রাশিয়ায় বহু সংস্কৃতি, জাতিগত, ধর্মীয়, এবং সামাজিক কারণে বিভিন্ন ধারায় নারীদের জীবন ভিন্ন ভিন্ন। নিম্ন শ্রেণীর কৃষক নারী থেকে একজন উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শহুরে পরিবারে নারীর জীবন ভিন্ন হতে পারে। তবু সাধারণ ভাবে সকল নারীকে এক কাতারে ফেলা যায় ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।
রাশিয়ার উপ প্রধানমন্ত্রী ওলগ গোলডেটস ২০১৭ সালে বলেছিলেন যে, এখানে পুরুষের চাইতে নারীর শিক্ষা হার বেশি। উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি রয়েছে ৩৭ শতাংশ নারীর। অন্যদিকে পুরুষ ২৯ শতাংশ ।
তারপরও উচ্চ বিদ্যালয়ে ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে নারীর হার বেশি থাকলেও চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য এখনও বিদ্যমান।
এমনকি নারীর উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি পুরুষের তুলনায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও নারীর মজুরি পুরুষের চেয়ে কম। নারীর মজুরি পুরুষের গড় বেতন ৭৩ শতাংশ ।
রাশিয়ায় বিপ্লবের আগে ধনী নারীদের কাছে সীমিত শিক্ষার সুযোগ ছিল। আর গ্রামে কৃষক নারীদের বেশির ভাগ শিক্ষিত ছিলেন না। গ্রামে নারীদের জীবন আরো কঠিন ছিল। তাদের জীবন প্রচুর শ্রমে ভরা ।
গ্রামে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে নারীদের মূল্য দেয়া হয় কে কতটা ভাল কাজ করতে পারে, তার উপর । রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া , উলের পোশাক তৈরি করা, পরিবারের জন্য ঘরদোর পরিষ্কার তো আছেই।
বাইরে স্বামীর সাথে আগাছা কাটা, জল সংগ্রহ করা, ফসল রোপণের সময় এবং ফসল সংগ্রহ ও প্রস্তুত করায় নারীদের অগ্রাধিকার ছিল।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা
রাশিয়ান মেয়েদের বর্তমান বিয়ের বয়স ১৮ থেকে শুরু। কিন্তু আঠারো শতকের প্রথম দিকে মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ছিল ১২ । পরিবারের সম্মতি ছাড়া বিয়ে করা ছিল অসম্ভব ।
বিধবা বা অবিবাহিত নারীদের বিয়ে করার আগে গ্রামে সমাবেশ করে অনুমতি নিতে হতো। সমাজ দৃঢ়ভাবে পিতৃতান্ত্রিক ছিল এবং সকল পটভূমিতেই নারীদের ১৯১৭ সাল পর্যন্ত ভোট দেয়া বা পাবলিক অফিসে রাখার অনুমতি ছিল না।
অথচ অবাক হবার মতো ঘটনা হলো ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে জানা যায় রাশিয়ায় ৪১ শতাংশ নারী বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিয়োজিত।
তবে আপনি জানলে অবাক হবেন যে, রাশিয়ার মত উন্নত দেশে নারী যেখানে বাস চালানো থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিয়োজিত, সেখানে উইমেনহুড অর্থাৎ নারীত্ব বিষয়ে বিদ্যালয় আছে, যেখানে একজন নারীকে পারফেক্ট গৃহবধূ হতে শেখানো হয়।
