নিজস্ব প্রতিবেদন :
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯-১০ সাল নাগাদ দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ও বিকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন ২০২১’ ঘোষণা করেন।
যখন সারা দেশে সীমাহীন বিদ্যুৎ সংকট চলছিল, বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের অসম্ভব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে দেশরত্ন শেখ হাসিনা এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তখন তা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা বাস্তবে পরিণত করেছেন। এরই সুফল হিসেবে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সরকার যে রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেছিল, সেই ঘোষণার আলোকে এরই মধ্যে জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা, মোবাইল মানি ট্রান্সফার, বিমানের টিকিট, ই-টেন্ডারিংসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ আর কেউ প্রশ্ন করে না—ডিজিটাল বাংলাদেশ কী? কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো তথ্য-প্রযুক্তি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। যেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সব সুবিধা ব্যবহার করে অল্প সময়ে কম পরিশ্রমে, স্বল্প ব্যয়ে মানুষের দোরগোড়ায় তথ্য ও সেবা পৌঁছানোর নিশ্চয়তা প্রদান করে।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ পরিণত হয়েছে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর মেরুদণ্ড হিসেবে। আইসিটির ব্যবহারে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে মানুষ খুঁজে পেয়েছে বাঁচার অবলম্বন। অনেকেই প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও আয় করছেন।
ডিজিটাল উপকূল:
একসময় উপকূলীয় জনপদ মানেই ছিল সন্ধ্যার পর ঘুঁটঘুঁটে আঁধার। দুর্গম চর আর গ্রামের মেঠোপথ ছিল পথচারীর আতঙ্ক। গ্রামের হাট থেকে বাড়ি ফিরতে হতো দলবেঁধে। টর্চলাইট আর হারিকেনই ছিল যাত্রাপথের ভরসা। সেদিন ফুরিয়েছে। এখন টর্চলাইট-হারিকেন দেখাই যায় না। উপকূলীয় জনপদে এখন জ্বলছে স্ট্রিট লাইট। সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত প্রতিটি গ্রাম। সন্ধ্যা নামলেও সড়ক, হাট-বাজার ও মেঠোপথ থাকে আলোয় আলোয় ভরা।
ভোলার জনপদ চরফ্যাশন। সৌর বিদ্যুতের আলো এখানকার প্রতিটি জনপদে। গ্যাসচালিত বিদ্যুতের ওপর চাপ কমাতে উপজেলার হাট-বাজারসহ রাস্তার পাশে স্থাপন করা হয়েছে এলইডি স্ট্রিট লাইট। সন্ধ্যা নামতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠছে বাতি। লোড শেডিংয়ের ঝামেলা নেই। বাতিগুলো আলো দেয় সারা রাত। এতে কমেছে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ।
সাগরে বসেই অনলাইনে মাছ বিক্রি করছেন জেলেরা,সোলার এনার্জিতে চলছে ট্রলার
ভোলার মনপুরা ঘাট থেকে মাছ ধরার জন্য সাগরের দিকে যাত্রা শুরু করেন নাসির উদ্দিন মাঝি। ট্রলারজুড়ে লাল নীল বাতি। যাতে রাতের বেলায় দূর থেকে অন্য ট্রলার দেখতে পায় তার অবস্থান। এই বাতির বিদ্যুৎ আসছে ট্রলারে থাকা সোলার প্যানেল থেকেই। স্মার্টফোনে খবরও পড়েন তিনি। মাঝেমধ্যে ব্যবসায়িক-পার্টনারসহ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলেন। সন্তানরা পড়ছে কিনা সেটা রীতিমতো তদারকি করেন ভিডিও কলে!
