সরকারপ্রধানের শপথ নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীরা সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেই তিনি কীভাবে সরকার পরিচালনা করবেন তার নির্দেশনা দেন। এটাই দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়ে সচিবদের সঙ্গে বৈঠক না করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শন শুরু করেন শেখ হাসিনা। শপথ নেওয়ার ১০ দিনের মধ্যে তিনি প্রথম বৈঠক করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সেখানে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের বার্তা দেন। সেই বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার দাবি করা হলেও কীভাবে তা কার্যকর করা হবে তা চূড়ান্ত করতে পারেনি ২ বছর ৫ মাস ৫ দিন পরও। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোট ১৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এসব নির্দেশনার মধ্যে মাত্র চারটি বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলো বাস্তবায়ন হয়নি, যা প্রায় ৭২ শতাংশের কাছাকাছি। প্রশাসনিকভাবে অবাস্তবায়িত এসব নির্দেশনা চলমান বা প্রক্রিয়াধীন দেখানো হচ্ছে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন। তার ওই সময়ে দেওয়া চারটি নির্দেশনাও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি ২০১৩ সালের ২ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দেওয়া তার নির্দেশনা এখনো অবাস্তবায়িত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কোনো প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলে জমির মালিকদের পরিবারের সদস্যদের ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য একটি নীতিমালা করতে। পরে একই নির্দেশনা দেন ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত একনেক সভা থেকেও। এ বিষয়ে এখনো কোনো নীতিমালা চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে গত ২৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্ব একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। ওই সভার কার্যবিবরণী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা বিভাগে পাঠানো হয়। প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠানের জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি পরিকল্পনা বিভাগের আওতাধীন এ কারণে তা সেখানে পাঠানো হয় বলে জানা গেছে। বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পেন্ডিং কাজের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্যও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অনুরোধ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি কী জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিছু নির্দেশনা আছে যেগুলো বাস্তবায়নে সময় লাগবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্স অবস্থান। আমরা প্রধানমন্ত্রীর এ বার্তা সর্বত্র পৌঁছাতে পেরেছি।’
প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে জনপ্রশাসন সচিবের নেতৃত্ব নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সালে পরিদর্শনের সময় জনপ্রশাসন সচিব ছিলেন ফয়েজ আহম্মদ। বতর্মানে তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য। সরকারি চাকরি থেকে তার বিদায়ের পর জনপ্রশাসন সচিব হন শেখ ইউসুফ হারুন। তিনিও সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। গত ২১ জুন তাকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে জনপ্রশাসন সচিব কেএম আলী আজম। তারা প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করেছেন। কেএম আলী আজম গত ৩১ মে যে বৈঠক করেন তা আগের বৈঠকের ধারাবাহিকতা মাত্র। এ বৈঠকের কার্যবিবরণীর তথ্যও প্রায় আগের সচিবদের স্বাক্ষরিত কার্যবিবরণীর অনুরূপ। অর্থাৎ কার্যবিবরণীতে পরিবর্তন সামান্যই।
২০১৯ সালে ১৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও জনসেবার মান উন্নয়নের জন্য বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। সরকার সরকারি কর্মচারীদের জন্য বেতনভাতা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এতটাই বৃদ্ধি করেছে যে, তাদের আর দুর্নীতি করার কোনো কারণ নেই। এরপরও কেউ দুর্নীতি করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই বার্তা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে।’
৩১ মে অনুষ্ঠিত সভায় জানানো হয়, এ বিষয়ে একটি বিস্তৃত ধারণাপত্র তৈরি করা হয়েছে। ধারণাপত্রটি নীতিগত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মাঠপ্রশাসনসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিস্তৃত ধারণাপত্র ছোট করার জন্য সাবেক সচিব ফয়েজ আহম্মদের সময়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ প্রণয়নেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই বিষয়টিকে চলমান কাজ হিসেবে দেখাচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
প্রধানমন্ত্রী কর্মকর্তাদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের জন্য কক্সবাজারে ৩০০ একর জায়গার ওপর সিঙ্গাপুরের মতো একটি আন্তর্জাতিক মানের ট্রেনিং হাব হিসেবে বঙ্গবন্ধু সিভিল সার্ভিস প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণের নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজারে ৭০০ একর পাহাড় ও ছড়া শ্রেণির জায়গা খুঁজে বের করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত বন্দোবস্ত প্রস্তাব কক্সবাজারের ডিসির কাছে পাঠানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের প্রতিবন্ধী সন্তানদের পুনর্বাসনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চেয়েছিলেন। বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত কোনো রূপ নেয়নি। কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড