২০১৮ সালের ‘দুই অধিবেশন’ চলাকালে, জাতীয় গণকংগ্রেসের প্রতিনিধি চু ইউ ইয়ং হাতে একটি বড় আলু নিয়ে, গণমহাভবনে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদেরকে দারিদ্র্যবিমোচনের গল্প শোনান। তিনি বলেন, সাধারণ আলু একটি হাঁসের ডিমের সমান। কিন্তু তাঁর দেখানো পথে কৃষকরা উটপাখির ডিমের মতো বড় আলু উত্পাদন করছেন। সবচেয়ে বড়টার ওজন আড়াই কেজির মতো! শীতকালে আলুচাষের মাধ্যমে সীমান্তের দরিদ্র গ্রাম দারিদ্র্যমুক্ত হয়।
৫ বছর আগে, চীনে শুরু হয় টার্গেট-ওরিয়েন্টেড দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প। চায়না ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমি চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের একটি গুরুতর দরিদ্র জেলা লান ছাং-কে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার প্রকল্প গ্রহণ করে। এ-জেলার দরিদ্র লোকসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০। অন্যভাবে বললে, তখন জেলায় দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১। চায়না ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমিতে আয়োজিত এক সেমিনারে ৬০ বছর বয়সী চু ইউ ইয়ং এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ও তার সহকর্মী প্রথমে জেলা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে যে-দৃশ্য তার চোখে পড়ে, তা তার ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দেয়।
১৯৫৫ সালে চু ইউ ইয়ং ইয়ুননান প্রদেশের হং হ্য হানি জাতি ও ই জাতি স্বায়ত্তশাসিত এলাকার একটি গ্রামীণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় দারিদ্র্য ও ক্ষুধা তার মনে গভীর ছাপ ফেলে।
নিজের প্রচেষ্টায় কৃষকরা ভাল জীবন যাপন করবে, ভালো ফসল ফলাবে—একসময় এটা তার স্বপ্নে পরিণত হয়। তার মতে, লান ছাং জেলার প্রাকৃতিক পরিবেশ ভাল; রোদ, তাপ,পানি ও জমি ভাল। তবে জেলার বাসিন্দাদের অধিকাংশ দরিদ্র। শুরুতে, যখন তারা কৃষকদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, তখন কৃষকরা শুধু তাদের কাছে অর্থ সাহায্য চাইতেন। কৃষকরা তাদের বলতেন, “আমাদেরকে কিছু টাকা দিলে দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারতাম।” তখন চু ইউ ইয়ং বুঝতে পারেন যে, গ্রামবাসীদের ধারণা পরিবর্তন না-হলে তাদেরকে দারিদ্র্যমুক্ত করা যাবে না।
গ্রামবাসীদের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করার জন্য চু ইউ ইয়ং ‘লা হু’ জাতির ভাষা শিখতে শুরু করেন এবং আড্ডা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে বন্ধুর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। গ্রামবাসীরা তখন তাদের নতুন বন্ধুর কথা মন দিয়ে শুনতে শুরু করেন। চু ইউ ইয়ংয়ের পরবর্তী কর্তব্য হল একটি দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা। তিনি দেখলেন, লা ছাং জেলায় আখরোট ও গোলমরিচের চাষ হয়। তবে আখরোটের ফলন কম এবং চীনের অন্য জায়গার গোলমরিচের মান আরও ভাল। তাই এ দুটি ফসল নিয়ে এগুনোর চিন্তা তিনি পরিত্যাগ করেন। তিনি জেলার জলবায়ু, জমি, বৃষ্টিপাতসহ নানান প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে বেশ গবেষণা করেন এবং একটি বিকল্প উপায় বের করেন। বিকল্পটি হচ্ছে: শীতকালীন আলু ও শাকসবজি চাষ!
