তাজুদ্দিন আহ্মেদ
জার্মান দার্শনিক নিট্শে বলেছিলেন স্মৃতির কর্মপ্রক্রিয়া বড় বিস্ময়কর। সময়ের গ্রন্থি থেকে ঝরা পাতার মতো ভেসে এসে বর্তমানের স্থিতিকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আজ যখন খবরের কাগজ, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন থেকে উড়ে আসছে দিল্লির সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের খবর, আমার মনে পড়ল সৈয়দ আখতার মির্জা পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘নসিম’-এর কথা। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ছবিতে আমরা দেখি উদার, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক মুসলিম পরিবারের তিন প্রজন্মকে। নসিমের দাদাজান, শয্যাশায়ী বৃদ্ধ বিশ্বাস করেন যে ভারতবর্ষের মতো দেশে মসজিদের ওপর বর্বরোচিত কোনও আক্রমণ হবে না। নসিমের আব্বাজান রয়েছেন সময়-প্রসূত আশঙ্কা এবং সংশয়ের দোলাচলে। নসিমের বড় ভাই এবং তার বন্ধুরা মনে করে এই দেশে মুসলিমদের কোনও কিছুই আর সুরক্ষিত নয়, সে মসজিদ হোক বা ঘর। ছবির শেষে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের খবর আসার ঠিক আগে মারা গেলেন হাতে হাত রাখা সহাবস্থানের শক্তিতে বিশ্বাসী বৃদ্ধ; অস্ত্র হাতে প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু করল তরুণ প্রজন্ম।
আজ এই বিবর্ণ সময়ে যখন ‘সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে’, আমি বোঝার চেষ্টা করি ভারতীয় মুসলিম মানুষজনের আশঙ্কা এবং অসহায়তার প্রকৃতিকে। নিঃসন্দেহে, সম্প্রদায়ের বড় অংশই এখন সংশয়দীর্ণ। বদলে যাওয়া এই দেশকে নিজের বলে চিনতে কষ্ট হচ্ছে তাঁদের। নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চিতের আশঙ্কা তাঁদের গ্রাস করেছে। খানিকটা যেন নসিমের আব্বাজানের মতোই। অল্প কিছু মানুষ হয়তো ক্রোধের আগুনে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের দিশা খুঁজছেন। কিন্তু কোথায় আছেন, কেমন আছেন সেই সব মুসলিম মানুষজন, যাঁরা চিরকাল সহাবস্থানের উষ্ণতায় খুঁজে পেয়েছেন বেঁচে থাকার রসদ, যাঁদের প্রাত্যহিকতাকে সিঞ্চিত করেছে হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের আচার ও অভ্যাস? কাঁধে কাঁধ আর পায়ে পা মিলিয়ে বহু হাজার মাইল পেরোবার পর যদি তাঁরা দেখেন সামনে পথটিই মুছে গিয়েছে, তবে তাঁরা কি ‘অন্ধকারে হেমন্তের অবিরল পাতার মতো’ ঝরে যেতে চাইবেন, না কি আরও এক বার অর্ঘ্য দেবেন বিশ্বাসের বেদিতে?
এইখানেই আমি নিজেকে প্রশ্ন করি (আর তো কেউ নেই যিনি আমার প্রশ্ন শুনবেন)— আর কত পরীক্ষায় বসতে হবে আমাদের? ব্যক্তিজীবনে তো রোজ হাজার ভ্রুকুঞ্চনের মুখোমুখি হয়ে থাকি আমরা। সংখ্যাগরিষ্ঠের পাড়ায় বাড়ি ভাড়া খুঁজতে গেলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ হতে দেখি; প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচের দিন অপ্রীতিকর প্রশ্নের ভয়ে ঘর থেকে বার হই না; পুত্র বা কন্যা যখন নামী স্কুলে সহপাঠীদের কাছে শুনে আসে যে তারা আসলে পাকিস্তানি, তাকে ছদ্ম সান্ত্বনা দিই। নিত্যদিনের এই সব নিঃশব্দ রক্তক্ষরণ তো আমরা মেনে নিয়েছি দেশে থাকা, দেশকে ভালবাসার মূল্য হিসেবে। কিন্তু তার পরেও গোষ্ঠী হিসেবে মুখোমুখি হচ্ছি নিত্য নতুন আঘাতের।
পরিস্থিতি জটিল হয়েছে কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর। কেন্দ্রের শাসক দলের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে ঘটেছে একের পর এক ঘটনা যেগুলিতে বিপন্ন হয়েছে আমাদের জীবন, জীবিকা এবং সংস্কৃতি। খাদ্যাভ্যাসের ওপর নেমে এসেছে নিষেধাজ্ঞা। গোরক্ষকদের তাণ্ডবে কত মুসলিম মানুষের যে প্রাণ গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে ‘মব লিঞ্চিং’। প্রতি ক্ষেত্রেই হিংসার বলি হয়েছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। ইদের বাজার করে ফেরা মুসলিম কিশোরকে বন্ধুদের সামনেই ছুরিকাঘাতের পর ছুড়ে ফেলা হয়েছে ট্রেন থেকে। ইতিহাস নতুন করে লেখার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে মুছে ফেলা হচ্ছে সব রকম মুসলিম অনুষঙ্গ। নির্বাচনী প্রচারে অনায়াসেই ব্যবহৃত হচ্ছে তীব্র মুসলিম বিদ্বেষী স্লোগান। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পোশাক দেখে চিহ্নিত করছেন অপরাধীকে।
