জহির রায়হান
ছবির মতো সুন্দর ঝকঝকে গোছানো বাড়ি। চারদিকেই সবুজের সমারোহ। যেন সুনিপুণ পরিকল্পনা করে ফল, সবজি এবং ঔষধি নানান গাছ লাগানো হয়েছে। মাচায় ঝুলছে শাক, লাউ, বাগানে টমেটোসহ নানা সবজি। বাড়ির পেছনের দিকে উঠোনে চড়ছে গবাদি পশু। বাড়ির কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনা নেই। একটিমাত্র নয় দেশজুড়ে প্রায় ১৪ হাজার এমন বাড়ি ‘সমৃদ্ধ বাড়ি’ হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে।
বসতবাড়ির জমি সর্বোচ্চ ব্যবহার করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৬২১টির বেশি বাড়ি ‘সমৃদ্ধ বাড়ি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তারা। এসব বাড়ির যতটুকু জমি আছে সেটার পরিকল্পিত ব্যবহার করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বাড়ির মালিক। নিজের পরিবারের শাক-সবজির চাহিদা মিটিয়ে মাসে আবার আয়ও হচ্ছে সাত থেকে নয় হাজার টাকা।
পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সমৃদ্ধ বাড়ি, সেটা হলো- বাড়িতে যতটুকু জমি আছে সেটার পরিকল্পিত ব্যবহার। প্রথম কথা হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থাকতে হবে। এখানে কোনো অপরিষ্কার, নোংরা, এলামেলো থাকা যাবে না। মূল পরিকল্পনা হলো- আর তার জমিটা কীভাবে ব্যবহার হবে। প্রথমে তার থাকার ঘর লাগবে, বসার ঘর লাগবে। এরপর হচ্ছে গাছ লাগানো দরকার। সেই গাছ আবার পরিপাটি করে সাজিয়ে লাগাতে হবে। গরু থাকলে, গরু পেছনের দিকে রাখতে হবে, যাতে সামনের দিকে ময়লা না হয়।’
পিকেএসএফ চেয়ারম্যান জানান, সমৃদ্ধ বাড়ির ফটকে ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো। বাড়িতেই লাগানো হয়েছে নানা রকমের সবজিগাছ। ঔষধি গাছ হিসেবে লেবু গাছ ও সাজনা গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক। এসব বাড়ির পাঁচ ডেসিমিল জমি থেকে মাসে গড়ে সাত থেকে নয় হাজার টাকা আয় হয় তাদের। বাড়িতে লাগানো সবজি নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তাদের এই বাড়তি আয়।
‘সমৃদ্ধ বাড়ি’ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যেকোনো মানুষ তার বসতবাড়িকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতে পারেন। পিকেএসএফ দেশের ২০২টি ইউনিয়নে সমৃদ্ধ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। এসব ইউনিয়নে চলছে সমৃদ্ধ বাড়ি তৈরির কার্যক্রম। মানব উন্নয়নে তথা সমাজে যোগ্যমর্যাদা পেতে এবং মানবিক জীবনযাপনে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কোনো বিকল্প নেই।
পিকেএসএফের প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ একটি বাড়িতে বসবাসকারীদের জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে এই বিশেষ প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন সারাদেশে সমৃদ্ধ বাড়ির এই ধারণাকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কিছু কিছু ইউনিয়ন আছে সেখানে সব সম্পূর্ণ হয়ে গেছে সমৃদ্ধ বাড়ি। যেমন হাতিয়াতে সব বাড়ি হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে বাড়ির মালিকের প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। কারণ এখানে টাকার চেয়ে শ্রমের দরকার বেশি। তারা সেই শ্রম দিতে রাজি হলে আমরা গাছের চারা দেই। সমৃদ্ধি বাড়ি করার জন্য অত বেশি খরচ হয় না। বাড়ি সুন্দর করার সুন্দর রাখার মানসিকতাই এখানে জরুরি। প্রথমে ইউনিয়নে দুয়েকটি বাড়ি সমৃদ্ধ হলে দেখাদেখি অনেকেই তাদের বাড়িও তেমনটা করতে আগ্রহী হয়।’
সমৃদ্ধ বাড়ি করতে আগ্রহীদের প্রথমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় জানিয়ে পিকেএসএফ চেয়ারম্যান বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে দরিদ্র পরিবারসমূহের সম্পদ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি (সমৃদ্ধি) একটি মানবকেন্দ্রিক কর্মসূচি। সমৃদ্ধ ইউনিয়নভুক্ত যে কেউ এ বাড়ি করতে পিকেএসএফের সহোযোগিতা নিতে পারবেন। তারপর যা যা সহোযোগিতা প্রয়োজন আমরা সব করবো।
দেশের প্রত্যেক ইউনিয়নের সবগুলো বাড়ি সমৃদ্ধ করার অভিপ্রায় রেখে ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, ‘সমৃদ্ধ বাড়িগুলো আমরা মনিটরিং করছি। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে নজরদারি। মাঠ পর্যায়ে আমাদের সহযোগী সংস্থার লোকজন নজরদারি করছেন। বাড়ির মালিকদের চারা না থাকলে সেটা আমরা দিয়ে দিই। বীজ প্রয়োজন হলে তাও দিই। খুব কম খরচে খুব সুন্দর একটা বাড়ি হয়।
বাড়ি সমৃদ্ধ করতে আগ্রহীদের সব রকমের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একজনের দেখাদেখি অনেকেই করে। প্রথমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় কীভাবে তারা গাছ লাগাবে। রোগবালাই হলে আমাদের সদস্যরা দেখে। গাছ মরে গেলে কী করতে হবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অর্থাৎ এখানে অর্থকড়ির তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না। শুধু আগ্রহ আর শ্রম দেয়ার মানসিকতাই জরুরি।’
সমৃদ্ধ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য মানুষের জীবন, তার মর্যাদা। এটার লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেকের মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। কাউকে বাদ দেয়া যাবে না। যারা আছে সবাই। যারা পিছিয়ে আছে তাদের অগ্রাধিকার। দারিদ্র ও সামাজিক সমস্যা দুর করা এবং ব্যক্তিজীবনের নানান ধরনের চাহিদা মেটাতে নিজেরা যেন সক্ষম হন।
পিকেএসএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসীম উদ্দিন ঢাকা টাইমকে বলেন, ২০১০ সালে বাড়ি সমৃদ্ধ করার এই কর্মসূচি শুরু হয়। মাঠ পর্যায়ে পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু হয় ২০১২ সালে। বর্তমানে দেশের সবকটা জেলায় পিকেএসএফের সঙ্গে ১১৬টি সহযোগী সংস্থা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত সারাদেশে ১৩ হাজার ৬২১টি ‘সমৃদ্ধ বাড়ি’ হয়েছে।
সূত্র: ঢাকাটাইমস