কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ একটি পৌরাণিক যুদ্ধ মহাভারতে যার বর্ণনা আছে। একই পরিবার উদ্ভূত পাণ্ডব ও কৌরব শিবিরের মধ্যে। এই যুদ্ধের বাণী হলো ধর্মের জয় ও অধর্মের বিনাশ। পাণ্ডবরা ন্যায়, কর্তব্য ও ধর্মের পক্ষ। অন্যদিকে কৌরবরা অন্যায়, জোর-জবরধস্তি ও অধর্মের পক্ষ। কথিত আছে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ - ৫৫০০ অব্দে [আজো ভারতে কলিযুগাব্দ বলে একটি কাল গণনা প্রচলিত আছে। কারো করো মতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরেই ঐ কাল গণনা আরম্ভ হয়। অথবা কৃষ্ণের মৃত্যুর পর থেকে] বর্তমান ভারতের হরিয়ানায় এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ১৮দিন।
কাহিনী
এ যুদ্ধের কাহিনীর শুরু রাজসিংহাসনের অধিকার নিয়ে। পিতৃসত্য পালনের স্বার্থে শান্তনুর পুত্র দেবব্রত আজীবন বিবাহ করেন নি, রাজসিংহাসনে বসেন নি। এবম্বিধ প্রতিজ্ঞার কারণে দেবব্রতর নাম হয়েছিল ভীষ্ম। ভীষ্ম রাজদণ্ড গ্রহণ না করায় তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্য রাজ্য পরিচালনা করতেন। বিচিত্রবীর্যের দুই পুত্রের নাম ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু।, বিচিত্রবীর্যের উত্তরাধিকারী ছিলেন জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু তিনি ছিলেন জন্মান্ধ। বিচিত্রবীর্যের পর সিংহাসন আরোহণ করেন পাণ্ডু। কিন্তু পাণ্ডুর অকালমৃত্যু হলে প্রশ্ন ওঠে কে হবে পরবর্তী রাজা : পাণ্ডুর পুত্র, না ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র। এই প্রশ্ন ঘিরে পারিবারিক বিবাদ নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পর্যবসিত হয় এবং যুদ্ধে জয়ী হয় পাণ্ডব পক্ষ। রাজদণ্ড লাভ করেন পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির। এ যুদ্ধে ধৃতরাষ্টের জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধন সহ একশত পুত্রের জীবনাবসান হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শ্রীকৃষ্ণ অস্র ধারণ করেনি তবে তিনি পাণ্ডবদের পক্ষে অর্জুনের যুদ্ধরথের সারথী হন। আবার অন্য দিকে কুরুপক্ষকে তিনি নারায়ণী সেনা দিয়ে সাহায্য করেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম কৌরব সেনাবাহিনীর সেনাপতি নিয়োজিত হন। কর্ণ দ্রৌপদীর সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করেছিলেন এই অভিযোগে ভীষ্ম কর্ণকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধা দেন। আসলে তিনি কুন্তীর কন্যাবস্থায় পুত্রলাভের কথা জানতেন। তিনি চান নি কর্ণ আপন ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুক। যুদ্ধের একাদশতম দিনে ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত হন এবং ত্রয়োদশ দিনে দ্রোণ সেনাপতি হন। চতুর্দশ দিন শেষ হয় চক্রব্যূহে অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর মৃত্যু দিয়ে।
যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
