দেশের সমুদ্র উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলায় জন্ম নাহিদ নুসরাত তিসা’র। চার ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট তিসা। বাবা ব্যবসায়ী, মা স্কুল শিক্ষিকা। এ.রব হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ভোলা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।
শৈশব থেকেই দারুণ দুরন্ত তিসা শিক্ষাজীবনে শিখেছেন মার্শাল আর্ট, করতেন স্কাউটিং, যুক্ত ছিলেন রেড ক্রিসেন্ট এর সাথেও। রান্নাতেও বেশ পারদর্শী তিসা ২০০৫ সালে চ্যানেল আই’য়ের রাধুনিতে অংশগ্রহণ করেন।
বাবার স্বপ্ন মেয়ে ডাক্তার হবে, মা চাইতেই ভালো কোনো সরকারি চাকুরিজীবি হোক। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের পর পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তিসা’কে। ডাক্তার হওয়া তো দূরের কথা পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে যায় তিসা’র। কিন্তু মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা পড়াশোনার প্রতি তীব্র ভালোবাসাটা কিন্তু বন্ধ হয়নি।
সংসারের অবসর সময় গুলোতে কাজে লাগিয়ে শুরু করলেন হ্যান্ডিক্রাফটের ব্যবসা। সেখান থেকে যা আয় হতো তা দিয়ে পুনরায় শুরু করলেন বন্ধ হওয়া পড়াশোনা। ভর্তি হলেন ডিগ্রি কোর্সে। মোটামুটি ভালো ফলাফল নিয়ে সেটিও শেষ করলেন। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চাকরির জন্যও চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু পারিবারিক কারণে চাকরি আর করা হলো না।
২০১৬ সালে বিউটিফিকেশনের ওপর একটি কোর্সে ভর্তি হন। বিউটিফিকেশন কোর্স চলাকালীন অবস্থাতেই সিদ্ধান্ত নেন পার্লার দেওয়ার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিক করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “রাহা ব্রাইডাল হাউজ” নামে একটি পেজ খোলেন প্রচারণার জন্য। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনার কারণে পার্লারের চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে হিসাব রক্ষক পদে চাকরি জীবন শুরু করেন। অল্প দিনেই অফিসিয়াল সব কাজ রপ্ত করে ফেলেন তিসা। তিসার কর্মদক্ষতায় দারুণ খুশি অফিসের সবাই। কিন্তু সকাল সন্ধ্যা অফিস করায় এতটা সময় বাচ্চাদের না দেখতে পাওয়ায় প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল তিসার। অনেক অনুরোধ সত্বেও বাধ্য হয়ে চাকরিটা ছেড়ে দেন তিসা।
এরই মধ্যে পারিবারিক ও সাংসারিক জীবনে নানান রকম মানুষিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েন তিসা। দিনের পর দিন নীরবে মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন সব অপবাদ। কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ যখন ভেঙ্গে যায়, সহ্য শক্তি যখন নিশ্চল হয়ে যায় সময় তখন মানুষকে প্রতিবাদী হতে সেখায়। এমনি এক সময় খুব কাছের মানুষটিও মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে তিসাকে। পরিবারের অন্য সদস্যরাও সমর্থন করে তাকে। পাশে কাউকে না পেয়ে ভেঙ্গে পড়েন তিসা। চরম দুঃসময়ে সান্তনা দেবার কেউ না কেউ তো থাকেই। তিসার স্বামীর পরিচিতরাই পাশে ছিল তিসার। তারাও প্রতিবাদ করেছিলো। শ্বশুর বাড়ি যেন হয়ে উঠলো জেলখানা। ব্যবহৃত জিনিসপত্র স্পর্শ তো দূরের কথা ওয়াশ রুমও ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি দিনের পর দিন। পরিবারের সদস্যদের কথা মেনে চলায় প্রয়োজনে একসাথে বাইরে যাওয়া তো হয়ইনি দুঃসময়েও স্বামীর সহযোগিতা পাননি দীর্ঘ দশটি বছর।।
