মো. সাফায়েত আলম
টাকা ছাপাতে আর ছাপা টাকার ব্যবস্থাপনায় আমাদের দেশে বছরে কত খরচ হয় জানেন? মাত্র ৯ হাজার কোটি টাকা! ভুল পড়েননি। অংকটা আসলেই ৯ হাজার কোটি। নয়ের পর মাত্র দশটি শূন্য। চিন্তা করুন তো একবার, এই ৯ হাজার কোটি টাকা দিয়ে কী কী করা সম্ভব? কতজন শিক্ষাবঞ্চিত শিশুর সঠিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব? কতগুলো হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? কতজন অনাহারীর মুখে সারা বছরের খাবার নিশ্চিত করা সম্ভব?
এভাবে চিন্তা করলে সম্ভবের তালিকাটা হয়তো লম্বাই হতে থাকবে। কিন্তু যেটা আসলেই সম্ভব সেটা হলো, এ টাকাটা আগে বাঁচানোর ব্যবস্থা করা। শুধু চাইলেই কিন্তু এই বিশাল অংকের টাকার অপচয় আমরা রোধ করতে পারি। এই টাকা তো আমার টাকা, আপনার টাকা, আমাদের সবার টাকা। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের টাকা এটি। দেশের মানুষ যদি ১৭ কোটি ধরি তাহলেও তো বছরে একেকজনের ভাগে ৫৩০ টাকার মতো পড়ে। তার মানে হলো, আপনার আয় থেকে বার্ষিক আপনাকে এই টাকা খরচ করতে হচ্ছে কেবল আমরা কাগুজে অর্থ ব্যবহার করছি বলে!
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যদি ভাবি, আমরা সবাই মিলে উদ্যোগ নিলে কিন্তু টাকার এই অপচয় কমিয়ে আনতে পারি। হয়তো আমাদের চেষ্টার ফলেই অপচয়কে খুব দ্রুত শূন্যেও নামাতে পারি। প্রশ্ন আসতে পারে, কীভাবে? এর উত্তর হলো, আমরা যদি ডিজিটাল কারেন্সিতে অভ্যস্ত হই তাহলেই কেবল টাকার এই অপচয় কমানো বা বন্ধ করা সম্ভব। তাতে ছাপা টাকার ব্যবহার আপনাআপনি কমে যাবে এবং কাগুজে নোটের আয়ুও বাড়বে।
৯ হাজার কোটি টাকার এই অংক কিন্তু কারো মনগড়া নয়। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসেছে এই তথ্য। গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ‘রিডিউসিং দ্য ক্যাশ ট্রানজেকশন’ বেরিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, টাকা ছাপা আর ব্যবস্থাপনার খরচ মোট দেশজ উৎপাদনের শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশের সমান। বাংলাদেশ ব্যাংক এই হিসাব করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির জরিপের ওপর ভিত্তি করে। সুতরাং তথ্যের ওপর অনাস্থা জানানোর সুযোগ কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন বলছে, এই যে খরচ, এর প্রধান অংশ যায় বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে। তাছাড়া করপোরেট হাউজ, সরকার ও ব্যক্তি পর্যায়ের গ্রাহকের ওপরও খরচের বোঝা কিছুটা হলেও চাপে। এখানে আমার বক্তব্য হলো, খরচটা যার ঘাড়েই চাপুক না কেন, এটি তো আমাদের দেশের সম্পদ থেকেই যাচ্ছে। সুতরাং আমরা কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভাবতেই পারি। ছোট্ট একটু উদ্যোগ নিলেই তো হবে—ব্যবহার বাড়াতে হবে ডিজিটাল কারেন্সির।
দোকানে যখন কেনাকাটা করতে যাবেন, ছাপা টাকার চিন্তা বাদ দিয়ে মোবাইল ওয়ালেটটা একটু ব্যবহার করলেই তো হয়ে গেল। এক-দুই-তিন করতে করতেই তো একসময় গোটা দেশ ঢুকে পড়বে ডিজিটাল কারেন্সিতে। তখন শুধু ক্যাশলেস নয়, টাচলেস লেনদেনও আমরা নিশ্চিত করতে পারব। শুধু নিজের ডিভাইস ছাড়া অন্য কিছুতে স্পর্শ না করেই হবে এই লেনদেন।
কেউ কেউ হয়তো চাইতে পারেন উদ্যোগটা সরকারের দিক থেকে আসুক। সরকার এখানে প্রণোদনা দিক। সেটা হয়তো একটা সমাধান, তবে আমার তো মনে হয়, ব্যক্তিগত উদ্যোগই হলো এক্ষেত্রে বড় সমাধানের পথ। দেশটা যেহেতু আমাদের সবার, দেশের সম্পদ বাঁচাতেও আমাদের সবাইকে একসঙ্গে উদ্যোগী হতে হবে। আর সেটি হলো, বিল পরিশোধের সময় আগে প্যান্টের পেছনের পকেটে থাকা ফিজিক্যাল ওয়ালেটে বা ভ্যানিটি ব্যাগের ওয়ালেটে হাত দেয়ার আগে প্যান্টের সামনের পকেট বা হাতে থাকা মোবাইল ফোনে হাত দিন। মোবাইলে রিচার্জ করবেন? আগেই গলির মুখে থাকা দোকানে না ছুটে নিজের মোবাইল ওয়ালেট থেকেই তো রিচার্জ করাতে পারেন। কোনো সেবার বিল দেবেন বা অনলাইনে কিছু কিনবেন, সেখানেও আছে ডিজিটাল পেমেন্ট। এসব করলে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বোনাস বা ক্যাশ ব্যাকও পাচ্ছেন। আর আপনার সময়, শ্রম তো বাঁচবেই। ব্যস, এটুকুই করেন? একটু একটু করে এগোতে এগোতে ৯ হাজার কোটি টাকার পুরো পথটাই একসময় আমরা পাড়ি দিয়ে ফেলব।