মস্কোতে ‘উইমেন ইনসাইড’ নামে একটি স্কুল আছে সেখানে নারীদের তাদের স্বামীদের কাছে সুন্দর থাকা, সুন্দর ব্যবহার করা এবং গৃহকর্মের নানারকম কোর্স করানো হয়।
এইসব স্কুলগুলো বিশ্বাস করে, পুরুষরা সমাজের সুরক্ষক আর নারী তত্ত্বাবধায়ক। তারা নারীদের এমন ভাবে শিক্ষা দেন এবং মনে করেন সবচেয়ে সফল যুবতী তারাই যারা পুরুষদের স্বপ্ন সার্থক করতে পারে।
সে যাই হোক, রাশিয়া এখনো খুব রক্ষণশীল সমাজ।
নারী-পুরুষের যদিও আর্থিক ভাবে সমান অধিকার আছে তবু সেখানে স্পষ্টভাবে কিছু রোলস রয়েছে যা পুরুষদের থেকে নারীকে অবদমিতই করে রাখছে।
রাশিয়াতে কর্মরত জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ নারী। সোভিয়েত আমলের মতোই বেশিরভাগ নারী শ্রমিক চিকিৎসা, শিক্ষা, কেরানি কাজের মত স্বল্প মজুরির কাজে আটকা পড়ে আছেন। পার্থক্য হলো সোভিয়েত যুগের ডে কেয়ার শিশু ভাতা এখনো আছে তবে কেবল নামমাত্র, এগুলা মোটেই যথেষ্ট নয়।
চাকুরিক্ষেত্রে পেনশনের বয়স নারীদের জন্য পঞ্চান্ন। তবে পেনশন খুব কম যার ফলে বৃদ্ধ মহিলারা এখনও বৈরি আবহাওয়াতেও কাজ করে খান। মাইনাস ১০/১৫ তে শীতের সন্ধ্যাবেলা কত বৃদ্ধাকে দেখেছি মেট্রোর সামনে লিফলেট বিলি করতে, অনেক বাবুশকা সাত সকালে নিজের বাগানের সবজি, এক ঝুড়ি ফল, মাটি লাগানো আলু বা বিট নিয়ে বসে থাকে বিক্রির উদ্দেশ্য।
আবার কেউ কেউ পরম যত্নে নিজের হাতে বোনা উলের জামা, মোজা, মাফলার নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে আসে বিক্রি করতে। শীতের দেশে জীবন আসলেই কষ্টের।
মাঝে মাঝে মনে হয় এর চেয়ে আমাদের দেশে নানী-দাদীরাই ভালো আছেন। হামান দিস্তায় পান ছেঁচে আয়েশ করে মুখে পুরে নাতি নাতনীদের রাক্ষস-খোক্কসের গল্প শোনায়।
সবখানেই নানী-দাদীদের এই আদর আছে নাতি নাতনির জন্য। এখানে রুশ মেয়েরা খুব দ্রুত বিয়ে করে বাচ্চা নিয়ে নেয় । আর বাচ্চা নেয়ার জন্য অন্যরকম আগ্রহ কাজ করে এদের।
ভারভারা আর তাতানিয়া
আঠারো বছর পার হবার পর পরই পরিবার থেকে বিয়ের চাপ দেয়া হয়। ভারভারা আমাদের রুশ ভাষার টিচার। ওর বয়স বাইশ। কিন্তু তার মা বাবা তাকে নিয়ে চিন্তিত -কবে বিয়ে করবে, কবে তারা নাতি নাতনীর মুখ দেখবে।
আর তাতানিয়া আমার ক্লাসমেট যার ‘এইম ইন লাইফ’ হচ্ছে অনেক বাচ্চার মা হওয়া। মা হতে পারাটা তাদের জন্য আনন্দের। এখানে তাই অনেক কম বয়সেই মেয়েরা তিন চার বাচ্চার মা হয়ে যায়।
আর তাই ‘বাবুশকা’দের বয়সও তুলনামূলক কম। বলা হয়ে থাকে রাশিয়ান নারীরা ত্রিশ বছরের আগ পর্যন্ত সুন্দরী থাকে, ত্রিশে বুড়ি। ত্রিশের পর তারা বাবুশকা (দিদিমা)তে পরিণত হন।
এদেশে বাবুশকা একটি পরিবারে ভাইটাল রোল প্লে করেন। বাবুশকা একটি পরিবারের জীবনীশক্তি। পরিবারকে একত্রে রাখা, প্রত্যেক সদস্যের আরাম আয়েশ নিশ্চিত করা, সংসারের তত্ত্বাবধান করা, সদস্যদের সমস্যা সমাধান করা, সর্বক্ষেত্রে বটবৃক্ষের মতো আগলে রাখেন বাবুশকা।