যখন প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন তিসা তখনি বেদনা বিধুর দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ ঘটলো। কিছুদিন পর যখন নিজের ভুল বুঝতে পারল তিসার স্বামী তখন তিসাকে আমন্ত্রণ জানায় আবারো একসাথে সংসার করার। সকল দুঃখ ব্যাথা বেদনা গ্লানি ভুলে সংসার ও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সম্মতি জানান তিসা। কিন্তু কিছুদিন পরেই আবারো সাংসারিক সামান্য তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হলে প্রচণ্ড নির্যাতনের সম্মুখীন হন তিসা। পরবর্তীতে তিসার স্বামী তার ভুল বুঝতে পারলে ক্ষমা করে দেন তিনি।।
তিসা জানান, যে ব্যক্তি ভুল করে তাকে মাফ করা যায় কিন্তু যে বেঈমানি করে, প্রতারনা করে তাকে মাফ করা যায় না। কিন্তু তবুও আমি ওকে মাফ করে দিয়ছি। কিন্তু আমার কাছে ফিরে আসার সব গুলো দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। বিচ্ছেদ মানেই একজন কে খারাপ হতে হবে কেন। দুজন ভাল মানুষের সাথেও হয়ত কোনো বনিবনা নাও হতে পারে। বিচ্ছেদ মানেই একপক্ষ খারাপ নয়। আল্লাহ তায়ালার হুকুমেই সব হয়েছে এবং তা অবশ্যই আমার ভালোর জন্যই হয়েছে।।
আমি যখন এসব বিপদে ছিলাম তখন আমার পরিবারের মানুষ গুলোও আমার পাশে ছিলো না কারন যদি বোঝা হয়ে যাই। দুই বোন এবং ভাই যোগাযোগ পর্যন্ত করেনি। কি ভাগ্য আমার। আমি বড় বোনের বাসায় গিয়েছিলাম, আমাকে সে বের করে দিয়েছে। আমি থাকার জন্য যাইনি শুধুমাত্র একটা কথা বলার জন্য গিয়েছিলাম। আমার মেজো বোন ফোন করাই বন্ধ করে দিয়েছিলো, যদি কোনো সাহায্য চাই। ভাইও কথা বন্ধ করে দিয়েছিলো, যদি তার বাসায় উঠি। এমনকি আমার মাও। আমার বাবা নেই। বাবা থাকলে আমাকে তিনি আগলে রাখতেন।
আমি একবার এগারো দিন শুধু পানি আর বিস্কিট খেয়ে ছিলাম অথচ আমার বাসায় সবাই দিব্যি খেয়েছে। আমার রাগ ভাঙাতে কেউ আসেনি। এরপর একবার ছাব্বিশ দিনে মাত্র আট বেলা ভাত খেয়েছি অথচ বাসায় আমিই রান্না করেছি কিন্তু আমার রাগ কেউ ভাংগায়নি। কিছু আত্মীয় স্বজন ছিলো যারা খুব কাছের। তারাও ক্ষতি করার অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু কেউ পারেনি। আল্লাহ ছিলো সাথে।
যখন আমার দিন ফিরতে শুরু করলো তখন আবার সবাই গা ঘেষতে শুরু করলো। আমি কাউকে ফিরাইনি। প্রয়োজনের চেয়ে বেশী করেছি। আর এটাই ছিলো আমার প্রতিশোধ। আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি কিন্তু সেই সব দিনগুলো কিছুতেই ভুলতে পারিনা। এই কঠিন সময় গুলোতে দুইটা মানুষ আমার পাশে ছিলো। আমার ছোটো ছোটো দুইটা ছেলে মেয়ে। আমি যখন কাঁদতাম ওরা আমাকে হাসাত। আমাকে বলতো আম্মু আমরা আছিতো তোমার সাথে। চিন্তা করি জীবনটা তো ওদেরকে নিয়ে সুন্দর হতে পারতো। মাঝে মাঝে মনে হয় এগুলো সব দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভাংগলেই দেখবো সব আমার মতো। সবাই আছে সেখানে। একটা সাজানো গোছানো সংসার।।
নানান দুঃখ বেদনা সহ্য করেও মনের গহীনে এখনো স্বামীর প্রতি রয়েছে তিসার গভীর ভালোবাসা। দূরে থেকেও স্বামীর মঙ্গল কামনা করেন সব সময়। কারন তিনি পরিবারের অমতে বিয়ে করা পছন্দের মানুষ, তার দুই সন্তানের বাবা।।
দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ আর নানান সমস্যার কারণে সন্তানদের নিয়ে আলাদা একটি বাসা ভাড়া নেন তিসা। কিভাবে বাসা ভাড়া দিবেন, সংসার চালাবেন কিভাবে এই ভাবনায় দিশেহারা তিসা। শুধু এইটুকু বিশ্বাস করেন সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এ পৃথিবীতে অসাধ্য বলতে কিছুই নেই। শুধু দরকার মানসিক জোর ও ইচ্ছাশক্তি। সেই অসাধ্যকে সাধন করতেই মানসিক জোর আর ইচ্ছাশক্তিতে বলিয়ান হয়ে পুনরায় শুরু করলেন পার্লারের কাজ। বাসার এক রুমকে পার্লার বানালেন। যদিও পার্লারের কোন সরঞ্জামাদি ছিল না। ক্লায়েন্টদের খাটে শুইয়ে ফেসিয়াল করাতেন । প্রথম যে ব্রাইডালটি করেন সেটি সম্পূর্ণ নিজের কসমেটিক্স দিয়ে। সেখান থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে কিনে ফেলেন কিছু কসমেটিক্স । এভাবেই একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকেন তিসা।
