ধনী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ কানাডা। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও শীতলতম রাষ্ট্র। এটি উত্তর আমেরিকা মহাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ নিয়ে গঠিত। পৃথিবীর সাম্প্রদায়িক দেশও বটে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা নেই বললেই চলে। নেই ধর্মভিত্তিক সংঘাত। সেখানে ভিন্ন ধর্মকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখা হয় না। নিজ ধর্ম পালনে রয়েছে সাংবিধানিক অধিকার।
কানাডায় ইসলামের ইতিহাস : কানাডায় মুসলমান ও ইসলামের বর্ণাঢ্য ইতিহাস রয়েছে। রয়েছে বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য-সভ্যতা। কানাডার মুসলমানরা নিজেদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সভ্যতাকেন্দ্রিক তাৎপর্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় বলে তারা নিজেদের ধর্ম-কর্ম ও সভ্যতা-
সংস্কৃতির ওপর অত্যধিক মনোযোগী। ইসলামফোবিয়া ছড়ানো ও ইসলামের বিপক্ষে কথা বলার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে প্রস্তাব পাস করেছে কানাডিয়ান হাউজ অব কমন্স।
দেড় শতকের বেশি সময় ধরে কানাডার মুসলিমরা দক্ষ, শিক্ষিত ও দেশের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। ছোটখাটো প্রতিকূলতা ও ইসলামফোবিয়া সত্ত্বেও পুরোপুরি ধর্মীয় আবহে অনেকটা নির্বিঘ্নে বসবাস করছে দেশটির মুসলিমরা।
মুসলমান হওয়ার কারণে তারা গর্ববোধ করেন। দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া মুসলমানরা নিজেদের কানাডীয় বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন।
কানাডায় ইসলামের আগমন : কানাডায় মুসলমানদের আগমন শতাধিক বছর আগে। ১৮৭১ সালের কানাডিয়ান আদমশুমারিতে প্রথম মুসলমানদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। ওই শুমারিতে মাত্র ১৩ জন মুসলমানের উল্লেখ পাওয়া যায়। জানা যায়, কানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে স্থাপনের সময় অনেক মুসলমান দেশটিতে আগমন করে। এ ছাড়া আলবার্টায় কৃষিকাজে এবং অন্যান্য প্রদেশে শিল্প-কারখানায় কাজের সন্ধানে ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকে এসেছেন। পরবর্তী সময়ে তারা দেশের বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন হতে থাকেন।
মুসলিমদের সংখ্যা ও প্রথম মসজিদ : ১৯৩৮ সালে আলবার্টার রাজধানী এডমন্টনে প্রথম মসজিদ ‘আল রাশিদ’ স্থাপিত হয়। ১৯৫২ সালে মনট্রিয়েলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পাঠ্যক্রমে ইসলামিক স্টাডিজ অন্তর্ভুক্ত করলে অনেক মুসলমান শিক্ষার্থী কানাডায় আসে। ১০ বছর পর টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ও একই বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করলে সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্রমান্বয়ে মুসলিম শিক্ষার্থী, দক্ষ শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৬০ সালের পর থেকে মুসলমান অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৮১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, কানাডায় মুসলমানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮ হাজার ৮৭০ জন। ১৯৯১ সালে সে সংখ্যা বেড়ে হয় ২ লাখ ৫৩ হাজার। এর এক দশক পর ২০০১ সালে তা বেড়ে হয় দ্বিগুণের বেশি।
সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, মুসলমানের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে ২০১০ সালের আগে। মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ মুসলমান। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ কানাডায় মুসলমান জনসংখ্যা তিন মিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারে।
পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকার কারণে বর্তমানে প্রচুর আরব ও উপমহাদেশীয় বিত্তবান মুসলমান ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে কানাডায় পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের মাধ্যমে মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
মসজিদ ও ধর্মীয় কমপ্লেক্স : কানাডায় মসজিদের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ১৫০টি। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। ৭০ শতাংশের বেশি মুসলমান নিয়মিত মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করে। প্রতিটি মসজিদে জুমায় একাধিকবার জামাত অনুষ্ঠিত হয়। মসজিদগুলোতে দৈনন্দিন উপচে পড়া ভিড় লক্ষণীয়। প্রায় সব মসজিদে এক হাজার মুসল্লি একসঙ্গে অনায়াসে নামাজ আদায় করতে পারে।
টরন্টোতে অবস্থিত সর্ববৃহৎ ইসলামি ইনস্টিটিউট কমপ্লেক্স। এতে এমন সুবিশাল একটি মসজিদ রয়েছেÑ যাতে প্রায় পাঁচ হাজার মুসল্লি একত্রে জুমার নামাজ আদায় করতে পারে। বিশাল এলাকা নিয়ে পার্কিং লট, ফুটবল ও বাস্কেটবল খেলার মাঠ এবং ইসলামি স্কুলও রয়েছে। প্রায় ৫০ বিঘার ওপর পাঁচ শতাধিক গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে কানাডার প্রায় প্রতিটি শহরে বিভিন্ন কমিউনিটিকেন্দ্রিক ইসলামিক সেন্টার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। শুধু টরন্টো নগরীতে এ ধরনের প্রায় ১৬টি প্রতিষ্ঠান ও বড় কয়েকটি মাদ্রাসাও রয়েছে।