জেলি, জুস, কাশা, বিন্নি ,তর্ত, নানারকম ট্র্যাডিশনাল খাবার বানানো , নাতি নাতনীদের পার্কে ঘুরতে নেয়া ,পোষা বিড়াল কুকুরের যত্ন নেয়া সমস্ত কাজ এই বাবুশকারা করেন। পরিবারের কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছেন বাবুশকা।
এখানকার পার্কগুলোতে খুব কমন দৃশ্য বাবুশকা, মা আর সাথে নানা সাইজের ছানাপোনা সহ প্যারামবুলেটরে ছোট্ট সদস্যটিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাঝেসাঝে বাবা আর দেদুশকাদের (দাদা)ও দেখতে পাওয়া যায়। রুশ পুরুষদের কেয়ারিং এবং ভালোবাসা দেখে বোঝার উপায় নেই রাশিয়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
এদেশে বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী তাদের নামের সারনেইম শেয়ার করতে পারেন। তবে শুধু স্বামীর নামই নয়, স্ত্রীর সারনেইমও স্বামী চাইলে ব্যবহার করতে পারেন। আর পরিবারের ক্ষেত্রে রাশিয়াতে প্রত্যেক শিশুর একটি করে নাম দেয়া হয় - ডাক নাম আর ফেমিলিয়া অর্থাৎ ফ্যামিলি টাইটেল। যা তার বাবার নাম থেকে প্রাপ্ত।
পুরুষতান্ত্রিকতার গ্যাঁড়াকল
মেয়েদের ক্ষেত্রে নামের শেষে ‘আভোনা’ ‘ইভোনা’ (ডটার অব) আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ‘ভিচ’(সন অব) যোগ হয়। যেমন, মাশা, তার বাবার নাম ইভান পুশকিন। তাহলে মাশার নাম হবে ‘মাশা ইভানাভোনা পুশকিনা’(ইভান পুশকিনের কন্যা মাশা) মাশার ভাইয়ের নাম আরতম; সাথে ফ্যামিলি নেইম যুক্ত হবে আরতম ইভানোভিচ পুশকিন(ইভান পুশকিনের পুত্র আরতম)। অফিসিয়ালি রুশরা তাদের ডাক নামের চেয়ে ফ্যামিলিয়াকে বেশি প্রাধান্য দেয়।
রুশ নারী অগ্রসর এবং স্বাধীন হলেও এখনো রক্ষণশীলতার বেড়াজালে আবদ্ধ।
রাশিয়ান নারীরা নিজেদের গর্বিত মনে করে সম্পদ ও পরিশ্রমের জন্য। এদেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার খুব বেশি । নারীদের স্বাধীনভাবে চলা আর স্বনির্ভরতার কারণে বিচ্ছেদ বেশি।
বেশিরভাগ বিচ্ছেদ নারীদের দ্বারাই হয়। আর কিছু সংখ্যক পুরুষ নিজ থেকে বিচ্ছেদ নেয় কারণ তারা বেশি যোগ্য নারীদের সাথে বসবাস করায় পেরে উঠে না।
তবে রাশিয়ান সিঙ্গেল মায়েদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা। যারা তাদের সন্তানদের জন্য বাবার কাছ থেকে কোন সহায়তা পান না তারা সরকারিভাবে সুযোগ সুবিধা পান।
শাকিলা সিমকীমস্কো থেকে বিবিসি থেকে সংগৃহীত
আর ঘরে বাইরে নারীরাই সব কাজ করেন। পুরুষরা মাতাল হয়ে পড়ে থাকা আর বউকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া আসলেই তেমন কোন কাজ করে না। অথচ তবুও অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে এদেশের নারী স্বনির্ভর হয়েও পুরুষতান্ত্রিকতার গ্যাঁড়াকলে।