বধিরদের জন্যে বিশ্বের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালাডেট ইউনিভার্সিটি।
ওয়াশিংটন ডিসির এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৮ সালে শুরু হয়েছিলো বড় ধরনের এক আন্দোলন। কানে শুনতে পান এরকম একজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের তুমুল আন্দোলনের কারণে কর্তৃপক্ষকে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে শেষ পর্যন্ত একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করতে হয়।
বলা হয়ে থাকে, আমেরিকায় এই আন্দোলনের ঘটনা বধির মানুষদের প্রতি সারা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলো।
আন্দোলন শুরু হয় যেভাবে
বধির নন এমন এক ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট মনোনীত করার পর শুরু হয় এই আন্দোলন।
প্রথমদিকে ‘একজন বধিরকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চাই’- এই শ্লোগান আর হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল করতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা।
ক্যাম্পাসে ব্যারিকেডও তৈরি করে তারা । বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লোকজনের প্রবেশে বাধা তৈরি করে তারা ।
আন্দোলন চলে কয়েকদিন ধরে।
আর গ্যালাডেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বধির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন যিনি তার নাম কিং জর্ডান। তিনি ছিলেন আর্টস এন্ড সায়েন্সেস বিভাগের ডিন। এই ক্যাম্পাসে তিনি কাটিয়েছেন কয়েক দশক- প্রথমে একজন ছাত্র এবং পরে শিক্ষক হিসেবে।
এক মোটরবাইক দুর্ঘটনায় তিনি তার শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
ওই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “সারাদিন ধরেই এই আন্দোলন চলেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছিলো এই আন্দোলনের খবর। টানা সাত দিন ধরে এই খবরটি ছিলো পত্রিকার পাতায়।”
এই গ্যালাডাট বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বধির কিংবা কানে খাটো। একে অপরের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেন ইশারা ভাষার মাধ্যমে।
একসময় এই ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্টের পদ খালি হলো। কিং জর্জ মনে করলেন, এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন বধিরকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার সুযোগ তৈরি হলো।
তিনি এই পদের জন্যে আবেদন করলেন এবং শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে এলো তার সমর্থনে।
“ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনের জানালায় ব্যানার টাঙিয়ে দিল। এমনকি বিছানার চাদর ঝুলিয়ে তারা সেখানে লিখে দিলো - ‘আমরা একজন বধির প্রেসিডেন্ট চাই।’ ফলে বোর্ডের কাছে বার্তাটা খুবই পরিষ্কার ছিল,” বলেন তিনি।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকেও চাপ আসতে লাগলো। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়রও চিঠি লিখলেন বোর্ডের কাছে ।
চিঠিতে তিনি লিখলেন, “গত দুই দশক ধরে আমাদের সমাজে বিপ্লবাত্মক কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। কংগ্রেস, আদালত এবং প্রশাসন- সবাই প্রতিবন্ধীদের অধিকারের ব্যাপারে সরব হয়েছে। তারাও যাতে নেতৃত্বে আসতে পারেন সেজন্যে সমর্থন দিয়েছেন।”
“গ্যালাডেট বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পাচ্ছে, সে কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে একজন যোগ্য এবং বধির ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।”
কড়া গোপনীয়তায় নিয়োগ প্রক্রিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বাইরে অনেকের কাছেই এই সময়টাকে মনে হয়েছিলো নতুন এক ইতিহাস গড়ার সুযোগ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড এতে অনুপ্রাণিত না হয়ে বরং আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।
কিং জর্ডান বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার জন্যে প্রার্থীদের যে ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিলো সেটা করা হয় অত্যন্ত গোপনে।
তিনি বলেন, “চূড়ান্ত সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসির একটি হোটেলে যা পুরোপুরি গোপন রাখা হয়েছিলো। যখন সাক্ষাৎকারের জন্যে আমাকে ডাকার কথা, তখন আমার বাড়িতে তারা একজন ড্রাইভারকে পাঠালো আমাকে তুলে নেওয়ার জন্যে।”
“আমি বললাম, আমি তাহলে আমার স্ত্রীকে জানিয়ে যাই যে কোথায় যাচ্ছি। তারা সরাসরি না করে দিলো। তারা এটাকে গোপন রাখছিলো এই ভয়ে যে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরাও হয়তো সেখানে গিয়ে হাজির হয়ে যেতে পারে। কারণ যে তিনজনকে সাক্ষাৎকারের জন্যে ডাকা হয়েছিলো তাদের মধ্যে একজন কানে শুনতে পেতেন।”
তিনি বলেন, সেই সাক্ষাৎকারটিও ঠিকমতো নেওয়া হয়নি।
