কথা হচ্ছিলো ইকবাল বাহার জাহিদের সাথে, নিজে বলার মতন একটি গল্প নামক অনলাইন ভিত্তিক উদ্যোক্তা সৃষ্টির জনপ্রিয় একটি প্লাটফর্ম এর প্রেজেন্টস & ফাউন্ডার। অন্টারপ্রেনরশিপ অ্যান্ড স্টার্টআপ কমিটির চেয়ারম্যান।
তার সোজাসাপ্টা উত্তর, ” ই- কমার্স লিল্পে এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্রমশ রুগ্ন হয়ে যাবে।
এখনো আমরা স্ট্রাগল করছি দাড়ানো জন্যে, সেই অর্থে এটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ দেশি উদ্যাক্তাদের জন্যে”।
দেশি অংশীদার ছাড়াই বিদেশি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের ডিজিটাল কমার্স খাতে বিনিয়োগের সুযোগ পেলে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে বলে মনে করছেন এ খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকে।
তারা বলছেন, চীন, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ আইন করে বিদেশি ই-কমার্স কোম্পানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি বজায় রাখায় তাদের দেশীয় উদ্যোক্তারা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। সে কারণেই চীনে আলিবাবার মতো প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পেরেছে।
তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পণ্য-সেবা বিক্রি ও ডিজিটাল লেনদেনের বিষয়গুলো নিয়মের মধ্যে আনতে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ‘জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা’ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়। পরের বছর ৩১ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হয়।
নীতিমালায় বলা ছিল- “ডিজিটাল কমার্স খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধিবিধান প্রতিপালন করতে হবে; তবে বিদেশি ডিজিটাল কমার্স ইন্ডাস্ট্রি দেশীয় কোনো ইন্ডাস্ট্রির সাথে যৌথ বিনিয়োগ ছাড়া এককভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না এবং দেশীয় ডিজিটাল কমার্স ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।”
ই-কমার্সে দেশি অংশীদার লাগবে না বিদেশিদের
সেই নীতিমালা অনুযায়ী, ৫১ শতাংশ দেশীয় অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানির ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনার নিয়ম ছিল। কিন্তু কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ না থাকায় নিয়ম উপেক্ষা করেই দেশে ব্যবসা চালিয়ে আসছিল বেশ কিছু কোম্পানি।
এর মধ্যেই সোমবার মন্ত্রীসভার বৈঠকে ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা সংশোধন করা হয়। এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ‘দেশীয় অংশীদার রাখার’ এবং ‘দেশীয় শিল্পের স্বার্থসমূহকে প্রাধান্য দেওয়ার‘ শর্ত বাদ দেওয়া হয় ওই সংশোধনে। এর ফলে দেশি অংশীদার ছাড়াই বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশের ডিজিটাল কমার্স খাতে একক বিনিয়োগের কোনো বাধা থাকল না।
ডিজিটাল কমার্স নীতিমালায় মন্ত্রিসভার অনুমোদন
সরকারের এই সিদ্ধান্ত ডিজিটাল কমার্স খাতের দেশীয় কোম্পানিগুলোর ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন আজকের ডিল ও বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বড় বড় বিদেশি কোম্পানি এলে দেশীয় কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ভারতে শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও সেটা নানা শর্তের জালে আবদ্ধ।”
বাংলাদেশে পোশাক শিল্পসহ অনেক শিল্পের বিকাশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনও কড়াকড়ি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে ফাহিম বলেন, “বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পে, শিপি বিল্ডিং শিল্পে শতভাগ বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা করতে পারে না। পোশাক খাতে ইপিজেডের বাইরে শতাভাগ বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা করতে পারে না। তাই এসব খাতে বড় বড় স্থানীয় কোম্পানি তৈরি হচ্ছে। আমরা চেয়েছিল উদিয়মান শিল্প হিসাবে ডিজিটাল কমার্স খাতও যেন এ ধরনের সুরক্ষা পায়।”
