বিনায়ক দামোদর সাভারকারের পাদদেশে আনুগত্য প্রকাশ করেছেন ভারতীয় জনতা পার্টির সব নেতা। প্রয়াত অটল বিহারি বাজপেয়িকে যদিও সেই দলে ফেলা যায় না, তার পরও তাকেই বলতে হয় বিজেপির প্রথম সফল নেতা, যিনি প্রাথমিকভাবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার কোরাসে কট্টরপন্থী হিন্দুত্বের বীজ বপন করে গেছেন সার্থকভাবে। আর এখন এল কে আদভানির নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মুন্সী প্রকাশ্যে তাদের ভক্তি অর্পণ করেছেন বিনায়ক দামোদর সাভারকারের প্রতিমূর্তিতে। আর তা করতে গিয়ে তারা ভারতের স্বাধীনতাকামীদের পুরোধা মহাত্মা গান্ধীকে হেয় করেছেন। হেয় করেছেন নেহরু, আবুল কালাম আজাদদের। আর অপব্যবহার করেছেন বল্লব ভাই পাটেলকে, যিনি কখনো সাভারকারপন্থী ছিলেন না। সাভারকার গান্ধীসহ চারটি হত্যাকাণ্ডের সব কলকাঠি নেড়েছেন। নাথুরম গডসে ছিলেন তার অনুগামী এক ব্যক্তি, যিনি গান্ধীকে হত্যা করেছেন। বল্লভ ভাই প্যাটেল এই হত্যাকাণ্ডের জন্য স্পষ্টত সাভারকারকেই দায়ী করেছেন।
গান্ধী হত্যাকাণ্ডে বিনায়ক দামোদর সাভারকারের বিরুদ্ধে প্রধান সাক্ষী ছিলেন রাজসাক্ষী দিগম্বর ব্যাজ। অপর দুই সাক্ষী সাভারকারের বাড়িতে তাদের যাওয়া-আসার বিষয়ে অনুসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। বিচারক আত্মাচরণ ব্যাজকে একজন সত্যবাদী সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে দেখেছেন। একইভাবে আপিলের সময় পাঞ্জাব হাইকোর্টও দেখেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার বর্ণনা নিরপেক্ষ এভিডেন্সের মাধ্যমে যথার্থ বলে প্রমাণিত। কিন্তু কোর্টে তার বর্ণনানুসারে ১৪ ও ১৭ জানুয়ারি নাথুরাম গডসে ও তার দোসর নারায়ণ আপ্তে সাভারকারকে দেখার জন্য তার বাড়ি গিয়েছিলেন, এমন কোনো অনুসাক্ষ্য দেওয়া হয়নি। উভয়ক্ষেত্রে ব্যাজকে বাইরে রাখা হয়। দ্বিতীয়বার তিনি সাভারকারের উৎসাহব্যঞ্জক উচ্চারণ শোনেন, যা গডসে ও আপ্তেকে বলা হয় ‘যশবী হোন ইয়া’। (সফল হও এবং ফিরে আসো)।
দুজন প্রতিসাক্ষ্যদানকারী বলেন, তার চেয়ে বেশি কিছু হয়নি, তিনজন বাড়ির কাছে নেমে যাওয়া পর্যন্ত। কিন্তু বাড়ির পেছনে আরো দুটি বাড়ি ছিল। আইনে আরো একজন রাজসাক্ষীর প্রয়োজন। সাভারকার যদিও ছাড়া পায়, তার পরও দেখা যায় ভারতীয় এভিডেন্স আইন ১৮৭২-এর ১৩৩ ধারা মতে, ‘কোনো দণ্ড অবৈধ নয় শুধুমাত্র এ কারণে যে, তার পক্ষে কোনো সঙ্গের সাথির প্রতিসাক্ষী ছাড়াই তা প্রদান করা হয়েছে।’
এই দণ্ডের এক বা দুই বছর পর সাভারকারের মৃত্যু হয়। তারপর তার বডিগার্ড আপ্তে রামচন্দ্র কামার এবং তার সেক্রেটারি গজানন বিষ্ণু দামালে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য গঠিত কাপুর কমিশনের কাছে এই ফাঁকা স্থানের পূরণ করেন। কমিশন উল্লেখ করে : এই দুজনের বিবৃতিতে দেখা যায়, এই আপ্তে ও গডসে উভয়েই ছিল বোম্বেতে সাভারকারের কাছে নিয়মিত ভিজিটর। সকল কনফারেন্স ও সকল সভায় তারা সাভারকারের সাথে উপস্থিত থাকত। এই এভিডেন্সে দেখা যায়, কারকারেও সাভারকারের কাছে নিয়মিত ভিজিটর ছিলেন। ব্যাজও সাভারকারের কাছে যেতেন, ড. পারচুরও যেতেন। দেখা যায়, গান্ধী হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সবাই কোনো না কোনোভাবে বোম্বেতে অবস্থিত সাভারকার সদনে যেতেন। বোম্বের দাদারে এই সাভারকার সদন অবস্থিত। উল্লেখ্য, কারকারে ও মদনলাল সাভারকারের কাছে গিয়েছেন, তারা দিল্লি যাওয়ার পূর্বে। আপ্তে ও গডসে তার সাথে দেখা করেছেন বোমা নিক্ষেপের পূর্বে এবং হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পূর্বে। এবং প্রতিবারই তারা দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। গডসে ও আপ্তে তার সাথে জনসভায় উপস্থিত থাকতেন, যা ১৯৪৬, ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই দুজন যদি কোর্টে তা বলতেন, তাহলে সাভারকারও দণ্ডিত হতেন। সাভারকারের বাড়িতে গডসে ও আপ্তে যে সফর করেছেন ১৯৪৮ সালের ১৪ ও ১৭ জানুয়ারি, তা নিয়ে কোনো দ্ব্যর্থতা নেই।