“এই সাক্ষাতকার বধিরদের জন্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। ইন্টারভিউটা নেওয়া হচ্ছিলো একটা কনফারেন্স রুমে। তার মাঝখানে ছিল কয়েকটা পিলার।” এতে করে সমস্যা তৈরি হচ্ছিল তার জন্য, জানান তিনি।
“দোভাষী আমাকে যেভাবে ইশারা ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন সেটা খুব কঠিন ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না প্রশ্নটা কোত্থেকে আসছে, কে করছে। যেসব প্রার্থী বধির নন, তারা একে অন্যের সাথে কথা বলছিলেন। ফলে আমার জন্যে এটা খুব কঠিন ছিল।”
সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ
মার্চ মাসের ৬ তারিখে ট্রাস্টি বোর্ড গ্যালাডাট ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে এলিজাবেথ জিনসারকে মনোনীত করার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করলেন। তিনজন প্রার্থীর মধ্যে একমাত্র তিনিই বধির ছিলেন না।
কিং জর্ডান বলেন, “তারা এক পাতার একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিল। তার উপরে বড় বড় হরফে লেখা ছিলো শিরোনাম- গ্যালাডাট বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রথম একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করলো। শত শত শিক্ষার্থী তখন এর প্রতিবাদে ফেটে পড়লো। এই ঘোষণাটি ছিলো একটি দিয়াশলাই-এর মতো যা প্রতিবাদী আগুনের সূচনা করলো।”
আন্দোলনকারীরা তখন পুরো ক্যাম্পাস ঘিরে ফেললো এবং জানালো, তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত কাউকে তারা ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকতে দেবে না।
তখন পরিস্থিতি শান্ত করতে বোর্ডের চেয়ারম্যান জেইন স্পিলম্যান শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন।
শিক্ষার্থীরা তখন আরো ফুসে উঠলো। চিৎকার করে, হুইসেল বাজিয়ে এমনকি ফায়ার অ্যালার্ম বাজিয়ে বোর্ডের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানালো তারা। এক পর্যায়ে যেখান থেকে ঘোষণা করা হচ্ছিলো সেই মঞ্চটিও তারা দখল করে নিলো।
বধিরদের এরকম আন্দোলনের কথা বোর্ডের লোকেরা চিন্তাও করতে পারেনি, কিং জর্ডান বলেন।
“বোর্ডের চেয়ারম্যান একসময় শিক্ষার্থীদেরকে শান্ত হওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনলো না। একসময় তারা সেখান থেকে চলেও গেলো।”
সিদ্ধান্ত বদলালো যেভাবে
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন অব্যাহত রইলো।
কিং জর্ডান বলেন, “ক্যাম্পাসের বাইরে তারা নানা ধরনের সাইন টানিয়ে দিল। বাইরে দিয়ে যেসব গাড়ি যাচ্ছিলো, যারা প্রতিবেশী ছিলো, তারা সবাই এই আন্দোলনে সমর্থন দিলো। বললো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই একজন বধির প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত।”
কানে শুনতে পান এরকম একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করার তিনদিন পরেও শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস অবরোধ করে রাখলো। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন এলিজাবেথ জিনসার।
কিং জর্ডান বলেন, “ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্যে, আবার যাতে এখানে স্বাভাবিক লেখাপড়ার কাজ শুরু হতে পারে - সেজন্যে আমি বোর্ডকে অনুরোধ করছি এমন এক ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করার জন্যে যিনি শ্রবণ প্রতিবন্ধী। গতরাতে আমি আমার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি।”
বোর্ডের চেয়ারম্যান জেইন স্পিলম্যানও তার পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন।
আন্দোলন শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় কিং জর্ডানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হলো, আরএর ছয় মাস পরেই তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন।
তখন এক ভাষণে তিনি বলেন, “বধির লোকেরা দীর্ঘ সময় ধরে বঞ্চিত ছিল। তাদের কোন অনুপ্রেরণা ছিলো না। কিন্তু গত মার্চ মাসে আমাদের একতা, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের শক্তি বিপ্লব ঘটিয়েছে। আমরা আমাদের অনুপ্রেরণাও খুঁজে পেয়েছি।”
তিনি মনে করেন এই আন্দোলন বধির সম্প্রদায়ের মানুষকে নতুন শক্তি দিয়েছে-”এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি যে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের সামনেও কোন সীমা নেই। কখনো বলবেন না যে আমরা এটা করতে পারি বা ওটা করতে পারি না।”
ড. কিং জর্ডান ১৮ বছর ধরে গ্যালাডাট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন তিনি কাজ করছেন শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়।
“আমরা সবকিছুই করতে পারি। শুধু যেটা পারি না সেটা হলো- শুনতে পারি না। কিন্তু আমাদের নিজস্ব কিছু উপায় আছে যা দিয়ে আমরা সব করতে পারি। বধির নন এরকম ব্যক্তির মতো আমিও কিন্তু আপনাকে সাক্ষাতকার দিতে পারছি,” বলেন তিনি।