প্রথম দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন বিরাটরাজের পুত্র শ্বেত। এই দিনের যুদ্ধে পাণ্ডব পক্ষে ভীম ও কৌরব পক্ষে ভীষ্ম বীরত্ব প্রদর্শন করে পরস্পরের বহু সৈন্য হত্যা করেন। এই দিনের যুদ্ধে অর্জুন পুত্র অভিমন্যু অমিত বিক্রম প্রদর্শন করেন। ইনি একই সাথে ভীষ্ম, কৃতবর্মা, কৃপাচার্য ও শল্যের সাথে যুদ্ধ করেন। মদ্ররাজ শল্যের আক্রমণে বিরাটরাজের পুত্র উত্তর পরাজিত ও নিহত হন। এই মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বিরাটের অপর পুত্র শ্বেত ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রবলভাবে যুদ্ধ শুরু করেন। অশেষ বীরত্ব প্রদর্শনের পর ভীষ্ম কর্তৃক ইনি নিহত হন।
দ্বিতীয় দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। এই দিনের যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ভীষ্ম-অর্জুনের যুদ্ধ। প্রবল যুদ্ধের পরও কেউ জয়ী হতে সক্ষম হলেন না। এদিন ভীম কলিঙ্গরাজ শ্রুতায়ু, তাঁর পুত্র শত্রুদেব ও কেতুমান, ভানুমান, সত্য, সত্যদেব ও বিপুল সংখ্যক কলিঙ্গ সৈন্য হত্যা করেন। এরপরে ভীষ্ম ও ভীমের যুদ্ধ হয়। এ ছাড়া এদিনে অভিমন্যু, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও অর্জুন অশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এই দিন কৌরব পক্ষে ভীষ্ম ছাড়া আর কেউ তেমন বীরত্ব প্রদর্শন করতে পারেন নি।
তৃতীয় দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। এদিন ভীমের সাথে যুদ্ধে দুর্যোধন পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। এছাড়া অর্জুন ও ভীষ্মের অশেষ বীরত্ব লক্ষ্যণীয়। এদিন ভীষ্মের প্রচন্ড সংহারমূর্তি দেখে তার প্রতি ক্রোধবশত কৃষ্ণ সুদর্শন চক্র উত্তোলন করেও পরে ভীষ্মের তোষণ ও অর্জুনের অনুরোধে তা প্রত্যাখ্যান করে নেন।
চতুর্থ দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। এই দিনে ধৃষ্টদ্যুম্ন শল্যপুত্র সাংযমনিধিকে হত্যা করেন। ভীমের অসীম বীরত্ব প্রদর্শনের কারণে কৌরব সৈন্যের একাংশ পলায়ন করে। পরে ভীষ্ম ভীমের গতিকে রোধ করতে সক্ষম হন। এরপর ভীমের সাথে দুর্যোধনের যুদ্ধ হয়। দুর্যোধনের শরাঘাতে ভীম সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। পরে সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে ভীম পুনরায় আক্রমণ করলে শল্য আহত হয়ে রণক্ষেত্র পরিত্যাগ করেন। এরপর ধৃতরাষ্ট্রের ১৪ জন পুত্র একসাথে আক্রমণ করলে- ভীম জলসন্ধ, সুষেণ, উগ্র, অশ্ব, কেতু, বীরবাহু, ভীম ও ভীমরথকে হত্যা করেন। ধৃতরাষ্ট্রের অন্যান্য পুত্ররা পরে পালিয়ে যায়।
পঞ্চম দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। এদিনে যুদ্ধে উভয় পক্ষে বহু সৈন্য নিহত হলে- বড় কোন বীরের পতন হয়নি।
ষষ্ঠ দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। নকুলের পুত্র শতানীক ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুষ্কর্ণকে হত্যা করেন।