তিনি বলেন, “এক সময় পরিবার থেকে কয়েক সপ্তাহের জন্য বিদায় নিয়ে সাগরে যেতাম। কখন কোন বিপদ আসে বলা যেতো না। সাগর উত্তাল দেখলে বাড়ির মানুষ থাকতো উদ্বিগ্ন। এখন আগের দিন নেই। প্রতি মুহূর্তেই বাড়িতে কথা হচ্ছে। আবার মাছ ধরে সাগরেই বিক্রি করে দিচ্ছি। ঢাকার আড়তদাররা ছবি ও ওজন দেখে মাছের দাম পাঠিয়ে দিচ্ছেন মোবাইল ওয়ালেটে।’
দ্বীপাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের প্রতিদিনের সঙ্গী ট্রলার
তিনি আরও বলেন, ‘একসময় রাত হলে অন্ধকারেই থাকতাম। হারিকেন আর ফানুস জ্বালিয়ে বসে থাকতে হতো। সামান্য বাতাসে এগুলো নিভে যেতো। এখন সেই ভয় নেই। রাত হলেই সৌরবাতি জ্বলে। প্রত্যেক নৌকায় সোলার প্যানেল আছে। মোবাইল চার্জ থেকে শুরু করে সবই করতে পারছি।’
শুধু নাসির নন, উপকূলীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ জেলেই এখন ডিজিটাল। রাতে তাদের ট্রলার আলোকিত থাকে সৌরবাতিতে। চার্জ হয় স্মার্টফোনেও।
শহরের মানুষের পাশপাশি দুর্গম উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেদের মাঝেও সরকারের ডিজিটালাইজেশনের হাওয়া লেগেছে। মাছ ধরতে বাড়িঘর ছেড়ে অনেক সময় একমাসও সাগরে থাকতে হয় তাদের। তখন ট্রলারে বসেই মোবাইল ফোনে চার্জ দিতে পারছেন, ব্যবহার করতে পারছেন ইন্টারনেট। আবার ট্রলারে বসেই ঢাকাসহ বিদেশের বাজারের মাছের দাম জানতে পারছেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশের অনন্য উদাহরণ একসময় আকাশের তারা আর কম্পাস দেখে দিক ঠিক করতে হতো জেলেদের। এখন স্মার্ট ফোনে রীতিমতো মানচিত্র দেখতে পান। দুর্যোগ আসন্ন থাকলে সতর্ক সংকেত জানতে পারছেন সঙ্গে সঙ্গেই। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন কমিউনিটি রেডিওসহ বহাওয়ার খবরও পাচ্ছেন ফোনে। এতে সমুদ্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আগের চেয়ে প্রাণহানির ঘটনা অনেক কমে এসেছে অনেক।
উপকূলীয় অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, বড়ধরনের নৌযানগুলোতে একসময় জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। তাতে খরচ পড়তো বেশি। এখন সোলার প্যানেলে দিনরাত বিদ্যুতের সুবিধা পেলেও লাগছে না কোনও জ্বালানি।
দুর্যোগকালীন জেলেদের সতর্কবার্তা পৌঁছে দিতে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক সম্পন্ন কমিউনিটি রেডিও স্থাপন করেছে দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা। এর নাম রেডিও সাগর দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকাজুড়ে এর নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। অতোদূর আবার মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক পৌঁছায় না। সেখানে এই রেডিওই তাদের ভরসা।
দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রফিকুলের ভাষ্য মতে, ‘বঙ্গোপসাগরের ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার এলাকা তাদের নেটওয়ার্কের আওতায় রয়েছে। মোবাইল ফোনে জেলেরা প্রতি মুহূর্তের খবরাখবর জানতে পারছে।’
জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় তথ্য অফিসের পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, ‘ট্রলারে বসেই ঢাকার মাছের বাজারের খোঁজ নিচ্ছেন তারা। সাগর পাড়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক সম্পন্ন টাওয়ার রয়েছে। কমিউনিটি রেডিওগুলোও কাজ করছে বেশ।’
খবর পেতে দিন গুনতে হয় না তাদের