মতিঝিলের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশে প্রতিবন্ধী সন্তানদের পুনর্বাসনে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী করার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দিয়েছে। বিষয়টি এখনো চিঠি চালাচালির মধ্যেই রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া গাজীপুরের ভাওয়াল এস্টেটের ১৯ একর জমি এ কাজে ব্যবহার করতে দীর্ঘমেয়াদি লিজের একটি প্রস্তাব ভূমি সংস্কারের বোর্ডের বিবেচনায় রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সব ক্যাডারের জন্য ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এবং প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে একটি ধারণাপত্র তৈরি করতে বলেছিলেন। সব ক্যাডারের জন্য ক্যারিয়ার প্ল্যানিং তৈরি করে একটি ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও এ পর্যন্ত মাত্র সাতটি ক্যাডারের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং নীতি পাওয়া গেছে।
প্রধানমন্ত্রী একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে খন্ড খন্ড প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রচলিত ব্যবস্থা পরিহার করতে বলেছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ককে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বিষয়টিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত সচিবের (সিপিটি) নেতৃত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি কাজ করছে বলে জানা গেছে।
সিভিল সার্ভিসের মেধাবী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ একাডেমিতে পোস্টিং দেওয়ার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রশিক্ষণ একাডেমিতে কাজ করার আগ্রহ সৃষ্টির জন্য প্রণোদনা বাড়ানোর মাধ্যমে কীভাবে পদায়নকে আরও আকর্ষণীয় করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলেছেন তিনি। প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে কর্মরতদের বিশেষ ভাতা বর্তমান বেতন স্কেলের ৫০ ভাগ অথবা ২০০৯ সালের স্কেল অনুযায়ী ৩০ শতাংশের স্থলে ১০০ শতাংশ করার একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে করা মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেন। এজন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে সরকারপক্ষে মামলার ফলাফল পাওয়ার জন্য আলাদাভাবে অ্যাডভোকেট নিয়োগসহ একটি ফান্ড গঠন করার নির্দেশনা দেন। সরকারের মামলা আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন করার বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় রয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে সর্বশেষ বৈঠকে বলা হয়েছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনার জন্য প্যানেল অ্যাডভোকেট নিয়োগ দ্রুত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে প্রয়োজনীয় নার্স ও চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন। একটি সর্বাধুনিক ও মানসম্মত ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল উপযোগী নিয়োগবিধি প্রণয়ন, পদ সৃষ্টি, পরিকল্পিত সাংগঠনিক কাঠামো প্রণয়ন ও অফিস সরঞ্জামাদি টেবিল অন অর্গানোগ্রাম অ্যান্ড ইক্যুপমেন্ট (টিওঅ্যান্ডই) অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
মাঠপ্রশাসন থেকে আসা কর্মকর্তাদের ঢাকায় থাকার জন্য সুবিধা বাড়াতে বহুতলবিশিষ্ট সার্কিট হাউজ ও ডরমিটরি নির্মাণের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এ ব্যাপারে ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
২০১৫ সালের নির্দেশনা : সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের জমিতে ৩০ তলা ভবন নির্মাণের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সরকারেরই একটি সংস্থা কল্যাণ বোর্ডের দিলকুশায় এ ভবন নির্মাণে আপত্তি জানায় এবং ১২ তলা ভবন নির্মাণ করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কল্যাণ বোর্ড ৩০ তলা ভবনই নির্মাণ করার জন্য চিঠি চালাচালি করছে।
ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের পশ্চিম পাশের বহুতল ভবন নির্মাণ করে নিচতলায় মেরামত কারখানা, ওপরে পার্কিং এবং তার ওপরের তলাগুলোকে অফিস নির্মাণের নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এ নির্দেশনার ছয় বছর ছয় মাস পার হয়ে গেলেও ভবন নির্মাণে হাত দিতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। এ সংক্রান্ত নকশা তৈরির পর তা সংশোধন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সরকারের প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য নৌযান মেরামত করতে নৌযান মেরামত কারখানা নির্মাণ করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। খুলনায় স্থান নির্বাচন করা হলেও তা দখলদারদের দখলে ছিল। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য দফায় দফায় তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। ওই ভূমির স্থাপত্য নকশা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হলেও তার আগে চারপাশে সীমানা দেয়াল নির্মাণ করা দরকার। সেজন্য নিরাপত্তা প্রাচীর গার্ডরুম তৈরির জন্য গণপূর্তকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বরিশালে কীর্তনখোলা নদীর ধারে নৌযান কারখানা নির্মাণের জন্য বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার প্রস্তাব দিয়েছেন। তাকে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের অনুকূলে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বিপিএটিসির জন্য চারটি বাস, তিনটি মিনিবাস সরবরাহের নির্দেশ দেন ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল। নির্দেশনার ১১ বছর পার হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আগামী জুলাইয়ের পর গাড়ি কেনার ব্যবস্থা হবে বলে জানা গেছে।