শীতকালীন আলু প্রতিবছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে চাষ শুরু করা হয় এবং পরিবর্তী বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে ফসল ঘরে তোলা যায়। এ সময়ে চীনে খুব কম জায়গায় তাজা আলু পাওয়া যায়। এর মানে তখন লেন ছাং জেলার আলু বাজারে আসবে এবং দামও তুলনামূলকভাবে বেশি পাবেন কৃষকরা। এক মু জমিতে আলুর চাষ করে ঠিক ১০০ দিন পর ১০ হাজার ইউয়ান আয় করতে পারবেন তারা। চু ইউ ইয়ং ও তার সহকর্মীরা গ্রামবাসীদেরকে আলু চাষের সুবিধার কথা বোঝালেন। শুরুতে কৃষকদের মনে সন্দেহ দেখা দিল।
২০১৬ সালের শীতকালে দারিদ্র্যবিমোচন কর্মদল লিউ চিন পাও নামের একজন কৃষকের কাছে আসে এবং তাকে আলু চাষে রাজি করাতে চেষ্টা করে। লিউ চিন পাও রাজি হন। তবে পরের দিনই তিনি আগের মতো ক্ষেতে অন্য ফসল চাষ করেন। এ অবস্থায় কর্মদল গ্রাম-প্রধানের কাছে সাহায্য চায় এবং বিশেষ পরীক্ষা চালানোর জন্য কিছু জমি পায়। তারা ১০০ মু পরিমাণ জমিতে আলু চাষ করেন এবং ২০১৭ সালের বসন্তকালে প্রতি মু জমি থেকে ৩ টনের বেশি আলু তুলতে সক্ষম হন, যার বাজারমূল্য ১০ হাজার ইউয়ান।
এ খবর শুনে লিউ চিন পাও আলু চাষ শুরু করেন এবং তার ক্ষেতেই আড়াই কেজি ওজনের বড় একটি আলু উত্পাদিত হয়। ২০১৮ সালে লিউ চিন পাও তার সব ক্ষেতে আলু চাষ করেন। সে বছর সারা লান ছাং জেলায় ৩২০০ মু’র বেশি জমিতে আলু চাষ করেন কৃষকরা।
আলুর চাষ শুধু একটি সূচনা মাত্র। চু ইউ ইয়ংয়ের সাহায্যে লান ছাং জেলার কৃষকরা পাইন বনে সান ছি নামের একটি ঐতিহ্যিক চীনা ঔষধি গাছের চাষ শুরু করেন। পরে এটি লান ছাং জেলার মূল শিল্পে পরিণত হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে লান ছাং জেলায় দরিদ্র লোকের সংখ্যা ৩ শতাংশের নীচে নেমে আসে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দারিদ্র্যবিমোচনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এই জেলা।
দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। চু ইউ ইয়ং চীনে প্রথম চায়না ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমিতে ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দারিদ্র্যবিমোচন’-এর কৌশল শেখাতে শুরু করেন। তার শিক্ষার্থীদের সবাই ছিলেন কৃষক। চায়না ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমির বিশেষজ্ঞরা সরাসরি কৃষকদের ক্লাস নিতে ও তাদেরকে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি শেখান। এই শিক্ষা অনুসারেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকরা জমিতে ফসল চাষ করতে থাকেন। চু ইউ ইয়ং একে একে ২৪টি প্রশিক্ষণ-ক্লাস আয়োজন করেন এবং ১৪৪৫ ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ চাষী হিসেবে গড়ে তোলেন। তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ পরে দারিদ্র্যমুক্ত হন এবং অর্ধেক মানুষ নিজেদের পরিবার ও স্বজনকে দারিদ্র্যমুক্ত হতে, এমনকি সারা গ্রামের দারিদ্র্যবিমোচন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করতে থাকে।
মা চেং ফা শিক্ষার্থীদের একজন। তার শেষ পরীক্ষা ছিল আলু চাষ। তিনি ক্লাসের সবার চেয়ে বেশি আলু চাষ করেন এবং তার উত্পাদিত আলু ৭ হাজার ইউয়ানে বিক্রয় হয়। সবচেয়ে বড় আলু উত্পাদনের জন্য মা চেং ফা বিশেষ পুরস্কার ও ৫ হাজার ইউয়ান বোনাস পান। তার গ্রামের মানুষ তার দেখাদেখি আলু চাষ শুরু করে এবং চলতি বছরেই (২০১৯) সবাই দারিদ্র্যমুক্ত হয়।
চলতি বছরের ১১ নভেম্বর প্রথম চায়না ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমির ই-কমার্স ক্লাস শুরু হয়। চু ইউ ইয়ং এ ক্লাসে কৃষকদের অনলাইন দোকান খোলার কৌশল শিখিয়ে দেন। এর ফলে তারা নিজেরাই এ দোকানের মাধ্যমে কৃষিপণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রয় করতে পারবেন।
১৯৯৬ সালে, সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে করে, ইয়ুননান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন চু ইউ ইয়ং। তিনি বলেন, নিজের দেশে ফিরে নিজের জন্মস্থানে কিছু করতে পারা তার জন্য সবচেয়ে অর্থবহ একটি ব্যাপার। ২০১১ সালে, মনোযোগ দিয়ে গবেষণা করার স্বার্থে, তিনি ইয়ুননান কৃষি বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রধানের দায়িত্ব ত্যাগ করেন। তিনি কৃষিবিদ হিসেবে অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি জাতীয় শ্রেষ্ঠ পেশাবিদ ও প্রযুক্তিবিদের পুরস্কার পেয়েছেন, পেয়েছেন জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের তকমা। তবে তিনি ‘কৃষিবিদ’ তকমাটিই বেশি পছন্দ করেন। তিনি সবসময় ব