রত্যেক দিন কাজের জন্য সকলকেই রাস্তায় বেরোতে হয়। আর বায়ুর কার্বনকণা, অতিবেগুনি রশ্মি থেকে শুরু করে অজস্র ক্ষতিকর পার্টিকুলেট ম্যাটার ত্বকের ক্ষতি করে। তবে এদের মোকাবিলা করার পথও আছে। তার আগে জানতে হবে, দূষণ কী ভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের ত্বকের ক্ষতি করে চলেছে। সেই পথ ধরেই রোধ করতে হবে দূষণ হানা।
ক্ষতি কখন?
বাতাসে এমন অনেক দূষণকণা বা ধূলিকণা ঘুরে বেড়ায়, যার আয়তন আমাদের ত্বকের রোমকূপের চেয়ে কম। ফলে খুব সহজেই তা ত্বকের রোমকূপে বসে, তার মুখ বন্ধ করে দেয়। ত্বকের স্বাভাবিক তেল নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ত্বকে দাগছোপ, ব্রণ, পিগমেন্টেশনের মতো সমস্যা জাঁকিয়ে বসে। ডিজ়েল, পেট্রোলের ধোঁয়া থেকে শুরু করে সিগারেটের ধোঁয়াও ত্বকের জন্য খুব ক্ষতিকর। ত্বক ভাল রাখতে যে পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট দরকার, শরীর তা পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন করতে পারে না। ফলে এই অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকেও ত্বকে বলিরেখা পরা, ইরিটেশন ইত্যাদি সমস্যার সূত্রপাত হতে থাকে। এ বার একে একে খুঁজতে হবে প্রতিকার।
ত্বকচর্চায় সচেতন হোন
ক্লেনজ়ার: দিনের শেষে বাড়ি ফিরে ডিপ পোর ক্লেনজ়িং দরকার। যদি রোজ মেন রোড দিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের সময় এক ঘণ্টা বা তার বেশি হয়, তা হলে শুধু ফেসওয়াশে সে ভাবে কাজ হবে না। প্রথমে মেকআপ রিমুভার দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করে নিন। এতে ত্বকের মেকআপ উঠে যাবে। কিন্তু মেকআপের অবশিষ্টাংশ এবং দূষণকণা ভাল ভাবে দূর করতে তার পরে ক্লেনজ়ার লাগাতে হবে। ট্রেন বা মেট্রোয় যাতায়াত করলে ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুলেও হবে।
অ্যাক্টিভেটেড চারকোল বা পাতিলেবুর নির্যাস দেওয়া কোনও ক্লেনজ়ার ভাল কাজ করে। প্রয়োজনে ক্লেনজ়িং ব্রাশ ব্যবহার করুন। এতে রোমকূপ ভাল ভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়। দিনে যত বার ধুলো-ধোঁয়ায় বেরোবেন, তত বারই মুখ ভাল করে পরিষ্কার করা জরুরি।
টোনার: ডিপ পোর ক্লেনজ়িংয়ের পরে টোনার লাগানো প্রয়োজন। এতে ত্বকের হারিয়ে যাওয়া আর্দ্রতা ফিরে আসে। আবার গোলাপজল ও গ্লিসারিন মিশিয়েও লাগাতে পারেন।
সেরাম: নিয়মিত স্কিন সেরাম ব্যবহার করা জরুরি। ভিটামিন সি বা ই সংবলিত স্কিন সেরাম ত্বকের রুক্ষ ভাব তো দূর করেই। একই সঙ্গে ত্বকে পুষ্টি জুগিয়ে সব ক্ষত পূরণ করে দেয়।
স্ক্রাবার: কফি খুব ভাল কাজ করে। তবে সপ্তাহে অন্তত তিন দিন স্ক্রাব করা জরুরি। এক দিন অন্তর স্ক্রাব করুন। এর সঙ্গে অল্প নারকেল তেলও মিশিয়ে নিতে পারেন। এতে ত্বক খুব রাফ হয়ে যাবে না। জয়িত্রী ও দারুচিনি গুঁড়োও খুব ভাল স্ক্রাবার। তবে তা সপ্তাহে এক বার ব্যবহার করতে পারেন। দারুচিনি ও জয়িত্রী স্কিন ডিটক্স হিসেবে খুব কার্যকর। তবে কারও মুখে যদি ব্রণ বড় আকার ধারণ করে বা ব্রণয় ব্যথা হয়, তা হলে সেই জায়গায় স্ক্রাবার দিয়ে ঘষবেন না। হিতে বিপরীত হতে পারে।
