কেবল একটি বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়, একটি দশকও শেষ হচ্ছে। ২০১০ সালে এই দশকের শুরু, আর শেষ ২০১৯ দিয়ে। আমরা যেমন নতুন বছরে প্রবেশ করছি, একই সঙ্গে শুরু হচ্ছে নতুন একটি দশক।
কেমন গেল ২০১০–এর এই দশক। ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার পরে যথেষ্ট অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল নতুন এই দশক। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এই দশক। এমনিতে ভালোই চলছিল, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে অনেক কিছুই আর আগের মতো থাকেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু পরিবর্তন এমনই যে তা আর হয়তো কখনো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না।
বাংলাদেশের জন্য অবশ্য এই দশকটি ভালো ছিল। অর্থনীতি এগিয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। আবার ভালোর বিপরীতে মন্দও কম ছিল না। সময়টা ছিল বড় প্রকল্পের। সরকারের আগ্রহ ছিল বড় প্রকল্পের দিকেই বেশি। আবার দশকটিকে বিনিয়োগ স্থবিরতার বছরও বলা যায়। বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগের দিক থেকে। দেখা যাক কী কী ছিল শেষ বছর, শেষ দশকটিতে।
সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশের গুপী বাঘাকে বলেছিল, ‘আয়েশ করে আলসেমিতে দশটি বছর পার, ভাল্লাগে না আর’। তবে গত দশকটিতে ‘আয়েশ’ করার বেশ কিছু সূচক যেমন ছিল, তেমনি ছিল ‘ভাল্লাগে আর আর’ ধরনের ঘটনাও। শুরুতে একটু আয়েশ করা যাক—
উচ্চ প্রবৃদ্ধির দশক
২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর মাঝে কখনোই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নিচে নেমে যায়নি। সব মিলিয়ে শেষ হওয়া এই দশকের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। এমনকি বিশ্বের কম দেশেই এই হারে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে।
দেশের প্রবৃদ্ধি দীর্ঘদিন ৫ শতাংশের মধ্যে আটকে ছিল। বিদায়ী দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা আটকে ছিল ৬ শতাংশের মধ্যে। সেখান থেকে গেল ৭ শতাংশে। আর শেষ বছরে এসে তা হয়েছে ৮ শতাংশের বেশি।
প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৮২৫ ডলার। আর এখন সেই মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ ডলার। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১০৬ শতাংশ। অবশ্য আয় বাড়লেও খারাপ খবর হচ্ছে, আয়ের বৈষম্যে ভালো কিছু ঘটেনি; বরং বৈষম্য বেড়েছে।
মধ্যম আয়ের দেশ
আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ আয়ের দেশ হয়েছে এ দশকেই। ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের তালিকায় নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। মূলত মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিবেচনায় বিশ্বব্যাংক এই তালিকা করে থাকে। শুরু থেকে বাংলাদেশ ছিল নিম্ন আয়ের দেশে। এখন সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হওয়া।
এখানে বলা রাখা ভালো, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল (ডেভেলপিং) দেশে উত্তরণের সব শর্ত পূরণ করেছে। এখন বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ পর্যালোচনা করবে ২০২১ সালে এবং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। আর ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে এ বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে হবে।
রানা প্লাজার আগে ও পরে