সপ্তম দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। দ্রোণ কর্তৃক বিরাট পুত্র শঙ্খ নিহত হন। এ দিনে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বড় বড় কিছু যোদ্ধা প্রাণে রক্ষা পেলেও পরাজিত হন। এঁরা হলেন-ভীমের পুত্র ঘটোত্কচ : ভগদত্তের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন। শল্য : নকুল সহদেবের কাছে পরাজিত। শ্রুতায়ু : যুধিষ্ঠিরের কাছে পরাজিত।
অষ্টম দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। ভীম ও ভীষ্মের যুদ্ধে ভীষ্মের সারথি নিহত হয়। এরপর ভীম ধৃতরাষ্ট্রের সুনাভ নামক পুত্রকে হত্যা করেন। এরপর ধৃতরাষ্ট্রের অন্যান্য পুত্ররা তাঁকে একযোগ তীব্রভাবে আক্রমণ করলে ইনি তা প্রতিহত করতে করতে- ধৃতরাষ্ট্রের সাত পুত্রকে হত্যা করেন। অর্জুন পুত্র ইরাবান শকুনির ছয় ভাইকে হত্যা করেন। পরে আর্যশৃঙ্গের হাতে ইরাবান নিহত হন। এই ছিল প্রথম কোন পাণ্ডব বীরের পতন। এরপর দুর্যোধন বিদ্যুজ্জিহবকে হত্যা করেন। ভীম ধৃতরাষ্টের অনাধৃষ্য, কুণ্ডভেদী, বৈরাট, বিশালাক্ষ, দীর্ঘবাহু, সুবাহু ও কনকধ্বজ নামক পুত্রদের হত্যা করেন।
নবম দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। এই দিনে অভিমন্যুর কাছে অলম্বুষের পরাজয়ই হল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দ্বিতীয় ঘটনা যুধিষ্ঠিরের কাছে ভীষ্ম তাঁর নিজের মৃত্যুর উপায় কথন।
দশম দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। অর্জুন বিদেহসহ বহু সৈন্যকে হত্যা করেন। যুদ্ধে দুঃশাসন, কৃপ প্রভৃতি বীর পলায়ন করেন। ভীষ্ম শতানীককে হত্যা করেন। ভীষ্ম মহাপরাক্রমশালী বীর। তিনি হাতে ধনুর্বাণ থাকলে অবধ্য। কিন্তু শিখন্ডী যিনি পূর্বজন্মে মেয়ে ছিলেন তার প্রতি ভীষ্ম অস্ত্র তুলবেননা এটা পান্ডবরা জেনে যায়। শিখন্ডী কে সামনে রেখে অর্জুন অজস্র শর দ্বারা ভীষ্মকে এমনভাবে বিদ্ধ করেন যে- ভীষ্মের দেহ মাটি স্পর্শ করলো না। ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করে রইলেন। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা মৃত্যু ছিল বলে তাঁর সেদিন মৃত্যু হয় নি।
একাদশ দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন দ্রোণাচার্য। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। দ্রোণাচার্য কর্তৃক পাঞ্চালরাজকুমার ও ব্যাঘ্রদত্তকে হত্যা করেন।
দ্বাদশ দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন দ্রোণাচার্য। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। অর্জুন কর্তৃক সুধন্বা, মালব, মাবেল্লক, ললিত্থ, ত্রিগর্ত, নিহত হন।
ত্রয়োদশ দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন দ্রোণাচার্য। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। দ্রোণাচার্যের কাছে সত্যজিত, শতানীক, দৃঢ়সেন প্রমুখ বীরগণ পরাজিত ও নিহত হন। অর্জুন সংশপ্তক সুশম্মার ভাইদের হত্যা করেন। ভগদত্তের শরে অর্জুনের মুকুট পড়ে যায়। ভগদত্ত অর্জুনের উদ্দেশ্যে বৈষ্ণবাস্ত্র নিক্ষেপ করলে কৃষ্ণ তা নিজ বক্ষে বরণ করে নেন। উক্ত অস্ত্র কৃষ্ণের গলায় বৈজয়ন্তীমালায় রূপ লাভ করে। পরে অর্জুন তাঁকে হত্যা করেন। এরপর অর্জুন সুবলনন্দন বৃষক ও অচল, শত্রুঞ্জয়সহ কর্ণের ভাইদের হত্যা করেন। নকুল কর্তৃক ভূতকর্মা নিহত হন। ভীম কর্তৃক অঙ্গনৃপতি নিহত হন। অশ্বত্থামা কর্তৃক নীল নিহত হন। দ্রোণাচার্য কর্তৃক চক্রবুহ্যরচনা। অভিমন্যু’র উক্ত ব্যুহভেদ করে শল্যের ভাইদের, রুক্সরথ, লক্ষ্মণ ক্রাত্থ, বৃক্ষারক, বৃহদ্বল, অশ্বকেতু, চন্দ্রকেতু, সৌবলগণ সহ বহু বীর ও সৈন্য হত্যা করেন। পরে ছয় মহারথী অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করে অভিমন্যুকে পরাজিত করেন। জয়দ্রথ তাঁকে হত্যা করেন।