কাজ করতে করতে কর্মদক্ষতাকে আরো বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন । বিভিন্ন কোর্স ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে মাঝে মাঝেই ভোলা থেকে ছুটে আসেন ঢাকায়। এই ছুটে চলা বৃথা যায়নি তিসা’র। কাজ ভালো হওয়ায় প্রশংসা পেয়েছেন অনেকের কাছে। এভাবেই ধীরে ধীরে বেড়েছে কর্মব্যস্ততা, কাজের পরিধি। বাড়ছে পরিচিতি।
বিভিন্ন কোর্স ও কর্মশালায় অংশ নিয়ে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা যেমন বেড়েছে, জমা হয়েছে বেশকিছু সার্টিফিকেট। পেয়েছেন বেস্ট বিউটিশিয়ান এওয়ার্ড। এরই সুবাদে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার আমন্ত্রনে প্রায়ই ঢাকায় আসতে হয় তিসাকে। জীবন যুদ্ধে এগিয়ে চলা তিসা’র কর্মময় জীবনের সাক্ষাৎকার ছাপা হয় বিভিন্ন পত্রিকায়, দেখানো হয় টেলিভিশনেও।
তিশা বলেন, যারা আমার দুর্দিনে ভালো আছি তো দূরের কথা বেঁচে আছি কিনা সেটা জানতে চায়নি কখনো তারাই আজ আমাকে নিয়ে গর্ব করে বড় বড় কথা বলে। একদিন যে আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলেছিল তোর কি যোগ্যতা আছে আজ সেই আমাকে টিভিতে এবং পত্রিকায় দেখে অভিনন্দন জানিয়ে মেসেজ দেয়।
টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখে অনেকেই খুশি হয়ে ফোন দেয়, নানান রকম প্রশংসার বাণী ছোটায়। এই কথাগুলোতে আমি খুশি হইনি কখনো। খুশি হয়েছি তখন যখন আমাকে নিয়ে কারা সমালোচনা গুলো আলোচনায় পরিণত হল।
আমি জেদ করেছি, আমার নিজের একটা পরিচয় করবো। আমাকে কেউ অনুপ্রানিত করেনি। আমি আমার জেদ এবং যোগ্যতা প্রমানের জন্য এতটা পথ হেঁটেছি। ধন্যবাদ যদি দিতেই হয় তাদেরকে দিতে চাই যারা বারবার আমাকে টেনে নামাতে চেয়েছিলো, যারা আমার পিছনে আমাকে নিয়ে সমালোচনা করেছিলো, যারা ভেবেছিলো জীবন যুদ্ধে আমি ভেঙে পড়বো, যারা আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেছিলো আমার কি যোগ্যতা আছে।
আমার এই এতটা পথ হাটার পিছনে সম্পুর্ন অবদান তাদেরই, তাদের সমালোচনা গুলোই আমার প্রাপ্তিতে পরিনত হয়েছে, আমি কৃতজ্ঞ তাদের কাছে।
দুরন্ত শৈশবে চঞ্চল তিসা পড়ে গিয়ে একবার ডান হাত ভেঙ্গে ফেলেন। বড়বেলায় এসে ভাঙ্গেন ডান পা, বাম পা দুটোই । তবুও ভাঙ্গেনি মনের জোর।
তিসা বলেন, আমার মনের জোর শতভাগ। আমি জানি, আমি পারবো আমাকে পারতেই হবে।
আমি চাই ভবিষ্যতে অসহায় মেয়েদের জন্য কিছু করতে। আমার মত এত কষ্টের পথ যেনো কারো পাড়ি দিতে না হয়, অন্তত মানসিক সাপোর্ট হয়েও তাদের পাশে থাকতে চাই, যে সাপোর্টটা আমি পাইনি। আমি চাই প্রত্যেকটা মেয়ে স্বাবলম্বী হোক, যাতে তার দিকে কেউ আঙ্গুল তোলার আগে দশবার ভাবে।
আমার মতো সবাইকে যে মেক-আপ আর্টিস্টই হতে হবে এমনটা নয়। যার যা প্রতিভা আছে তাই তুলে ধরুন। শুধু যোগ্য হয়ে উঠুন, নিজের একটা পরিচয় করুন।
ভাল মানুষ বলে সবাই নিজেকে দাবি করে কিন্তু আমি বলবো আগে একজন নিরাপদ মানুষ হোন, নিরাপদ মানুষ’রা অবশ্যই ভাল মানুষ হয়। যেই জেদ ধবংস নয়, কিছু অর্জন করতে শেখায় সেই জেদেই জেদি হোক প্রত্যেক’টা মানুষ।
জীবন যুদ্ধে হার না মানা সাহসী যোদ্ধা নাহিদ নুসরাত তিসা সকল প্রতিবন্ধকতাকে পদদলিত করে এগিয়ে যাক বহু দূর। তিসার দৃঢ় সংকল্প ও সাহসিকতায় অনুপ্রাণিত হোক দেশের হাজারো নির্যাতিত নিপীড়িত অসহায় নারী। জয় হোক সাহসী নারী যোদ্ধাদের।