২০০৫ সালে যখন কোটা ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়, তখন অনেকেরই আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আর টিকে থাকতে পারবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের অবস্থান আরও ভালো হয়েছে। ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসের পরে একই আশঙ্কা আবারও জোরালো হয়। ক্রেতাদের চাপে পোশাক খাতে বড় ধরনের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিতে হয়। ক্রেতাদের নিয়ে গঠিত হয় দুটি ফোরাম—অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। সব মিলিয়ে দেশের পোশাক কারখানা এখন অনেক নিরাপদ। আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থানও দৃঢ় হয়েছে। যেমন ২০১০-১১ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১ হাজার ৭৯১ কোটি ডলার। তখন মোট রপ্তানিতে পোশাকের অংশ ছিল ৭৮ শতাংশ। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেই রপ্তানি আয় বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলার। আর মোট রপ্তানিতে এর অবদান বেড়ে হয়েছে ৮৪ শতাংশ। বাংলাদেশ এখন একক দেশ হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চে পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। যদিও ২০১৯ সালের যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই অবস্থান হুমকির মুখে। ভিয়েতনাম ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। নিজের অবস্থান ধরে রেখে এগিয়ে যাওয়াটাই হবে পোশাক খাতের আগামীর চ্যালেঞ্জ।
সবুজ কারখানা
দেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা ছিল পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে নির্মিত ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। এর উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমান মৃধা। সময়টা ছিল ২০১২ সাল। সেই থেকে যাত্রা শুরু। তবে সবুজ কারখানা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বেশি বেড়েছে মূলত রানা প্লাজা ধসের পরে। এখন পর্যন্ত দেশে ৯৪টি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকল হয়েছে। জুতা ও ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাণেও আছে পরিবেশবান্ধব কারখানা। এমনকি বাণিজ্যিক ভবনও। সব মিলিয়ে শত ছাড়িয়েছে।
বিশ্বে জিনস বা ডেনিম কাপড় উৎপাদন করার প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা হচ্ছে বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ভালুকায় এনভয় টেক্সটাইল। নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেডে রেমি হোল্ডিংস বিশ্বের সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার একটি। আবার নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশনস হচ্ছে নিট পোশাক তৈরি করা বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা। গত দশকে এটিও বাংলাদেশের বড় অর্জন।
এগিয়ে থাকা সাতটি খাত
পোশাকশিল্পের ধারেকাছেও কেউ নেই। তবে এটি মূলত রপ্তানি খাত। তবে দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কম নয়। আর এই চাহিদা মেটাতে গত ১০ বছরে বেশ কিছু শিল্প খাতের প্রসার ঘটেছে বেশ বড় আকারেই। পাশাপাশি রপ্তানি আয়েও তাদের হিস্যা বাড়ছে। সবার আগে নাম করতে হয় ওষুধশিল্পের। দেশের মোট চাহিদার ৯৭ শতাংশই পূরণ করছে দেশের ওষুধশিল্প। পাশাপাশি এক শর বেশি দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। বড় বিনিয়োগের আরেকটি বড় খাত হচ্ছে ইস্পাত। বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে এই খাতে। একইভাবে দেশীয় সিমেন্টশিল্পেও দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাজার দখল করেছে। আর দেশের চাহিদা বাড়ায় দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে ইলেকট্রনিকস সিরামিক, মোটরসাইকেল ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশিল্প। গড়ে উঠেছে ওয়ালটন, প্রাণসহ বেশ কিছু দেশীয় ব্র্যান্ড।
বিকাশের বিকাশ