চতুর্দশ-পঞ্চদশ দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন দ্রোণাচার্য। পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। অর্জুন অভিমন্যু হত্যার প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করেন। এই দিনের যুদ্ধের প্রকৃতি মূলত জয়দ্রথ হত্যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এদিনের যুদ্ধে শ্রুতায়ুধ নিজ গদা দ্বারা নিহত হন। এরপর অর্জুন সুদক্ষিণ, শ্রুতায়ুকে হত্যা করেন। এর মধ্যে রাজা বৃহত্ক্ষেত্র হত্যা করেন ক্ষেত্রমধুকে এবং চেদিরাজ ধৃষ্ঠকেতু হত্যা করেন বীরধন্বাকে। এরপর সহদেব হত্যা করেন নিরমিত্রকে। এরপর দ্রৌপদীর সন্তানরা সৌমদত্তিকে হত্যা করেন। ভীমের পুত্র ঘটোত্কচ হত্যা করেন অলম্বুষকে। এক্ষেত্রে পাণ্ডবপক্ষ লাভবাণ হয়। যুদ্ধের এই পর্যায়ে দ্রোণাচার্য হত্যা করেন পাঞ্চাল-কৈকয়ী বীরদের। অর্জুনকে সাহায্য করার জন্য সাত্যকি অগ্রসর হয়ে বহু কৌরব সৈন্য হত্যা করেন। বিশেষ করে ইনি হত্যা করেন জলসন্ধ, সুদর্শন, পাঁচশ ত্রিগর্তবীরকে। অবশেষে অর্জুন-সাত্যকি মিলিত হন। বিকেলের দিকে দ্রোণ বৃহত্ক্ষত্র, ধৃষ্টকেতু, চেদিবীরদেরকে হত্যা করেন। এরপর সাত্যকি ও অর্জুনের সমবেত চেষ্টায় ভুরিশ্রবা নিহত হন। দিনশেষে অর্জুন জয়দ্রথকে হত্যা করেন কৃষ্ণের কৌশলে। এই দিনের যুদ্ধ রাত্রি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। রাতের যুদ্ধে ভীম কলিঙ্গরাজের পুত্র ও দুর্যোধনের দুই পুত্রকে হত্যা করেন। অশত্থামা অঞ্জনপর্বা ও সুরথাকে হত্যা করেন। এই সময় ভীম বাহ্লীককে আর সাত্যকি সোমদত্ত ও ভুরিকে হত্যা করেন। এরপর শল্য শতানীককে, ধৃষ্টদ্যুম্ন ধ্রুমসেনকে, ঘটোত্কচ অলম্বল ও অলায়ুধকে হত্যা করেন। এই রাত্রে কর্ণ ঘটোত্কচকে হত্যা করেন। এরপর দ্রোণ বিরাট ও দ্রুপদকে হত্যা করেন। অশ্বত্থামা হত প্রচার দ্বারা দ্রোণ কাতর হলে- ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে হত্যা করেন।
ষোড়শ দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন কর্ণ। পাণ্ডব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। যুদ্ধের শুরুতেই ভীম ক্ষেমধুর্তিকে, সাত্যকি বিন্দ-অনুবিন্দকে, শ্রুতকর্মা চিত্রসেনকে, অর্জুন সংশপ্তকদের ও দণ্ডাধরকে হত্যা করেন। এই অবস্থায় অশ্বত্থামা পাণ্ডবপক্ষীয় পাণ্ড্যকে হত্যা করেন।