খবর পেতে দিন গুনতে হয় না তাদের।
বছর দুয়েক আগেও এ দ্বীপের মানুষকে খবর দেখতে বাজারের দোকানে রাত ৮টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো টেলিভিশন দেখতে। ৫ মিনিটের খবর দেখতে দিতে হতো ৫-১০ টাকা। ছাপা কাগজের খবর পড়তে অপেক্ষা করতে হতো সপ্তাহ। সেই দ্বীপের চিত্র আমূল বদলেছে। সহজলভ্য ইন্টারনেট আর স্মার্ট ফোনের কল্যাণে মিলছে দেশ-দুনিয়ার সব খবর, মুহূর্তেই। বলছিলাম, নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার কথা।
হাতিয়ায় এখন সবার হাতেই স্মার্ট ডিভাইস। খবর তো পাচ্ছেনই, বিদেশে থাকা স্বজনদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথাও বলছেন দ্বীপবাসী।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারের বিচ্ছন্ন দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী। জেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কক্সবাজার ও কুতুবদিয়া উপজেলার মাঝের এলাকায় বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা এ দ্বীপ এখন আর দুর্গম নেই। বদলে গেছে এখানকার জীবনযাত্রা। ডিজিটাল উন্নয়নের সব সুবিধাই পাচ্ছেন দ্বীপবাসী।
মহেশখালীর ঘরে ঘরে এখন উচ্চগতির উন্টারনেট। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা ও কৃষিসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা ছুটে আসছে অপটিক্যাল ফাইবারে ভর করে। আর তা সম্ভব হয়েছে সরকারের ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ প্রকল্পের কারণে।
ছোট-বড় তিনটি দ্বীপের সমন্বয়ে একটি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে মহেশখালী। জাগো ফাউন্ডেশনের দূরশিক্ষণ প্রকল্পের কারণে ঢাকার অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাছে পড়াশোনার সুযোগও পেয়েছে এখানকার শিক্ষার্থীরা। নানান রোগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শও পাচ্ছেন টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে। মহেশখালীকে এরইমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’। দ্বীপের ৫০ হাজার মানুষ এখন ইন্টারনেটের আওতায়।
শুধু পড়াশোনা কিংবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাচ্ছেন তা নয়। ইন্টারনেটের করণে অনেক যুবক এখানে যুক্ত হয়েছেন ব্যবসায়। অনলাইনে গড়ে তুলেছেন বিষমুক্ত শুঁটকি বিক্রির প্রতিষ্ঠান ‘ই-বিজনেস সেন্টার’। ই-কমার্সের মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তে গ্রাহকের কাছে শুঁটকি পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। পাশাপাশি মহেশখালীতে বেড়াতে আসা পর্যটকরাও তাদের কথা অনলাইনে জানতে পারছেন ও সহজে শুঁটকি কিনতে আসতে পারছেন।
ডিজিটাল ব্যাংক
দুর্গম এক চর ঢালচর। বর্ষায় বলতে গেলে বাকি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ। আবহাওয়া ভালো থাকলে দিনে দুয়েকবার যাতায়াতের সুযোগ আছে উপজেলা হাতিয়া বা মনপুরার সঙ্গে। এ চরে ১০ হাজার মানুষের বাস। এখানকার বাসিন্দাদের অনেকে কাজ করেন শহর ও অন্যান্য অঞ্চলে। অন্যসব যোগাযোগ অনুন্নত হলেও লোকগুলোর উপার্জিত অর্থ মুহূর্তেই চলে যাচ্ছে তাদের ঘরে। আর এমনটা সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল মোবাইল ব্যাংকিং সেবার কারণে।
ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রের সেবা