মানুষের হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন। তবে গত দশকে এই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কথা বলা বা বার্তা পাঠানোর চেয়েও আরও অনেক সুবিধা পেয়েছে সাধারণ মানুষ। তবে মানুষের জীবনকে সবচেয়ে সহজ করেছে মোবাইল ফোনভিত্তিক বিভিন্ন আর্থিক সেবা। আর এর মধ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে বিকাশ। ২০১১ সালে এর প্রতিষ্ঠা। শুরুতে ছিল কেবল টাকা পাঠানো। আর এখন এটা দিচ্ছে অর্থ লেনদেনের নানা সুবিধা। বিলের জন্য দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকার যন্ত্রণা বন্ধ করছে এই সেবা। আর এখন কেবল বিকাশ নয়, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ ধরনের আরও উদ্যোগ। এর মধ্যে নাম করতে হয় রকেট ও নগদের।
দেশের টাকায় পদ্মা সেতু
গত দশকে পদ্মা সেতু নিয়ে প্রধান দাতা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপোড়েন ইতিহাসে চিরদিনের মতো স্থান করে নিয়েছে। কাজ দেওয়া নিয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে—এই অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ১১০ কোটি ডলার সাহায্য স্থগিত করে দিয়েছিল ২০১২ সালে। এরপরে অন্য দাতারাও প্রতিশ্রুত সাহায্য স্থগিত করে দেয়। পরে এ নিয়ে তদন্ত, মামলা, মামলা বাতিলসহ নানা ঘটনার পরে শেষ পর্যন্ত নিজের অর্থে কাজ শুরু ২০১৫ সাল থেকে। তবে এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়নি। সময় যেমন বাড়ছে, ব্যয়ও বাড়ছে। শেষ পর্যন্ত কত টাকায় কোন সালে পদ্মা সেতু চালু হবে, তা জানা যাবে নতুন দশকে।
ঠিকাদারদের দশক
স্থবির বেসরকারি বিনিয়োগ। এই অবস্থায় বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার ভর করে নিজের ওপরেই। বাড়তে থাকে সরকারি বিনিয়োগ। বৃদ্ধি পায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার। ২০১০-১১ অর্থবছরে এডিপিতে মোট ব্যয় ছিল ৩৩ হাজার ৭ কোটি টাকা। আর সর্বশেষ এডিপির ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। সরকারি বিনিয়োগের বড় অংশই ব্যয় হয় কেনাকাটায়। আর বেশির ভাগ প্রকল্প রাস্তাঘাটসহ নানা ধরনের নির্মাণ। আর এসব কাজ করার জন্য দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ঠিকাদার।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই ঠিকাদারদের অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করে দিয়েছিল। ফলে রাতারাতি ঠিকাদার বনে যেতে কোনো সমস্যা হয়নি। আর এসব ঠিকাদারের বড় অংশই সরকারি দলের কর্মী বা সমর্থক। গত এক দশকে উন্নয়ন প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে। আর এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করেই বিপুল অর্থ গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। দেশের যেসব স্থানে শিল্প গড়ে ওঠেনি, নেই তেমন কোনো উৎপাদন কর্মকাণ্ড, সেখানেও আছে কেবল ঠিকাদার আর ঠিকাদার। পল্লি অঞ্চলে অর্থের আরেকটি উৎস ছিল প্রবাসী আয়।
আয়েশ তো অনেক হলো। এবার দেখা যাক ভালো লাগল না কী কী—
আর্থিক কেলেঙ্কারির দশক
গত এক দশকে বাংলাদেশ পিছিয়েছে আর্থিক খাতে। এ খাতে সুশাসনের অভাব ছিল প্রকট। সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি দিয়ে শুরু, এরপর বেসিক ব্যাংক। আরও ছিল বিসমিল্লাহ গ্রুপ, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট গ্রুপ কেলেঙ্কারি। আর সবশেষ ফারমার্স ব্যাংকের ঘটনা। এক দশকের এসব কেলেঙ্কারির ঘটনায় কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ধারণা করা হয় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
কেবল ব্যাংক নয়, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটেছে গত দশকে। ফলে বাধ্য হয়ে পিপলস লিজিং অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। গত দশকের আরেক আলোচিত ঘটনা ছিল ব্যাংক দখল। ইসলামী ব্যাংক দিয়ে শুরু, পরে তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও।
খেলাপিবান্ধব দশক