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) হিসাবে দেশে অনলাইনে ব্যবসার আকার এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেশে এখন প্রায় দুই হাজার ই-কমার্স সাইট এবং ৫০ হাজার ফেইসবুক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন দেশের মধ্যে ডেলিভারি হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার পণ্য।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল লেনদেনে আনতে নতুন উদ্যোগ
দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে পাঠাও, ওভাই, পিকমি, সহজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা দিচ্ছে। এর বিপরীতে বড় প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিযোগিতায় রয়েছে শতভাগ বিদেশি কোম্পানি উবার।
অনলাইনে কেনাকাটার জন্য রয়েছে, আজকের ডিল, বাগডুম, যাদরো, ইভ্যালি, অথবা, সিনদাবাদসহ আরও অনেক কোম্পানি। এর বিপরীতে দারাজ ডটকম ডটবিডি বাজারে রয়েছে বিপুল সক্ষমতা নিয়ে।
বাংলাদেশ-চায়না বিজনেস অ্যাসোসিয়েশেনের সভাপতি ও ইকমার্স ওয়েবসাইট যাদরো ডটকমের সিইও যাদব দেবনাথ বলেন, “বিদেশিদের হাতে আইসিটির বাজার তুলে দিতে বাংলাদেশ এখনও প্রস্তুত হয়নি। কোনো শর্ত ছাড়াই বিদেশিদের অনুমোদনটা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন বাংলাদেশ সারা বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো একটা প্রোডাক্ট ডাম্পিং জোনে পরিণত হবে।”
নতুন এই নীতিমালার ফলে দেশিয় ই-কমার্সের পাশাপাশি উৎপাদনকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করেন যাদব।
অনলাইনে কেনাকাটা: কোন পথে বাংলাদেশ
“আমাদের দেশের সঙ্গে কারও এফটিএ (মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) নেই। ই-কমার্সের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশের ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলোর পণ্য এ দেশের বাজারে উন্মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু দেশের কোম্পানি ওয়ালটনের কোনো বিদেশি বাজার সৃষ্টি হবে কি?”
তবে সরকার যেহেতু নীতিমালা সংশোধন করেই ফেলেছে, এখন আর এর বিরোধিতা না করে দেশীয় উদ্যোক্তাদের কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়, সেই পথ খোঁজার পক্ষে ই-ক্যাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসিমা আক্তার নিশা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বিদেশি কোনো কোম্পানি দেশীয় কোনো সহযোগী ছাড়া ব্যবসা করতে এলে তাদের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা যেতে পারে। পাশাপাশি দেশীয় ই-কমার্স কোম্পানির ওপর আরোপিত সব কর মওকুফ করে দিতে হবে।
ভ্যাট আরোপে স্থবির হবে ই-কমার্স খাত: বেসিস
বিদেশি বড় কোম্পানি এলে দেশের ক্ষুদ্র ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন- এমন ধারণার সঙ্গে একমত নন নিশা।
তিনি বলেন, “বড় কোম্পানিগুলো এ দেশে এলে তাদের মার্চেন্ট হিসেবে আমাদের ছোট ছোট কোম্পানিগুলোকেই বেছে নিতে হবে। তাতে দেশি কোম্পানিগুলোই লাভবান হবে।”
তবে ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রাসেল মনে করেন, নীতিমালা সংশোধনের ফলে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের ই-কমার্স খাতে।
“তাদের পাওয়ার অব মানি যেটা থাকবে, সেটা আমাদের মত কোম্পানির জন্য চ্যালেঞ্জিং। আমরা বাজার ধরার জন্য স্ট্রাগল করছি, বিনিয়োগ করে যাচ্ছি। তাদের বড় বিনিয়োগের কাছে আমরা তো টিকতে পারব না। দেশে ছোট ছোট অসংখ্য ই-কমার্স সাইট গড়ে উঠেছে। এদের উপেক্ষা করে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়েছে কিনা সেটা সরকারকে ভেবে দেখার অনুরোধ থাকল।”