‘আমাদের রহিমে বিদেশ থেকে ভিসা পাঠিয়েছে। ডিজিটাল তথ্য কেন্দ্র থেকে নিয়ে এসেছি। রাতে ছেলে ফোন করে বলেছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম্পিউটারে ভিসা পাঠিয়ে দেবে। সঙ্গে কিছু টাকাও পাঠিয়েছে।’
আঞ্চলিক ভাষায় এমনটাই বললেন, নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত সোনাদিয়া ইউনিয়নের চরচেঙ্গা গ্রামের রওশন আরা বেগম। তার ছেলে আব্দুল রহিম মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে থাকেন। এখন ছোট ছেলে করিমকে বিদেশে নেওয়ার জন্য ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে ভিসা পাঠিয়েছেন। অল্প সময়ে ভিসা হাতে পেয়ে বেশ খুশি রওশন আরা।
এ গ্রামের অনেকেই এখন ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে ইন্টারনেট-নির্ভর সুবিধা পাচ্ছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেও উদ্যোক্তা হচ্ছেন তরুণরা। কম্পিউটার শিখে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাকরিও করছেন অনেকেই। উন্নয়নের পথপরিক্রমায় এখন প্রান্তিক মানুষের নাগরিক সেবার আস্থার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে এটি। দক্ষ জনশক্তি গড়ার এই কর্মযজ্ঞকে আরও গতিশীল ও আধুনিকায়ন করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
সোনাদিয়া ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রের পরিচালক মুজাম্মেল হোসেন মিলন বলেন, ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ সেবা নিচ্ছে। একমন কোনও সেবা নেই যেটা এখান থেকে দেওয়া হয় না। এক কথায় বললে, ইন্টারনেটনির্ভর যতো সেবা রয়েছে সবগুলো নামমাত্র মূলে পাওয়া যাচ্ছে। কারণ এর যাবতীয় যন্ত্রপাতি সরকারের পক্ষ থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে বিদ্যুৎ নেই। সৌরশক্তির মাধ্যমে আমরা সারাক্ষণ সব সেবা দিতে পারছি। উদ্যোক্তাও তৈরি করছি। অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন খামার তৈরি করেছেন। ব্যবসা করছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। কয়েক বছর আগে আমাকেই কম্পিউটার শিখতে জেলা সদরে যেতে হয়েছিল।
নিঝুমদ্বীপের নামারবাজারের কম্পিউটার দোকানি রুবেল উদ্দিন বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করি। উপায় না পেয়ে ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিই। এখন নিজেই একটি কম্পিউটার কিনে দোকান দিয়েছি। আমার পরিবারও সুন্দরভাবে চলছে।’
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম লক্ষ্য সব সেবা ডিজিটাল প্লাটফর্মে এনে সেবাপ্রাপ্তির বিষয়টি সহজ ও দুর্নীতিমুক্ত করা। বর্তমানে সারা দেশের ৪ হাজার ৫০০টি ইউনিয়ন, ৩২৯টি পৌরসভা, সিটি করপোরেশনগুলোর ওয়ার্ড নিয়ে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৮৬৫টি ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। এই সেন্টারগুলো থেকে প্রতি মাসে সেবা নিচ্ছেন প্রায় ৬০ লাখের বেশি মানুষ। যার অধিকাংশই গ্রামের। কর্মসংস্থান হয়েছে ১১ হাজার তরুণের। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ আইটি ফ্রিল্যান্সার তৈরি হয়েছে। গ্রামে বসেই তারা উদ্যোক্তা হয়েছেন। যদিও এই সেবাকেন্দ্র শুধু ইউনিয়নেই সীমাবদ্ধ নেই। গার্মেন্ট কর্মীদের জন্যও স্পেশালাইজড ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।
অনলাইনে মানবসেবা