সাভারকারের দেহরক্ষী কামার বলেছেন, তারা বোমা বিস্ফোরণের পর ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি সাভারকারের বাড়ি গিয়েছেন। সাভারকারের সেক্রেটারি দামালে বলেছেন, গডসে ও আপ্তে জানুয়ারির মধ্যভাগে তার সাথে দেখা করেছেন এবং সাভারকারের সাথে তার বাগানে বসেছেন।
বোম্বে পুলিশের ডেপুটি কমিশনার জামশেদ নাগরবালা তার ক্রাইম রিপোর্ট নং-১-এ বলেছেন, সাভারকার এই ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল এবং সে অসুখে আক্রান্ত ছিল। হত্যাকাণ্ডের পরদিন, ৩১ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে, নাগরবালা যে চিঠি লিখেছেন, তাতে উল্লেখ করা হয়, ‘সাভারকার, গডসে ও আপ্তে দিল্লি যাওয়ার প্রাক্কালে ৪০ মিনিটের জন্য বৈঠক করেন।’
এই কথা উল্লেখ করেন, কামার ও দামানে তার কাছে যে কথা উল্লেখ করেছেন, তার ভিত্তিতে। ‘এই দুজনের সাভারকারের বাড়িতে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়া প্রবেশাধিকার ছিল।’ স্বল্পক্ষণের জন্য গডসে ও আপ্তে সাভারকারের সাথে আবার মিলিত হন। ব্যাজ তখন উপস্থিত ছিল না। সেটা ছিল জানুয়ারির ১৪ ও ১৭ তারিখে। তাদের কোনো কোর্টে সাক্ষী হিসেবে পেশ করা হয়নি, তা ছিল রহস্যময়।
১৯৪৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নেহরুর কাছে বল্লভ ভাই প্যাটেল লেখেন, “আমি নিজে ‘বাপু’ (গান্ধী) হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধানের অগ্রগতির সাথে সংশ্লিষ্ট আছি।” তার উপসংহার ছিল, ‘হিন্দু মহাসভার ধমৌমত্ত শাখা সরাসরি সাভারকারের নেতৃত্বে (যিনি ষড়যন্ত্র গভীর করেছেন) এবং ষড়যন্ত্রের সমাপ্তি দেখেছেন, তার কারসাজিতে হয়েছে।’ এর সাথে অনুসাক্ষ্য রয়েছে হিন্দু মহাসভার এক সদস্য পি এল ইমামদারের। যার সাথে ওকালতি ড. ডি এস পারসুর মতো ষড়যন্ত্রীকে ছাড়িয়ে নিতে পেরেছে। তিনি সবাইকে খুশি করতে পেরেছিলেন এবং তাদের মধ্যে সি কে ডাপটারি, বিচারক আত্মাচরণ ও সাভারকার নিজেই ছিলেন।’
সাভারকার একসময় ব্রিটিশদের সাথে সহযোগিতা করবে বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন এবং ৬ বার ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। সেই সাভারকারকে ভারতের গোমাংসবিরোধী, মুসলিমবিদ্বেষী, হিন্দুত্বের দীক্ষাধারীদের রাজনৈতিক গুরু করা হয়েছে।
তারা নাথুরাম গডসের মূর্তি বসিয়েছেন। বল্লভ ভাই প্যাটেলের মূর্তি বসিয়ে তাকে গৌরবান্বিত করার চাইতে সাভারকারের সঙ্গের সাথি করে অপমানিত করেছেন। তাদের হাতে ভারতের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা কতটুকু নিরাপদ?
স্বামী বিবেকানন্দের জন্মবার্ষিকী এখন পালিত হচ্ছে। অথচ বিবেকানন্দও হিন্দুত্বের যে আজকে প্রয়োগ চলছে, তাতে বিশ্বাসী ছিলেন না। এই হিন্দুত্ব চলছে ১৯২০ সালের সাভারকারের হিন্দুত্ব, যা গান্ধীকে হত্যা করতে উজ্জীবিত করে। আর তার হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করে।
[বিভিন্ন সাময়িকী ও নিবন্ধ থেকে গৃহীত।]