শামসুদ্দিন হারুন । এডিটর । এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশ
বাংলাদেশকে নিয়ে কাতার ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার বিতর্কিত একটি রিপোর্ট এখন উত্তাপ ছড়াচ্ছে রাজনীতি, প্রশাসন এবং গণ মাধ্যম অঙ্গন জুড়ে। সরকার বিরোধীরা চাইছেন, যে যার যার মতোন করে আল জাজিরার এই রিপোর্টকে ব্যবহার করতে। অবশ্য সরকারও এ নিয়ে পড়েছে কিছুটা অস্বস্তিকর এবং বিব্রতকর এক অবস্থায়। যদিও নানান অসংগতির কারনে প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতাই এখন হয়ে উঠেছে প্রশ্নবিদ্ধ।
আল জাজিরা গত সোমবার বাংলাদেশ নিয়ে এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সরকার ঘনিষ্ঠ ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর বাংলাদেশ সরকার এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বেশ কঠোর ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিবেদনটিকে মিথ্যা ও অবমাননাকর হিসেবে বর্ণনা করেছে। এটি প্রত্যাখ্যান করে সেনা দফতরের মুখপাত্রও।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে, এ প্রতিবেদনকে লন্ডনসহ অন্যান্য জায়গায় সক্রিয় উগ্রপন্থী ও তাদের সহযোগীদের উসকানিতে বেপরোয়া ও নোংরা অপপ্রচার বলে উল্লেখ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এটি প্রত্যাখ্যান করছে । বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় যে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে জামায়াতে ইসলামীর মদদ-পুষ্ট কতিপয় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক অপরাধী এবং কুখ্যাত ব্যক্তি তাদের চিরাচরিত ছকে যে ধরনের বাংলাদেশ-বিরোধী অপপ্রচার চালিয়ে থাকে, এই রিপোর্টটিও সেই একই গোত্রভূক্ত এবং সেই একই শ্রেণির। এরা বিভিন্ন উগ্রপন্থী আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ও সংবাদ মাধ্যম, বিশেষ করে আল জাজিরার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আল জাজিরার প্রতিবেদনের অভিযোগগুলোর মূল সূত্র একজন সন্দেহভাজন আন্তর্জাতিক অপরাধী, যাকে আল জাজিরা নিজেই ‘সাইকোপ্যাথ’ আখ্যা দিয়েছে। ”প্রধানমন্ত্রী বা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই বিশেষ ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার সামান্যতম প্রমাণও নেই। আর মানসিক ভারসাম্যহীন কারও কথার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো একটি আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেলের জন্য চরম দায়িত্বহীনতা” উল্লেখ করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতিতে।
একই সাথে সেনা দফতর থেকেও বলা হয় উল্লেখিত প্রতিবেদন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে কঠোর ভাবে নিন্দা জানানো হয়েছে এই প্রতিবেদনের।
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়, “এটা একদমই পরিষ্কার না, যাদের চরম অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার পূর্ব রেকর্ড রয়েছে তাদের সঙ্গে কীভাবে আল জাজিরার মত আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেল যুক্ত হয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অফিসিয়াল, সামাজিক, ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের ক্লিপ ব্যবহার করে। বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন অনুষ্ঠানের দৃশ্য একত্রিত করে সম্পাদনা করে কণ্ঠ দেয়া হয়েছে।”
‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ নামের এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রচার করার পর থেকে এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও হয় তোলপাড়। চলছে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা এবং পর্যালোচনা। এ রিপোর্টে বাংলাদেশকে অনেকটাই মাফিয়া রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। দায়িত্বশীল একটি বিদেশী গণ মাধ্যমে যখন গোটা একটি রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গগুলোকে মাফিয়া নিয়ন্ত্রিত বলে অভিহিত করা হবে, তখন অবশ্যই সে রিপোর্টের স্বপক্ষে যথোপযুক্ত, অকাট্য প্রমান এবং যথার্থ তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করতে হবে। গণ মাধ্যমের এটাই রীতি নীতি এবং এটাই রেওয়াজ। কিন্তু আল জাজিরার উল্লেখিত অনুসন্ধানী রিপোর্টে কি তাদের রিপোর্টের স্বপক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য উপাত্ত ও অকাট্য প্রমান রয়েছে ? একদমই নেইই। আর এসব সংগত কারনেই প্রতিবেদনের উৎস, সততা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন এখন সব জায়গায়, সর্বত্র।
বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিক জনৈক সামী’র বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে আল জাজিরার প্রতিবেদনটি গড়ে উঠেছে। কিন্তু এই সামীকে নিয়েই দেশে বিদেশে রয়েছে এন্তার প্রশ্ন। কৈশোর থেকে তারুণ্য বেলায় হাঙ্গেরি চলে যাবার আগ পর্যন্ত সামীর সাথে যাদের নৈকট্য ছিলো তারা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলছে দেশে অবস্থানকালে সামী ছিলেন বহুরূপী এবং বহুমাত্রিক এক জঘন্য অপরাধী। নানান ধরনের অপরাধে পুলিশ ও র্যাবের হাতে সামী বেশ কয়েকবার গ্রেফতারও হয়েছিল। সেসব মামলার সুরাহা এখনো হয়নি। এই সামীই হাঙ্গেরি গিয়ে রেস্তোঁরা ব্যবসায় জড়িয়ে ‘কেউকেটা’ হয়ে যায়।
প্রতিবেদনে দেখা যায় হাঙ্গেরির এই প্রবাসী বাংলাদেশী রেস্তোঁরা ব্যবসায়ী এমন সব ‘গুরুত্বপূর্ণ ‘ তথ্য উপাত্ত আল জাজিরাকে বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দিয়েছেন, তাতে যে কারোরই মনে হতে পারে সামী বাংলাদেশের এমনই এক দিকপাল যে বাংলাদেশের অনেক কিছুই তিনি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এমনকি বাংলাদেশের সেনা প্রধানও তার কাছে নানা কাজে ধর্না দেন।
প্রতিবেদনে আল জাজিরা নিজেই যাকে ‘সাইকোপ্যাথ’ বলে উল্লেখ করেছে সেই হারিস আহমেদের প্রমানহীন নানান বকতব্য প্রতিবেদনে কি করে বেশ নির্ভরতার সাথে ব্যবহার করা হয়, সে প্রশ্নও উঠে এসেছে বারবার। এমন আরও অনেক অনেক অসঙ্গতি দেখা যায় উল্লেখিত প্রতিবেদনে। এমন একজন সামী, এমন একজন ‘সাইকোপ্যাথ’ এর তথ্য প্রমানহীন নানান গল্পের ওপর ভিত্তি করে একটি আন্তরজাতিক গণ মাধ্যম কি করে এমন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে পারে সেটাই এখন দাঁড়িয়েছে অনুসন্ধানের বিষয়।
এদিকে আল জাজিরার এমন প্রতিবেদনের নেপথ্য শক্তি হিসেবে ইউরোপসহ সংশ্লিষ্ট দেশে নব্য আওয়ামী লীগারদের বহুরূপী অনুপ্রবেশকে দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগের ইউরোপ অঞ্চলের নেতা বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়া উপ কমিটির সদস্য এবং তুরস্ক আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম এ ফারুক প্রিন্স। এ প্রসঙ্গে এম এ ফারুক প্রিন্স আজ শুক্রবার বিকেলে এন্ট্রাপ্রেনার বাংলাদেশকে বলেন, ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের দায়িত্ব যাদেরকে দেয়া হয়েছে, তাঁরা দায়িত্বে চরম অবহেলা করে তৃণমূল ও ত্যাগী নেতা কর্মীদের বাদ দিয়ে কোন রকম যাচাই বাছাই ছাড়াই, ন্যুনতম বাছ বিচার না করেই আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্ত করছে। অর্থ লোভী এক শ্রেনীর নেতা তাঁদের বিশেষ স্বার্থে এই কাজ গুলো করছে। তিনি বলেন ইউরোপে হাইব্রিড নব্য আওয়ামী লীগারদের মধ্যে এমন একজন আছেন যিনি কিছুদিন আগেও ফেসবুকে বঙ্গবন্ধু কণ্যা এবং মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নোংরা কুৎসিত বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন, অথচ এখন তিনি আছেন বড় পদে। এই জাতীয় লোকজনই আল জাজিরার প্রতিবেদন তৈরির সহায়ক শক্তি। আল জাজিরার বর্ণিত সামী, মুন্না এবং আরও কয়েকজন দলে এদেরই মতোন হাইব্রিড। যারা আওয়ামী লীগের ঘরে বাস করে করছেন আওয়ামী লীগেরই সর্বনাশ।