ফৌজিয়া খিলজী সোহেলী, জুয়েল রানা, রিফাজ উদ্দিন ও মাইন উদ্দিন; ‘দ্বীপ অঞ্চল হাতিয়া’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের উদ্যোক্তারা তারা। গ্রুপের সদস্য এখন এক লাখ ৭৫ হাজার ২০০। গ্রুপটিতে উপকূলীয় এলাকার সমস্যা ও সম্ভাবনার পাশাপাশি আহ্বান জানানো হয় মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার জন্য। গ্রুপের উদ্যোক্তারা এরইমধ্যে অসহায় ৮টি পরিবারকে ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎহীন ঘরে সৌরবাতি স্থাপন, নদীর ভাঙন রোধে জিওব্যাগ স্থাপন এবং বিভিন্ন সময় বন্যাপ্রবণ এলাকায় ত্রাণ সহায়তা বিতরণ ও স্কুল নির্মাণেও সহায়তা করে আসছে।
কয়েকশ’ গ্রুপ
শুধু হাতিয়া নয়, উপকূলীয় এলাকায় এমন কয়েকশ’ ফেসবুক গ্রুপ পাওয়া যাবে, যারা সমাজসেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রুপগুলোর মধ্যে আছে ‘উপকূল বাঁচাও আন্দোলন (উবা)’, ‘জাগ্রত দ্বীপ হাতিয়া’, ‘প্রজন্ম হাতিয়া’, ‘উপকূল মিডিয়া করপোরেশন’, ‘হিউম্যানিটি ফার্স্ট’, ‘মানবিক হাতিয়া’, ‘তিলোত্তমা ব্লাড ব্যাংক’, ‘মায়াবী হাতিয়া’, ‘সোনাদিয়া ব্লাড ফাউন্ডেশন’, ‘নিঝুম ব্লাড ফাউন্ডেশন’, ‘উপকূল ফাউন্ডেশন’, ‘দ্বীপ কন্যা চানন্দী’, ‘বাংলাদেশ কুটির দ্বীপাঞ্চল হাতিয়া’, ‘মানবিক ইউনিট’, ‘সুষ্ঠু সুন্দর নোয়াখালী চাই’ ও ‘মানবিক ব্লাড ফাউন্ডেশন’ অন্যতম। ফেসবুকের এসব গ্রুপের কয়েক লাখ করে সদস্য রয়েছে। যাদের দান-অনুদানেই উপকূলের অবহেলিত মানুষকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পাহাড়ে দিনবদল
দুর্গম পাহাড়ি জনপদ বান্দরবানে একসময় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ছিল না। মোবাইল ফোনের আবির্ভাবে থ্রিজি-ফোরজি স্মার্টফোনের প্রসারে এখন হাতে হাতে ইন্টারনেট। প্রযুক্তির কল্যাণে চাইন মারমা সবুজের মায়ায় সব কিছু ফেলে এখন পুরোদস্তুর খামারি। চাইন মারমা এখন পাহাড়ের ঢালে ফল আর সবজি ফলান। অনলাইনে অর্ডার নিয়ে উৎপাদিত টাটকা পণ্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় হোম ডেলিভারি হয়ে যায়। কৃষিই যেন তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। তরুণ এই উদ্যোক্তার পুরো সময় কাটে এখন শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বেতছড়ার পাহাড়ে।
২০১০ সালে শুরু করেছিলেন কয়েকটি আম ও লিচুগাছ দিয়ে।
এখন তাঁর ৩০ একরের বাগানে ফলছে আম, লিচু, কলা, পেঁপে, জাম্বুরা, জলপাইসহ হরেক জাতের ফল। রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়াই এই বাগান থেকে বছরে তিনি ১৫ লাখ টাকার ফল বিক্রি করেন। এর অর্ধেকই বিক্রি হয় অনলাইনে।
তিনি বলেন, কিছুদিন আগে ঢাকায় কজন বন্ধু মিলে গড়ে তোলা ‘মাচাং’ নামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে টাটকা আম, কলা কিংবা পেঁপে।
২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় পণ্য পৌঁছান কিভাবে জানতে চাইলে চাইন মারমা বলেন, কখনো সরাসরি আবার কখনো অনলাইনে অর্ডার আসে। সে অনুযায়ী বেতছড়া পাহাড় থেকে আম লিচু কলা পেঁপে সংগ্রহ করে নৌকায় চাপিয়ে নিয়ে আসা হয় বান্দরবানে। তারপর নৈশকোচে করে ভোরের আগেই পণ্য পৌঁছে যায় ঢাকায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বেতছড়ার বাগানের টাটকা ফল সকাল ১০টার আগেই ঢাকার বাড়ি বাড়ি ডেলিভারি হয়ে যায়।
চাইন বলেন, ‘চাকরি করে আর কত টাকা আয় করা যেত? এখন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকছি। কর্মসংস্থান করেছি অরেক বেকার যুবকের। সব কিছু দিয়ে মাসে আয়ও হচ্ছে লাখ টাকার বেশি। এর চেয়ে আর কি চাই?’
