দুবছর ধরে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার যে কোনো প্রক্রিয়ায় মুক্তি চায় তার পরিবার ও দল বিএনপি। গুরুতর অসুস্থ সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর জীবন রক্ষার্থে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে প্যারোলেও সম্মতি রয়েছে তাদের। তবে যাকে নিয়ে এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, সেই খালেদা জিয়াই প্যারোলে মুক্তি চান না। তার স্পষ্ট কথাÑ তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি। যে মামলায় কারাগারে আছেন তা জামিনযোগ্য। এ মামলায় প্যারোলের আবেদন করা মানে সরকারের কাছে মাফ চাওয়া; দুর্নীতি স্বীকার করে নেওয়া। এটা তিনি করবেন না। আল্লাহর হাতে তিনি তার ভাগ্য ছেড়ে দিয়েছেন।
এ অবস্থায় অসহায় বিএনপি নেত্রীর পরিবার ও দলের নেতারা তার মুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের আনুকূল্য ছাড়া কোনো উপায় দেখছেন না। তাদের ভাষ্য, সরকার ও রাষ্ট্রপক্ষ নমনীয় হলেই খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেতে পারেন। সে প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান তারা। কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎ করেছেন যেসব নেতা ও স্বজন, তাদের সঙ্গে অথবা তারা যাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেছেন, এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা অনেক কথা বলেছি, অনেক সভা করেছি, অনেক দাবি জানিয়েছি, নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। এখন আমাদের একটাই কথাÑ খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। সরকারকে বাধ্য করব বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে জনগণের সব অধিকার ফিরিয়ে দিতে।
স্থায়ী কমিটির দুই নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার মতো জনপ্রিয়
নেতাকে কেন ছাড়বে সরকার? এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি হবেÑ এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। রাজনৈতিক নেতার মুক্তি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই হয়।
প্যারোল চাইবেন, যদি সরকার না দেয় তখন কী করবেন? এমন প্রশ্নে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, গণতন্ত্রের মা খালেদা জিয়ার প্যারোল নিয়ে দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই।
জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ১৭ বছর কারাদ- হয়েছে, দুই মামলাতেই তার জামিন আবেদন হাইকোর্টে নাকচ হয়েছে। এরপর আপিল বিভাগে গেলেও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এ মামলায় রিভিউ করতে চান। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা আবার ম্যাডামের জামিনের দরখাস্ত করব। আশা করি, অন্তত দেশবাসীকে আমাদের হাইকোর্ট বিভাগ এমন একটি ইঙ্গিত দেবেন যে, দেশে বিচারব্যবস্থা আছে, বিচারব্যবস্থা না থাকলে খালেদা জিয়াকে আমরা জামিন দিতাম না। আমরা বিশ্বাস করি, হাইকোর্ট দেশের জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল। সেখানে যদি এবার জামিনের আবেদন করি অবশ্যই জামিন লাভ করব। সিনিয়র এক আইনজীবী বলেন, যত শিগগির সম্ভব, সম্ভবত পরবর্তী সপ্তাহে বা তার পরের সপ্তাহে আমরা আবেদন করব।
এর আগে, সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তার বোন সেলিমা ইসলামসহ স্বজনরা। এর আগে উন্নত চিকিৎসায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ চেয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে তার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে প্রথম আবেদন করেন। আবেদনের কারণ ব্যাখ্যা করে পরিবারের সদস্যরা জানান, মেডিক্যাল বোর্ড যেন বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারকে সুপারিশ করে, সে জন্য তারা এ আবেদন করেছেন।
সেলিমা ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে এবং এ কারণে বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে হলেও তারা তার মুক্তি চান। তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি সরকার বিবেচনা করুক। যেভাবেই হোক, তাকে বিদেশে নেওয়ার জন্য আমাদের অনুমতি দিক। প্যারোলে হলেও। কারণ তার অবস্থা খুবই খারাপ। আবেদনে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে চেয়েছি। বলেছি যে, উনাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে। কারণ এটা মিথ্যা মামলা। সেজন্য নিঃশর্ত মুক্তির কথা বলেছি।
কিন্তু বিভিন্ন সময় যখন বিদেশে চিকিৎসার কথা এসেছে, তখন খালেদা জিয়া নিজে তা চান কিনাÑ সেই প্রশ্নও উঠেছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম বিবিসিকে বলেন, উনার সম্মতি থাকবে। উনার অবস্থা এতই খারাপ হয়ে গিয়েছে যে, পাঁচ মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। বাম হাত সম্পূর্ণ বেঁকে গেছে। ডান হাতের অবস্থাও খারাপ। তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। পায়ে কোনো সাপোর্ট রাখতে পারছেন না। এ অবস্থায় একটা মানুষ চিকিৎসার জন্য যেখানেই হোক যেতে চাইবেন। তবে খালেদা জিয়ার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন আমাদের সময়কে বলেন, খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি চান না। তবে তার সম্মান অক্ষত রেখে কি করণীয় হতে পারেÑ পরিবারের সদস্যদের বলেছেন, নিজেদের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা করতে।
এ অবস্থায় হঠাৎ করে গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মধ্যকার টেলিফোন আলাপে প্যারোল বিষয়টি উঠে আসে। গতকাল শুক্রবার ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাকে ফোন করেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য তারা পাননি। তা ছাড়া কী কারণে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর কাছে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো ধরনের লিখিত বক্তব্য যায়নি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা রাজনৈতিক নয়। তার বিরুদ্ধে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতির মামলা হয়েছে। সে কারণে তার জামিনের বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার, বর্তমান সরকারের নয়।
গতকাল রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের কথা পরিষ্কার, ম্যাডামের মুক্তির দাবি নিয়ে আমরা গত ২ বছর ধরেই কোর্টে যাচ্ছি, কথা বলছি, রাস্তায় নামছি, চিৎকার করছি। সারা দেশবাসী এ মুহূর্তে ম্যাডামের মুক্তি দাবি করছে। একই সঙ্গে আজকে তার (খালেদা জিয়া) পরিবারও করছে। কয়েকদিন আগেই তারা (পরিবার) লিখিতভাবে বিএসএমএমইউর ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের জন্য চিঠি দিয়েছেন। এর পরও যে সব প্রশ্ন, সেগুলো সব অবান্তর হয়ে যায়, প্রশ্ন থাকে না।
এর আগেও কয়েক দফা খালেদা জিয়ার প্যারোল নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। বিএনপি দলীয় এমপিরা কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে বিষয়টি আলোচনায় আসে। কারাগারে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ফিরে দলটির নারী সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, আমি সরাসরি প্যারোলের বিষয়ে ম্যাডামকে বলেছিলাম। ম্যাডাম বলেছেন, দেশের আইন অনুযায়ী আমি এখনই জামিন লাভের যোগ্য, আমি কোনো অপরাধ করিনি, সুতরাং প্যারোলের প্রশ্ন কেন আসবে?