২০১০ সালেও দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। আর এখন সেই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির চেয়েও এ সময়ে আলোচিত ঘটনা ছিল ঋণখেলাপিদের বারবার সুযোগ ও সুবিধা দেওয়া। ২০১৫ সালে রাজনৈতিক কারণে একবার বড় ১৩ ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। আবার শেষ বছরটিতে সুবিধা দেওয়া নতুন মাত্রা পেয়েছে। সব ধরনের ঋণখেলাপিদের দেওয়া হয়েছে আরও বেশি। মাত্র ২ শতাংশ কিস্তিতে তাঁরা এখন ঋণ নবায়ন করতে পারবেন। এ সময়ে ঋণখেলাপিরা যত বেশি সুবিধা পেয়েছে, খেলাপি ঋণ ততই বেড়েছে।
বেসিক ব্যাংকের পতন
সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকেও যে একটা ব্যাংক ভালো চলতে পারে, একসময়ে তার উদাহরণ ছিল বেসিক ব্যাংক। সেই ব্যাংকটি এখন দেশের সবচেয়ে খারাপ ব্যাংকগুলোর একটি। এর দায় সরকারের। নীতি পরিবর্তন করে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়ার পর থেকে ব্যাংকটির নিম্নমুখী যাত্রা শুরু হয়। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। চেয়ারম্যানের বদল হলেও এখন পর্যন্ত ব্যাংকটি দাঁড়াতে পারেনি। এ নিয়ে বহু তদন্ত, অর্ধশতাধিক মামলা হলেও সাবেক চেয়ারম্যান আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
রিজার্ভ চুরি
ঘটনাটি ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ চুরির সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে বাংলাদেশ ব্যাংকে, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১০ কোটি টাকা) চুরি হয়। এখন পর্যন্ত চুরির অর্থের বড় অংশ ফেরত পাওয়া যায়নি, চুরির সঙ্গে জড়িতদেরও ধরা যায়নি। দায়িত্বে অবহেলার বড় উদাহরণ হয়ে আছে এই ঘটনা।
নিম্ন কর-জিডিপি হার
২০১০-১১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় ছিল প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর সর্বশেষ অর্থবছরে আদায় হয়েছে প্রায় ২ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। তবে যে কথা বলা হয় না তা হচ্ছে এখনো কর-জিডিপির অনুপাত হিসাবে তা বিশ্বের সর্বনিম্ন। এখন তা ১০ দশমিক ২ শতাংশ বলা হয়। বাংলাদেশের এই হার প্রতিবেশী দেশ নেপালের অর্ধেকের চেয়ে কম। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের কর-জিডিপি অনুপাতও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো।
অথচ প্রতিশ্রুতি ছিল
গত দশকজুড়েই বারবার বলা হয়েছে, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের পাট খাত। কিন্তু সেই ঘুরে দাঁড়ানো আর দেখা যায়নি। গত দশকে বহুল আলোচিত সাভারে চামড়াশিল্প নগরী হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো নানা জটিলতায় এর সুবিধা উদ্যোক্তারা পায়নি। একইভাবে বহু প্রতিশ্রুতি থাকলেও জাহাজ নির্মাণ খাত এগোতে পারেনি। আর অসাধু কর্মকাণ্ডসহ নানা কারণে সংকটে পড়ে আছে হিমায়িত চিংড়ি খাত।
সংস্কারের বিদায়
নব্বইয়ের দশক ছিল সংস্কারের দশক। পরের দশকেও কিছুটা সংস্কার হয়েছে। কিন্তু গত দশকটি ছিল সংস্কারকে বিদায় জানানোর দশক। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো দাতারা একসময় সংস্কারের সবচেয়ে বড় প্রচারক ছিল। তারাও এখন এ বিষয়ে আর সোচ্চার নয়। আগ্রহ নেই সরকারেরও। গত দশকটি ছিল সংস্কারকে বিদায় জানানোর বছর।
বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থার মৃত্যু
বাণিজ্য আলোচনায় কে জিতবে, কে হারবে—এ নিয়ে বহু বছর ধরে বিতর্ক কম হয়নি। গ্যাট আলোচনা শেষে ডব্লিউটিও হলো। তৈরি হলো নানা ধরনের বাণিজ্য জোট। বাণিজ্যের সব আলোচনাই ছিল বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার মধ্যে। আর দশক শেষে এসে দেখা যাচ্ছে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনা যেন মৃত্যুর দুয়ারে, বা আছে না থাকারই মতো।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প থোড়াই কেয়ার করেন এসব বাণিজ্য ব্যবস্থাকে। অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের উত্থান বিশ্ববাণিজ্যের মেরুকরণ অন্য রকম করে দিয়েছে। ফলে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা আবার ফিরে আসবে বলে এখন আর কেউ মনে করেন না।