যেসব শহরে মুসলমানরা বাস করে : প্রায় ৬০ শতাংশ মুসলমান ওন্টারিও প্রদেশে বাস করে। বিশেষ করে টরন্টো ও অটোয়ায়। ২০ শতাংশের বেশি বাস করে কুইবেক প্রদেশে যাদের বেশির ভাগই মন্ট্রিয়েলে থাকে। স্থানীয় মুসলমান জনগোষ্ঠীর তিন-চতুর্থাংশই অভিবাসী। তাদের দুই-তৃতীয়াংশ এসেছে গত এক দশকে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলমান এসেছে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ থেকে। ফরাসি ভাষাভাষী আরবীয়রা, বিশেষ করে আলজেরিয়া, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো ইত্যাদি এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে আগত মুসলমানরা সাধারণত ভাষাগত কারণে মন্ট্রিয়েলে বসবাস করে।
ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে : মুসলমানরা কানাডার ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে। কানাডার রাজনীতিতেও রয়েছে মুসলমানদের শক্তিশালী অবস্থান। মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের কারণে বেশ কয়েকজন মুসলিম এমপি ও অনেক কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। গেল অক্টোবরে কানাডার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে জয়ী হয়ে ফের ক্ষমতায় এসেছেন জাস্টিন ট্রুডো। নির্বাচনে বিজয়ীদের মধ্যে চারজন নারীসহ ১২ জন মুসলিম প্রার্থী রয়েছেন। তাদের ১১ জন ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যজন হয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টি থেকে। কানাডায় মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার জন্য অমুসলিমরাও এগিয়ে আসেন নিজ ইচ্ছায়। জাতীয় দৈনিক ও মিডিয়ায় বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলে মুসলমানদের উপস্থিতি খুব সরব না হলেও একেবারে কম নয়।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরে উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মকর্তা রয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় বহু মুসলমান রয়েছেন। শিল্প-বাণিজ্যে ও কানাডার অর্থনৈতিক উন্নয়নে মুসলমানদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৩ সালে একজন নারীসহ ১০ জন মুসলমান ব্যবসায়ী কানাডিয়ান বিজনেস অ্যাওয়ার্ড লাভ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দেশীয় গ্রহণযোগ্যতা ও গুরুত্বের ক্ষেত্রে অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চেয়ে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে এগিয়ে রয়েছেন কানাডীয় মুসলমানরা। অন্যদিকে দেখা গেছে, শিক্ষাঙ্গনে ৩১ শতাংশ স্নাতকধারী মুসলমান, যেখানে কানাডার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৭ শতাংশ স্নাতকধারী।
মুসলমানদের কর্মতৎপরতা : টরন্টো শহর দেখতে ঢাকার মতো মসজিদের শহর মনে হয়। সুন্দর-গোছালো ও স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দৃষ্টিনন্দন বেশ কিছু মসজিদ রয়েছে। প্রতিটি মসজিদে রয়েছে ইসলামি স্কুল, মাদ্রাসা, ছেলেমেয়েদের নামাজ পড়ার পৃথক ব্যবস্থা। টরন্টোর বিখ্যাত আবুবকর মসজিদের ওপর রয়েছে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের সিলেবাস অনুযায়ী একটি কওমি মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটিতে প্রায় হাজারের বেশি ছাত্র পড়াশোনা করে। পুরো শহরে এ ধরনের আরও কয়েকটি মাদ্রাসা রয়েছে। এর অধিকাংশই পাকিস্তান ও ভারত, বিশেষত গুজরাটের মুসলমানদের দাওয়াত-তাবলিগের আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রতিফলন।
প্রতি রমজানে টরন্টো সিটির প্রতিটি মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ানোর জন্য ন্যূনতম পাঁচ-ছয়জন কোরআনে হাফেজ উপস্থিত থাকেন। তারা পালাবদল করে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করেন। অন্যান্য শহরেও প্রায় একই ব্যবস্থা থাকে রমজান মাসে।
কানাডার মুসলিম নারী, কিশোরী-তরুণীরা অবাধে ও নিঃসংকোচে হিজাব পরে চলাচল করে। বিভিন্ন শহরে ভারতের গুজরাটি মুসলমানরা বেশ কিছু মসজিদ-মাদ্রাসা, ইসলামি স্কুল ও ইসলামি গবেষণাকেন্দ্র চালু করেছেন।
টরন্টোয় তাবলিগ জামাতের প্রধান মারকাজ আল-হেদায়েত মসজিদ। এটি বিশাল এলাকা নিয়ে সুবিশাল পার্কসমৃদ্ধ। প্রায় চার মিলিয়ন ডলার দিয়ে ওয়্যার হাউজ খরিদ করে নির্মাণ করা হয়। মারকাজের সোমালিয়ান, গুজরাটি ও পাকিস্তানিদের আধিপত্য বেশি। তারপর রয়েছে বাংলাদেশিদের অবস্থান। প্রতি বছরের ডিসেম্বরে তাদের বার্ষিক ইজতেমা হয়। বেসমেন্টে প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক মুসল্লি একসঙ্গে বসে ইজতেমার বয়ান শোনার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে জামাত আসে এবং আবার এখান থেকে জামাতবন্দি হয়ে বিভিন্ন শহরে যায়।