সপ্তদশ দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন কর্ণ। পাণ্ডব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। এই দিনের যুদ্ধে কর্ণ ভানুদেব, চিত্রসেন, সেনাবিন্দু, তপন, শূরসেন, চন্দ্রধর, দণ্ডাধর, জিষ্ণুকে হত্যা করেন। ভীম ভানুসেন, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদেরকে হত্যা করেন। কৃপ সুকেতুকে হত্যা করেন। এরপর কর্ণ ভার্গবদত্ত অস্ত্র প্রয়োগে অসংখ্য পাণ্ডবসৈন্য হত্যা করেন। এরপর উত্তমৌজা কর্ণ-পুত্র সুষেণকে, কর্ণ বিশোককে সাত্যকি প্রসেনকে হত্যা করেন। এরপর ভীম দুঃশাসনকে হত্যা করে তার রক্ত পান করেন।
যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথমে যুধামন্য চিত্রসেনকে হত্যা করেন। পরে ভীম নিষঙ্গিবীরদেরকে, অর্জুন কর্ণপুত্র বৃষসেনকে হত্যা করেন। এরপর অনুষ্ঠিত হয় মহাভারতের অন্যতম কর্ণার্জুন যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রথমাবস্থায় কর্ণ কোনক্রমেই অর্জুনের উপর প্রাধান্য বিস্তার না করতে পেরে নাগাস্ত্র নিক্ষেপ করেন। এই অস্ত্রে অশ্বসেন যোগবলে প্রবেশ করলেও কৃষ্ণের সহায়তায় অর্জুন রক্ষা পান। তবে এই অস্ত্রের আঘাতে অর্জুনের মুকুট ধ্বংস হয়। এরপর অশ্বসেন নাগাস্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে অর্জুনকে আক্রমণ করতে গেলে অর্জুনের অস্ত্রাঘাতে নিহত হন। এরপর অর্জুনের তীব্র আক্রমণে কর্ণ জ্ঞান হারিয়ে ফেললে- অর্জুন তাঁকে অসুস্থ জ্ঞানে হত্যা করলেন না। কিন্তু কৃষ্ণের উত্সাহে তিনি পুনরায় কর্ণকে আক্রমণ করেন। কর্ণ সংজ্ঞালাভের পর আবার যুদ্ধ শুরু করেন। অবশেষে অর্জুন কর্ণকে হত্যা করেন অসহায় অবস্থায়। কর্নের রথচক্র মাটিতে গেঁথে যায়,তা তোলার সুযোগ দিতে চাইলেও কৃষ্ণ উপদেশ দেন কর্নকে হত্যা করতে। কর্ণের মৃত্যর পর কৌরব পক্ষের সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন শল্য। এরপর পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
অষ্টাদশ দিন কৌরব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন শল্য। পাণ্ডব পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। যুদ্ধের প্রথম দিকেই নকুল কর্ণপুত্র-চিত্রসেন, সত্যসেন ও সুষেণকে হত্যা করলেন। এরপর দুর্যোধন চেকিতানকে, অশ্বত্থামা সুরথকে এবং যুধিষ্ঠির শল্য ও শল্যের ভাইকে হত্যা করলেন। এরপর সাত্যকি শ্বাল্য ও ক্ষেত্রকীর্তিকে, সহদেব উলূক ও শকুনিকে হত্যা করেন।
এরপর দুর্যোধনের পক্ষের অধিকাংশ সৈন্য নিহত হওয়ায়- দুর্যোধন ভীত হয়ে হ্রদে আত্মগোপন করেন। পাণ্ডবরা কিছু শিকারীর মুখে এই সংবাদ শুনে উক্ত হ্রদের কাছে আসেন। এরপর ভীমের সাথে দুর্যোধনের গদাযুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ভীম দুর্যোধনের উরু ভেঙে দেয় এবং মাথায় গদার আঘাত করে। পরে দুর্যোধনের মৃত্যু হয়।
‘ক্ষুদ্র’ চরিত্রসমৃহের ঔদার্য
• অর্জুন এবং নাগ রাজকন্যা উলুপীর পুত্র ইরাবানের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই যুদ্ধে। ইরাবান তাঁর পিতা অর্জুনের বিজয়কে সুনিশ্চিত করতে নিজেকে মা কালীর কাছে উৎসর্গ করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, তিনি বিবাহ করবেন। এমন এক কন্যা পওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে, যিনি ভাবী স্বামীর অবধারিত মৃত্যুর কথা জেনেও তাঁকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক। এমন পরিস্থিতিতে কৃষ্ণ এক সুন্দরী নারীতে নিজেকে পরিণত করেন এবং ইরাবানকে বিবাহ করেন। শুধু তা-ই নয়, ইরাবানের মৃত্যুর পরে তিনি বৈধব্য পালনও করেছিলেন।