আবার বিবিসি যেমনটি বলেছে, আরও একটি বিশ্বব্যবস্থার ইতি ঘটেছে। আর সেটি হচ্ছে সরবরাহ ব্যবস্থা। বড় বড় কোম্পানি নতুন একটি নীতি নিয়েছিল। যেখানে শ্রম সস্তা, পরিবেশ ভালো সেখানেই ছুটে গেছেন। আর তাই তো গাড়ি বা উচ্চ প্রযুক্তির বিভিন্ন পণ্যের একেকটি উপকরণ একেকটি দেশে উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু এখন নানা ধরনের শুল্ক আরোপ, পাল্টা ব্যবস্থার ফলে অন্য কোনো দেশ থেকে কোনো যন্ত্রাংশ তৈরি করে আনা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং একটা সহজ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও তা যেন ভেঙে যাচ্ছে।
বাণিজ্যযুদ্ধ
বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে একসময়ে বছরের পর বছর সামরিক যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। এখন আর সেই যুগ নেই। এখন যুদ্ধের ধরন পাল্টেছে।
এবারের যুদ্ধ শুরু করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপ করার পর যুদ্ধের শুরু। এরপর পাল্টা ব্যবস্থা নেয় চীন। আস্তে আস্তে এই যুদ্ধ প্রকট হয়। আর সেই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে নানা দিকে। সর্বশেষ ছড়িয়েছে প্রযুক্তি খাতে। চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে এর প্রধান শিকার।
এর বাইরে বোয়িং কোম্পানির দুর্দশা এবং ব্রেক্সিট ছিল এ সময়ের বিশ্ব অর্থনীতির আরও দুটি বিষয়। কোনো সন্দেহ নেই আরও বহু বছর ধরে এর রেশ থাকবে।
এই ছিল গত দশকের অর্জন ও বিসর্জন। এসব নিয়ে নতুন দশকে বিশ্ব এবং বাংলাদেশ কত দূর যেতে পারবে, সেটা এখন দেখার বিষয়।
কমেছে দারিদ্র্য
দরিদ্র দেশ হিসেবেও বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটি পরিচয় আছে। কেননা, এখনো বিশ্বের যে কয়টা দেশে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষ বাস করে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বিশ্বের মোট দরিদ্র জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ মানুষ বাস করে এই বাংলাদেশেই।
তবে দারিদ্র্য পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে গত কয়েক দশকে। এর মধ্যে গত দশকটি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত সাড়ে ৮২ শতাংশ মানুষ। ১৯৯১ সালে এই হার ছিল ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আর ২০১০ সালে এই হার কমে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ হয়েছে ২০১৬ সালে। ওই জরিপ অনুযায়ী দারিদ্র্য হার আরও কমে হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, ২০১৮ সালের জুন মাস শেষে এই হার কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১০ সাল নাগাদ এই হার ১৮ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারি
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ প্রথম দেখে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। পরের দশকটি ছিল কেলেঙ্কারিমুক্ত। এরপর আর খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। গত দশকের শুরুতেই, ২০১০ সালে আবারও ঘটে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। সর্বস্বান্ত হন বিপুলসংখ্যক সাধারণ বিনিয়োগকারী। এ নিয়ে তদন্ত হলেও প্রভাবশালী কারসাজিকারীরা এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন। আর শেয়ারবাজার এখনো অস্থিতিশীল। নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আস্থাহীনতা প্রবল থাকলে বাজার যে দাঁড়াতে পারে না, গত দশকটি ছিল তারই প্রমাণ।