এবার চলুন সরকারি উদ্যোগটাও দেখি। ছাপা টাকার ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পেছনে কভিডেরও খানিকটা ভূমিকা আছে। গত ২২ মার্চ এক সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংককে ছাপা টাকার ব্যবহার কমিয়ে আনতে নির্দেশনা দেয়। মূলত ছাপা টাকার মাধ্যমে যাতে নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে, সেটি প্রতিরোধ করতেই এমন নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তাহলে তো আরো একটি দিকও পাওয়া গেল, ছাপা টাকা ব্যবহার না করলে ভাইরাসের ঝুঁকিও খানিকটা কমে। সঙ্গে যদি যোগ করেন ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতার দিকটিও, তাহলে তো সুবিধার পাল্লা আরেকটু ভারী হয়।
বাংলাদেশে কভিডের শুরুর দিকে যখন অনেক লোক কাজ হারাল, তখন প্রধানমন্ত্রী ৫০ লাখ পরিবারের প্রতিটিকে আড়াই হাজার টাকা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে ১৪ লাখের মতো নম্বরে কোনো টাকাই পাঠানো যায়নি। কারণ ওই নম্বরগুলোর ক্ষেত্রে পরিচয়গত সমস্যা ছিল। একজনের নামের সঙ্গে আরেকজনের ওয়ালেট নম্বর জুড়ে দিয়ে অনেকেই এই আড়াই হাজার টাকা নিজে ওয়ালেটস্থ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাতা বিতরণের এ পদ্ধতি যেহেতু স্বচ্ছতম, সে কারণে একজনের টাকা অন্যজনের ওয়ালেটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর সে কারণেই ১৪ লাখ নম্বরে কোনো ভাতাই যায়নি। এটিও কিন্তু সরকারের দিক থেকে বড় এক সাফল্যই যে ভাতা বিতরণের ক্ষেত্রে এই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেছে। আর তাতে সরকারের তথা জনগণের অন্তত ৩৫৮ কোটি টাকা তছরুপের হাত থেকে বাঁচানো গেল। এটি কিন্তু এমএফএস খাতের জন্য কম বড় সাফল্য নয়।
বহুদিন থেকেই তো দেশে সরকারের নানা ধরনের ভাতা বিতরণের ক্ষেত্রে সবসময় কাগজ-কলমে সফলতার হার ১০০ শতাংশ থাকে। কিন্তু এই দফায় কাগুজে সাফল্য শতভাগ না হলেও প্রকৃত ব্যবহারিক সাফল্য কিন্তু অনেক বেশি। যেটি নিশ্চিত করা গেছে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। যেটিকে আমরা বলছি স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মত, সরকারি অর্থ বিতরণের ক্ষেত্রে শতভাগ সফলতা না পাওয়াও এদিক দিয়ে ভালোই। তাতে সঠিক লোকটিই যেন সরকারি সহায়তাটা পেতে পারে, সেটাই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আরো অনেক দিক থাকতে পারে। এই যেমন এমএফএস সেবা নিতে গিয়ে একেকজন গ্রাহক যখন লেনদেন করেন, তখন কিছু তথ্যের জন্ম হয়। এ তথ্য যখন একের পর এক জমা হতে থাকে তখন একটি তথ্যভাণ্ডারও তৈরি হয়ে যায়। আর এটাই হতে পারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আরেকটি বড় পরিমাপক। যেটি আবার সম্পদও। ‘নগদ’-এর মতো ডিজিটাল আর্থিক খাতের সেবা ব্যবহার করে যদি সরকারি ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত থাকে, তাহলে কর্তৃপক্ষ চাইলে সুবিধামতো সময়ে পুরো প্রক্রিয়ার অডিট করতেও পারবে। যেটি স্বচ্ছতা দেবে। অন্যদিকে যে গ্রাহক অনেক দিন থেকে এমএসএফ ব্যবহার করছে, তথ্যের জন্ম হতে হতে তার ক্রেডিট রেটিংও সৃষ্টি হয়ে যাবে, যা দিয়ে সে ঋণ পাওয়াসহ আরো অনেক কাজ করতে পারবে।
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবার মাধ্যমে ৫০ লাখ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা দেয়ার ওই প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের এতটাই পছন্দ হয়েছে যে এখন সমাজসেবা অধিদপ্তর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় তাদের দেয়া ভাতাও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবার মাধ্যমে বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাও মোবাইলে উঠতে যাচ্ছে। শিক্ষার বৃত্তিসহ নানা ভাতা তো আগেই আছে। আমার বিবেচনায় এসব হচ্ছে অগ্রগতির একেকটি ধাপ। আর এসব ধাপ পেরিয়েই ৯ হাজার কোটি টাকার পুরোটাই একসময় আমরা বাঁচিয়ে ফেলতে পারব। অপচয় ঠেকানো মানে কিন্তু এক দিক দিয়ে আয়ও। সুতরাং ডিজিটাল লেনদেন দেশের জন্য আয়ও করতে পারে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক
ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সেবা নগদ