এত শত অত্যাচার এবং অবিচারের প্রতিকার হিসেবে আমরা, ভারতের মুসলমান সমাজ, আইনেরই দ্বারস্থ হয়েছি। প্রায় কখনওই আইনের বেড়া ডিঙিয়ে ন্যায় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করিনি। তাই রায় বিপক্ষে যাওয়া সত্ত্বেও রামমন্দির নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ শান্তিপূর্ণ ভাবে মেনে নেওয়ার চিহ্ন দেখা গিয়েছে। আর এখন এই সবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জি। নাগরিকত্ব হারাবার ভয় তীব্র ভাবে সঞ্চারিত হয়েছে মুসলমান সমাজের মধ্যে। আমরা সংবিধান মেনেই গণতান্ত্রিক পথে প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমেছি। আন্দোলনে আমাদের পাশে নেমে এসেছেন অন্য সম্প্রদায়ের বন্ধুজনেরাও।
এই সমস্ত উদাহরণ খেয়াল করলে সাধারণ বোধসম্পন্ন যে কেউ বুঝতে পারবেন যে ভারতীয় জনতা পার্টি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর এক দিকে যেমন মুসলিমদের ওপর অবিচার বেড়েছে শত গুণে, অন্য দিকে সেই অবিচারের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিমেরা দেখিয়েছেন যথেষ্ট বিচক্ষণতা, বাস্তববোধ; এড়াতে পেরেছেন বহু রকম প্ররোচনা। এতৎসত্ত্বেও যখন মুসলিম মহিলাদের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী জমায়েতে গিয়ে বিজেপি নেতা হুঁশিয়ারি দিয়ে আসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শুরু হয় উল্লিখিত আইনের সমর্থক এবং বিরোধীদের মধ্যে লড়াই এবং তা দ্রুত পরিণত হয় রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, তখন অসহায় হতাশায় মুখ ঢেকে ফেলা ছাড়া বোধ হয় আর কিছু করণীয় থাকে না আমাদের। আমাদের চোখের সামনে মিছিলের মতো অভিনীত হয়ে চলে দুঃস্বপ্ন— আগুনে ছারখার হয়ে যাওয়া বাড়ি, আহত রক্তাক্ত মানুষের দিগ্বিদিকশূন্য দৌড়, সন্তানহারা মায়ের উথালিপাথালি কান্না। তরতর করে মসজিদের মিনার বেয়ে তার চূড়ায় উঠে যায় তরুণ; লাগিয়ে দেয় গেরুয়া পতাকা। আমাদের মনে করিয়ে দেয় কয়েক দশক আগের ৬ ডিসেম্বরের আর এক দৃশ্যকে, যার অভিঘাতে চিরকালের জন্য বদলে গিয়েছিল দেশের বহু মানুষের জীবন, তাদের মধ্যে সিংহভাগ ছিলেন মুসলমান। এই ভাবে যখন আমাদের প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে এই ভূমির হকদার আমরা নই, তখন সহাবস্থান এবং সহমর্মিতার আশা অনেকের কাছেই শুধু ‘মিছে ছলনা’ বলেই বোধ হয়।
অথচ আমরা জানি, দেখি, বিদ্বেষের ঘন অন্ধকারেও টুকরো টুকরো আলো জ্বলে আছে। দাঙ্গার লেলিহান শিখার মধ্যেও চোখে পড়ে বিপন্ন হিন্দু প্রতিবেশীকে যিনি নিজের প্রাণ বাজি রেখে দরজা খুলে দিয়েছেন, দলিতেরা রাত জেগে মুসলিমদের ঘর পাহারা দিয়েছেন, সম্প্রদায় নির্বিশেষে গুরুদ্বারে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছেন গৃহহারা মানুষ। মানবিকতা এবং শুভবুদ্ধির ওপর বিশ্বাস রাখতে ইচ্ছে করে আরও এক বার। স্মৃতির কোটর থেকে ভেসে আসে শত বছরের নৈকট্যের ওম; ইদ-দুর্গোৎসবের ভাগ করে নেওয়া খুশি, প্রিয়জনের জানাজায় পা মেলাবার বেদনা। প্রতীতি হয়— এই লড়াইয়ে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন আরও অনেকে, যাঁদের ধর্মীয় পরিচয় আলাদা, কিন্তু মানবতার বিনিসুতোয় আমরা একসঙ্গে বাঁধা আছি।
তা ছাড়া ‘নিবিড়-তিমির-আঁকা’ এই দুঃসময়ে অবসন্ন ডানা গুটিয়ে ফেলার তো সত্যিই কোনও অবকাশ নেই। এই ভূমিখণ্ডটুকুই তো আমাদের শৈশবের খেলাঘর, যৌবনের উপবন আর বার্ধক্যের বারাণসী। আমার তাই মনে পড়ে নসিমের আব্বাজানের প্রশ্নে তার দাদাজানের দেওয়া উত্তর, দেশভাগের সময় তিনি এই দেশ ছেড়ে যাননি কারণ বাড়ির একটি গাছ তাঁর স্ত্রীর বড় প্রিয় ছিল! বড় প্রিয় এই ভূমি, আমার ভূমি! তাই বিশ্বাসের ডানায় ভর করে উড়ে চলতেই হবে; পাখা ক্লান্ত হলে তার শুশ্রূষার দায়িত্ব নিশ্চয় নেবেন কোনও হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান বন্ধু।