চাইনের মতো অনেক কৃষিভিত্তিক উদ্যোক্তার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। থ্রিজি-ফোরজি প্রযুক্তির উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাঁরা নিজেদের দিন বদলাচ্ছেন। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগের সুফল কাজে লাগিয়ে অনেক কৃষক ই-কৃষিতে ঝুঁকছেন। পণ্য উৎপাদন, সরবরাহসহ নানা স্তরে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপের সহায়তা নিচ্ছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, বেতারের ওপর কৃষকের নির্ভরতার হার ১০.৫ শতাংশ, মোবাইল ফোনে ৬৯.৯ শতাংশ। ৮৪.১ শতাংশ কৃষকের নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে, ৩৪.৭ শতাংশ কৃষক মোবাইলে খুদে বার্তা বা এসএমএসে উত্তর দেন এবং ২৬.৩ শতাংশ কৃষক আইভিআর বা ইন্টারেক্টিভ ভয়েস রেসপন্স ব্যবহার করেন।
জানা গেছে, কোন অঞ্চলে কোন কৃষি পণ্যের ফলন বেশি আর কোথায় তার চাহিদা বেশি সে তথ্য কৃষকের কাছে স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে পৌঁছানো গেলে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে কাজটা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। আইসিটি মাধ্যমে কৃষি তথ্য পৌঁছাতে পরিচালিত হচ্ছে ‘কৃষি কল সেন্টার’। এর পাশাপাশি ‘কৃষকের জানালা’ ও ‘কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা’ নামের দুইটি অ্যাপ্লিকেশনেও নানা সুবিধা পাচ্ছেন কৃষক। বেসরকারি উদ্যোগগুলোর মধ্যে আছে অ্যাগ্রো বাংলা, কৃষি বাংলা, ই-কৃষক গ্রামীণফোনের ‘কমিউনিটি ইনফরমেশন সার্ভিস’, ডি নেটের ‘ইনফো লেডি’ এবং এমপাওয়ার সোশ্যাল লিমিটেডের ‘অ্যাগ্রো নলেজ ব্যাংক’ ও ‘ফার্মার্স কোয়ারি’ ইত্যাদি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অ্যাপটির মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকরা ধান বিক্রি করতে পারবেন, এর মধ্যে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী আসতে পারবে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইনচার্জ (উপপরিচালক আইসিটি) ড. মাজহারুল আজিজ জানান, প্রতিটি কৃষককে ডিজিটাল সেবা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। যাতে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ফসলের যেসব সমস্যা হয় তার সমাধান করতে পারেন। এ জন্য কৃষকসমাজকে সচেতন হতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, ‘কৃষি প্রযুক্তিকে সরকার হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। মোবাইল ফোনে অ্যাপের মাধ্যমে সামনের দিনগুলোতে বেশি করে কৃষিসেবা দেওয়া হবে।’
এটুআই কর্মসূচির পলিসি অ্যাডভাইজার আনীর চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সামনের দিনগুলোয় এ ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবনকে আরো সহায়তা দিতে চাই।’