মোঃ আরফান আলী, প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড। ব্যাংকিং সেক্টরে একজন উজ্জল ব্যক্তিত্ব। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পথিকৃৎ। যার হাত ধরে এদেশে প্রথম এজেন্ট ব্যাংকিং এর যাত্রা শুরু হয়েছিল।
একটি সুন্দর আগামীর জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়া যার অঙ্গিকার। নতুন সহস্রাব্দের একটি প্রজন্মকে সমৃদ্ধ আগামীর পথে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্য তাড়িত করে তাকে। সরকারের দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পথে তিনিও একজন সহযাত্রী। এমন একটি সমাজ গড়ায় তিনি নিবেদিত যেখানে দারিদ্র্যতো কমবেই, পাশাপাশি মানবাধিকার সবোর্চ্চ গুরুত্ব পাবে।
ব্যাংকিং অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তার পেশাজীবন। সদালাপি মানুষ। মানুষকে আপন করে নিতে পারার দারুণ এক সম্মোহনী ক্ষমতা আছে তার। প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণের আগে তিনি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২৯ বছরের বেশি পেশাগত জীবনে বহুমুখী ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন। ১৯৯১ সালে আরব বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেডে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে হানিল ব্যাংকে যোগদান করেন এবং ব্যাংকের ঢাকা অফিস স্থাপনে মূল ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পূর্বেই তিনি এসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) হিসেবে ব্যাংক এশিয়ায় যোগদান করেন এবং ব্যাংক এশিয়া কর্তৃক দেশে প্রথমবারের মতো দুটি বিদেশী ব্যাংক- ব্যাংক অব নোভা স্কশিয়া অব কানাডা এবং মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক অব পাকিস্তান- এর বাংলাদেশ কার্যক্রমের মালিকানা অধিগ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
জনাব মোঃ আরফান আলী সুইফট এর বাংলাদেশী সদস্য ও ব্যবহারকারীদের সংগঠন-এর বর্তমান সভাপতি এবং বাংলাদেশ মানি মার্কেট ডিলার্স এসোসিয়েশন (বিএএমডিএ) এর উপদেষ্টা। এছাড়া তিনি এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ লিমিটেড (এবিবি) এর সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ জনাব আলী পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্সস্টিটিউট অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) এ খন্ডকালীন প্রভাষক এবং “একাডেমিক অ্যাডভাইজরি বোর্ড, স্কুল অফ বিজনেস”, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি (আইইউবি) এর একজন উপদেষ্টা হিসেবে বেশ কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
কথায় কথায় জানালেন তার ব্যাংকিং সেবা, সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কার্যক্রম ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা কথা।
এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশ: ব্যাংক নিয়ে ভাবনাগুলো জানতে চাই।
প্রেসিডেন্টঃ গ্রাহকদের জন্য উচ্চমানের সেবা নিশ্চিত করতে এবং জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ও সম্প্রসারণে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে দেশের একাধিক সফল ও প্রখ্যাত উদ্যোক্তার উদ্যোগে ২৭ শে নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে ব্যাংক এশিয়া যাত্রা শুরু করে। আমাদের লক্ষ্য দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া এবং গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষ সহ সমাজের সকল স্তরের জনগণের কাছে ব্যাংকিং পরিসেবা পৌঁছে দেয়া। আমরা আমাদের কর্পোরেট ক্লায়েন্টদের পাশাপাশি কুটির শিল্প, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ক্লায়েন্টদের অর্থায়ন করছি। এছাড়াও গত সাত বছরে আমরা আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠিকে সেবা দেওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করেছি, যা সমাজ এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ব্যাংকিং শিল্পে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য ব্যাংক এশিয়াকে এখন রোল মডেল বিবেচনা করা হয়। আগামী পাঁচ বছরে “দেশের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকবে, প্রতিটি গ্রামে একটি আর্থিক কিউস্ক থাকবে” এই লক্ষ্য নিয়ে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি “।
আমাদের রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শাখা, উপ-শাখা, এসএমই/কৃষি শাখা, এসএমই পরিষেবা কেন্দ্র, ডিজিটাল ব্যাংকিং বুথ, দেশব্যাপী বিস্তৃত এজেন্ট আউটলেট, ব্রোকারেজ হাউস এবং বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস- যার সবকটিতে রিয়েল-টাইম অনলাইন ব্যাংকিং সেবা চালু আছে। আমরা শক্তিশালী বিকল্প ডেলিভারি চ্যানেলগুলিও তৈরি করেছি যার মধ্যে রয়েছে ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপস, ২৪ ঘন্টা এটিএম পরিষেবা ইত্যাদি। আমরা আমাদের সকল শাখা ও এজেন্ট পয়েন্টে প্রচলিত ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছি।
আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি, চলমান সেবা এবং উদ্ভাবনী পণ্যের মাধ্যমে আমাদের পেশাদার কর্মী বাহিনী গ্রাহকদের পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি, স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা এবং দেশের দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশ: এজেন্ট ব্যাংকিং আপনার হাতে বিকাশ ঘটেছে এবং এটিতে আপনি অবিভাবকের ভূমিকায় আছেন। আপনি কি মনে করেন এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে এন্টারপ্রেনারশীপ ডেভেলপমেন্ট সম্ভব?