• পঞ্চম পাণ্ডব সহদেব জ্যোতিষ বিদ্যায় পারঙ্গম ছিলেন। তিনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিসেবে সিদ্ধিলাভ করেন। এ কারণে দুর্যোধন এবং শকুনি সহদেবের কাছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রকৃত সময় জানতে চান। দুর্যোধন তাঁদের পরম শত্রু জেনেও সহদেব সততার সঙ্গে তাঁকে সেই ক্ষণটি আগাম জানিয়ে দেন। কিন্তু সহদেব তাঁর ভ্রাতাদেরকেই এই তথ্য জানাতে পারেননি। কারণ তাঁকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল— তিনি যদি স্পষ্টভাষায় ভবিষ্যকথন করেন, তাঁর মৃত্যু হবে। কৃষ্ণের পরামর্শে সহদেব প্রশ্নের আকারে ভবিষ্যৎ ব্যক্ত করতেন।
• আসন্ন যুদ্ধে কৃষ্ণের সহায়তা পাওয়ার জন্য দুর্যোধন সবার আগে দ্বারকা যান। অর্জুন তখনও পৌঁছননি। কৃষ্ণের কক্ষে প্রবেশ করে দুর্যোধন তাঁকে ঘুমন্ত দেখেন আবং তাঁরা মাথার কাছে রাকা একটি সিংহাসনে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরে অর্জুন সেখানে প্রবেশ করেন এবং তিনি কৃষ্ণের পায়ের কাছে আসন গ্রহণ করেন। জেগে উঠে কৃষ্ণ অর্জুনকেই প্রথম দেখেন। এবং তাঁর পক্ষে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। দুর্যোধন ক্ষুণ্ন হন। কৃষ্ণ তাঁকে আশ্বাস দেন তাঁর অধীনস্থ নারায়ণী সেনা কৌরব পক্ষেই ষুদ্ধ করবে।
• কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব পক্ষে প্রায় কেউই জীবিত থাকেননি। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের এক কানীন পুত্র যুযুৎসু পাণ্ডব পক্ষে যোগ দেন। কারণ তাঁর সৎ ভাইরা তাঁরা জন্মবৃত্তান্ত তুলে তাঁকে অপমান করতেন। তিনি সদ্ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি কৌরবদের ত্যাগ করে পাণ্ডব শিবিরে চলে আসেন। ধৃতরাষ্ট্র-তনয়দের মধ্যে তিনিই একমাত্র যুদ্ধে মারা যাননি। পরে তিনিই পরিক্ষিতের অভিভাবক হন।
• যুদ্ধের চতুর্দশতম দিনে ভীম ও অর্জুন জয়দ্রথ বধে উদ্যোদী হন। সূর্যাস্তের আগে অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করার সংকল্প করেন। এমন সময়ে দুর্যোধন তাঁর ভাই বিকর্ণকে পাঠান ভীমের উপরে নজর রাখার জন্য। বিকর্ণ ধর্মপথ ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন না। তিনিই ছিলেন কৌরব ভাইদের ভেতর ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ। তা ছাড়া তিনি জানতেন, যথা কৃষ্ণ তথা জয়। তিনি পাণ্ডবদের সমর্থন করলেও কৌরব পক্ষ ত্যাগ করে পারেননি। ভীম বিকর্ণকে দেখতে পান। তিনি জানতেন, দ্রৌপদীর অপমানের সময়ে বিকর্ণই একমাত্র প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু বিকর্ণের অনুরোধেই তিনি তাঁর সঙ্গে গদাযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভীম বিকর্ণকে বধ করেন। কারণ তিনি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের নিশ্চিহ্ন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।