ফেসপ্যাক: এমন ফেসপ্যাক ব্যবহার করবেন, যা ত্বকের ক্ষত সারিয়ে সুস্থ করে তোলে। প্রত্যেক দিনই রাস্তায় বেরোতে হলে সপ্তাহে অন্তত পক্ষে দু’বার ফেসপ্যাক ব্যবহার করা জরুরি। গ্রিন টি, চালের গুঁড়ো, মধু ও পাতিলেবুর রস মিশিয়ে মাস্ক তৈরি করতে পারেন। গ্রিন টি-র অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ত্বক রিপেয়ার করতে খুব কাজে লাগে। অন্য দিকে মধু ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে। ক্লে মাস্কও খুব কার্যকর। স্ট্রবেরি বা অ্যালো ভেরার নির্যাস দিয়েও মাস্ক বানাতে পারেন। এই ধরনের মাস্ক ত্বকে সুদিং এফেক্ট দেয়।
ময়শ্চারাইজ়েশন: ত্বক পরিষ্কার করার পরে তার পিএইচ ব্যালান্স ও আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য ময়শ্চারাইজ়েশনও জরুরি। তার জন্য ডে ক্রিম মাখতে পারেন। গরমে বা রোদে বেরোলে জেল বেস্ড ডে ক্রিম মাখুন। নাইট ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন। তবে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার অন্তত আধঘণ্টা আগে নাইট ক্রিম মাখতে হবে।
ত্বক ভাল রাখার উপাদান
• অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট জরুরি। এমন প্রডাক্ট ব্যবহার করুন, যাতে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ভরপুর। অন্য দিকে কিনোয়া, অমরন্থের মতো সুপারফুড থেকে শুরু করে আর্টিচোক, রাস্পবেরি, রেড ক্যাবেজ, বিন্স, বিট, পালং শাক, গাজর, কমলালেবু, স্ট্রবেরি, পেয়ারা, আঙুর, টম্যাটো, তরমুজ ইত্যাদি রাখতে হবে রোজকার ডায়েটে।
• নিয়াসিন্যামাইড বা ভিটামিন বি থ্রি-ও ত্বক ভাল রাখতে অব্যর্থ। বি থ্রি ত্বকের কোষকে রক্ষা করে ক্ষতির হার কমায়। তাই স্কিন প্রডাক্ট কেনার সময়ে ভিটামিন বি থ্রি আছে কি না, দেখে নিন। শরীরকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন বি থ্রি-র জোগান দিতে রোজকার খাবারেও মাংস, ডিম, দুধ, হোল হুইট, টুনা, স্যামন, আলু রাখতে হবে।
• হাইড্রেশন জরুরি। দিনে অন্তত তিন থেকে চার লিটার জল খাওয়ার চেষ্টা করুন। তার সঙ্গে একটি সিট্রাস ফলের রস এবং ডিটক্স ওয়াটার যেন অবশ্যই থাকে। পাতিলেবুর রস, আদা কুচি, দারুচিনি গুঁড়ো, শসা কুচি ও পুদিনা পাতা এক বোতল জলে সারা রাত ভিজিয়ে তৈরি করে নিতে পারেন ডিটক্স ওয়াটার।
• ত্বকের সুরক্ষায় স্টিম বাথও খুব উপকারী। স্টিম নিলে রোমকূপের মুখ খুলে যায়। ফলে রোমকূপে আটকে পড়া কার্বনকণা, ধূলিকণা, মৃতকোষ সহজেই বেরিয়ে আসে। ত্বক থাকে পরিষ্কার।
• অনেকে বাড়িতেও সারা দিন ভারী ময়শ্চারাইজ়ার মেখে থাকেন। তা কিন্তু সব সময়ে ঠিক নয়। সারা সপ্তাহে ত্বকের উপরে যা অত্যাচার চলে, মনে রাখতে হবে ত্বকের যত্ন নেওয়ার সময়ে তাকে যথাসম্ভব বিশ্রাম দিতে হবে। তাই বাড়িতে থাকাকালীন ত্বকে ভারী কিছু না মাখাই ভাল। এতে ত্বক অক্সিজেন পাবে। দূষণের কার্বনকণা ত্বকের যা ক্ষতি করে, তা সারাতে অক্সিজেন খুব জরুরি।
অতিবেগুনি রশ্মি, বায়ুদূষণ, ধূলিকণা… সবে মিলে ত্বকের বারোটা বাজার উপাদান কম নেই। তাই খুব যত্নে তাকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। সঙ্গে জরুরি চারপাশের পরিবেশ দূষণও কমানো। যে হাওয়ায় আমরা শ্বাস নিচ্ছি, তা শুদ্ধ রাখতে যেটুকু করণীয়, সেটাও করতে হবে। তবেই কিন্তু সমূল এই দূষণ রোধ করা সম্ভব।