প্রেসিডেন্টঃ এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে এন্টারপ্রেনারশীপ ডেভেলপ সম্ভব এবং হচ্ছে। বাংলাদেশে কিন্তু আগে উল্লেখযোগ্য ভাবে উদ্যোক্তার বিকাশ ঘটে নাই, যতটুকু যা ঘটেছে ব্যাংকের ডিরেক্টশীপের মাধ্যমে ঘটেছে। এজেন্ট ব্যাংকিং এই জায়গাটার আমুল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিং এন্টারপ্রেনারশীপ ডেভেলপমেন্টে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এখানে আমরা শুধুই গ্রাহক সেবা দিয়ে থাকি। একজন উদ্যোক্তা এজেন্ট স্বত্তাধিকারী হচ্ছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে ব্যাংক যেতে পারছে না, এজেন্ট ব্যাংকিং সেসব জায়গায় পৌছে যাচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে দূর্গম ও প্রত্যন্ত জনপদের জনগোষ্ঠি তাদের প্রয়োজনীয় সকল ব্যাংকিং সেবা নিতে পারছে। যেখানে অন্যান্য দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং অন্য সব পন্যের সাথে একটি পার্ট হিসেবে থাকে।
সেই হিসেবে যতগুলি বুথ হয়েছে প্রত্যেকে এক এক জন এন্টারপ্রেনার। এছাড়া ২য় পর্যায়ে যারা যারা এজেন্ট ব্যাংকিং-এ কাজ করছে তারা আবার মাইক্রো ফাইন্যান্সিং এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে তুলছে। এই ভাবে উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে এটি একটি অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।
এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশ: এজেন্ট ব্যাংকিং কে আরো কার্যকর করতে আপনার কোন সাজেশন আছে কি?
প্রেসিডেন্টঃ দেখুন শুধু মাত্র ঋণ দিলেইতো হবে না, সেটি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, স্টার্ট-আপ এর ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে তাদের পুজির ব্যবস্থা করলে পুঁজি হারানোর হার কম থাকে এবং কাজে সফলতার হার বেড়ে যায়।
এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশ: ব্যাংকাসুরেন্স কি এজেন্ট ব্যাংকিং এর সাথে যৌথভাবে এন্টারপ্রেনারশীপ ডেভেলপমেন্ট এ ভুমিকা রাখতে পারে? কি ভাবে?
প্রেসিডেন্টঃ ইয়েস পারে, আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি গার্ডিয়ান লাইফ এর সাথে । বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমতি দিলেই এটি শুরু হয়ে যাবে। আমরা এটি নিয়ে খুব আশাবাদী। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে এটি কাজ করবে।
এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশ: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রশ্নে ই-কমার্স একটি ভূমিকা রাখছে। এর বিকাশে আপনার ভাবনা কি? কি ভাবে এটিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া যায়?
প্রেসিডেন্টঃ একটি বিষয় মানতে হবে, যে যে বিষয়ে এক্সপার্ট তাকে সেই কাজটি করতে দেয়া উচিত। আমি মনে করি এসএমই ফাউন্ডেশন সহ যারা এটি নিয়ে কাজ করছেন, তারা কাজটি করুন, আমরা পার্টনারিং করতে প্রস্তুত। তারা ক্ষেত্র তৈরি করুন আমরা সেখানে ফাইন্যান্স করছি। এ ভাবে কাজটা সাকসেসফুল করা সহজ হবে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা রুটেও যাচ্ছি, রংপুরের মিঠাপুকুর এরিয়াতে আমরা এক লক্ষ কৃষক নিয়ে কাজ করছি । এদেরকে সিংজেন্টা এবং ভীঊকো, ইউকেএইড এর সহযোগিতায় এগ্রিকালচার লার্নিং টা দিচ্ছে, কি ভাবে ভালো ফসল ফলানো যায়। সেখানে আমরা দিচ্ছি ব্যাংক একাউন্ট সুবিধা এবং ক্ষুদ্র ঋণ। তার মানে কেউ ক্ষেত্র তৈরি করবে কেউ সেখানে ফান্ড রাইজিং এ সহযোগিতা করবে।
এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশ: একটি গ্রাম একটি বৃহত্তর খামার কনসেপ্টটি কিভাবে দেখছেন কিংবা একটি গ্রাম একটি বৃহত্তর গার্মেন্টস, ওমেন এম্পাওয়ারমেন্টে কেমন ভুমিকা রাখবে বলে মনে করেন?
প্রেসিডেন্টঃ খুব ভালো আইডিয়া। আমার বাড়ী আমার খামার এর মতো করে করতে পারলে খুব ভালো ফল দিবে এটা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইউনিক প্রজেক্ট- আমার বাড়ী আমার খামার। আমরাও এই প্রজেক্টের সাথে কাজ করছি।
আপনার আইডিয়ার মেরিট আছে। একটি মানুষ তার পরিবারের ভিতর থেকে যদি পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারে, এটি খুব ভালো একটি কাজ হবে।
এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশ: সেবামূলক কাজ গুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রেসিডেন্টঃ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যাংক এশিয়া একটি সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক প্রতিষ্ঠান। সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকাগুলি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যাংক এশিয়া ফাউন্ডেশন ফেব্রুয়ারী ২০১৭ থেকে কার্যক্রম শুরু করেছে। বর্তমানে ফাউন্ডেশন সুশৃঙ্খলভাবে সিএসআর কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করছে কাঠামোগত এবং টেকসই পদ্ধতিতে।
মুন্সিগঞ্জের মালখানগরে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল কাম মেডিকেল কলেজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যাংক এশিয়া এবং ব্যাংক এশিয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জনাব এ রউফ চৌধুরী এবং তার পরিবারের সদস্যরা এই হাসপাতালের জন্য ৭০০ শতাংশ জায়গার উপর একটি তিনতলা বিল্ডিং অনুদান দিয়েছেন। হাসপাতালটি এরই মাঝে সেবাদান শুরু করেছে। পাশাপাশি এর আধুনিকায়ন ও বর্ধিতকরণের কাজ চলছে।
এর বাইওে ফাউন্ডেশন যথাযথ প্রক্রিয়ায় ২০১৯ সালের জন্য ব্যাংক এশিয়া উচ্চতর শিক্ষা বৃত্তি অর্জনের জন্য ২৩০ জন শিক্ষার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করেছে এবং ইতিমধ্যে বৃত্তির অর্থ বিতরণ শুরু করেছে।
এছাড়াও ফাউন্ডেশনের আরো কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে- হাসপাতাল, ক্লিনিক, চিকিৎ্সা ও চক্ষু শিবিরের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা প্রদান। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান। দরিদ্র ও দুস্থ মানুষের মাঝে কম্বল এবং শীতের কাপড় বিতরণ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ-অগ্নিকান্ড, দুর্ভিক্ষ, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, দুর্ঘটনা, মহামারী, খরা ইত্যাদির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের ত্রাণের জন্য আর্থিক এবং অন্যান্য সহায়তা এবং শিক্ষামূলক, বৈজ্ঞানিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক ক্রিয়াকলাপ / সংস্থাগুলির বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে অনুরূপ দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করা।