বিশেষ প্রতিনিধি : আরো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ভারত, বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক। করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে এই পাইপলাইনে নতুন যোগ রাশিয়া। সবার আগে করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বের সঙ্গে এ অঞ্চলের কূটনীতিতেও নতুন করে রাশিয়ার মাথা ঢোকানো অনেকের পিলে চমকে দিয়েছে।
ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে সবার আগে বাংলাদেশকে উপহার দেওয়ার ঘোষণা চীন দিয়ে রেখেছে শুরুতেই। এরই মাঝে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, তাদের ভ্যাকসিনও আসবে শিগগিরই। প্রতিবেশীদের মধ্যে সবার আগে পাবে বাংলাদেশ। এই ভ্যাকসিন কূটনীতির মাঝেই একেবারে ঝটিকা সাবজেক্ট সাপ্লাই দিয়েছে চীন। ১৫ আগস্টে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিনে উপহার পাঠিয়ে নতুন খোরাক দিয়েছে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস। একদিকে সরকারের সঙ্গে বহুমাত্রিক কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের কর্মসূচি, আরেকদিকে খালেদা জিয়ার জন্মদিনে শুভেচ্ছা পাঠানোর এ চীনা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কূটনৈতিক মহলে চরম ঝাঁকুনি দিয়েছে। এর দুই দিনের মাথায় আরেক ঝটিকা কাণ্ড ঘটাল ভারত। দেশটির পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা দৌড়ে আসার মতো ছুটে এলেন ঢাকায়। রীতিমতো হুলুস্থুল ব্যাপার। কোনো কিছুতেই স্পষ্ট নেই। সব সারফেস। ভাসা ভাসা। ঝাঁপসা। সব যে আসলে করোনার টিকা বা ভ্যাকসিন নিয়ে, তা-ও নয়। এর আড়ালে রয়েছে নানা হিসাব।
এর আগে চীনা দূতাবাস কখনো খালেদা জিয়ার জন্মদিনের উপহার পাঠায়নি। এ বছরই প্রথম উপহার পাঠানো হয়েছে। এমনিতেই ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে খালেদা জিয়ার জন্মদিন উদযাপন বিতর্কিত বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে যারপরনাই ক্ষুব্ধ। রাজনৈতিক বাস্তবতায় গত বছর কয়েক ধরে খালেদা জিয়ার জন্মদিন আয়োজন সীমিত করা হয়েছে। আনন্দকে নামিয়ে আনা হয়েছে মিলাদ মাহফিলে। এ রকম অবস্থায় এ বছর ঢাকায় চীনা দূতাবাস থেকে খালেদা জিয়ার জন্য উপহারসামগ্রী পাঠানো সরকারের কাছে খুব ইঙ্গিতপূর্ণ ঠেকছে। আবার রহস্য পরিষ্কারও হচ্ছে না। চীনের এমন চিকন কাজের মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শ্রিংলার ঢাকায় রহস্যঘন ঝটিকা সফর। ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন সূত্র মারফতে তাদের পররাষ্ট্রসচিবের সফরের বিষয়টি লুকোচুরির মতো সংবাদমাধ্যমকে জানায়। তাও নিশ্চিত করছিল না। গত মার্চের পর এটি তার দ্বিতীয় ঢাকা সফর। এর আগে বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ছিলেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। এ বছরের জানুয়ারিতে সে দেশের পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন।
গ্লোবাল রাজনীতির উপসর্গের নানা ইস্যুতে এরও আগে শত্রুরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ফোনালাপকে ঘিরে গুঞ্জনের রেশ এখনো শেষ হয়নি। সেখানেও চীন-ভারতের নানা সমীকরণ। তার ওপর ভারতের বিদায়ী হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলিকে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না দেওয়ার ঘটনার কোনো ফয়সালা আসেনি। তা ডালপালা ছড়াচ্ছে নানাদিকে। রহস্যের মধ্যেই বিদায় নিতে যাচ্ছেন তিনি। তার জায়গায় ঝানু আরেকজনের পদার্পণ ঘটতে যাচ্ছে ঢাকায়। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ঢাকায় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আসা রিভা গাঙ্গুলি দাশ আরো বড় দায়িত্বে যাচ্ছেন। সব ঠিক থাকলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব নেবেন তিনি। এটিও ঢাকার জন্য ভাবনার বিষয়।
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন। কাকতালীয়ভাবে স্বামী নামযুক্ত একজনই বাংলাদেশে আসছেন পরবর্তী হাইকমিশনার হয়ে। তিনি ঝানু কূটনীতিক বিক্রম দোরাইস্বামী। ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে তাকে নিয়ে বেশ প্রচার চলছে। ১৯৯২ ব্যাচের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বিক্রম দোরাইস্বামী অতিরিক্ত সচিব হিসেবে আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সম্মেলন বিভাগের ইনচার্জ। এর আগে ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়া ও উজবেকিস্তানে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব থাকার সময়ে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার বিভাগে নানা দায়িত্ব পালন করেছেন। মন্ত্রণালয়ের সার্ক বিভাগের প্রধানের দায়িত্বেও ছিলেন কিছুদিন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার আগে বিক্রম দোরাইস্বামী কিছু সময় সাংবাদিকতাও করেছেন।
চীন তিস্তা প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ফান্ড দিতে যাচ্ছে-এমন খবরে উদ্বিগ্ন দিল্লি। ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সাফল্য না পাওয়ায় খরা বা শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর পর্যাপ্ত রাখতে ভারতের প্রতিপক্ষ চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পাওয়া ভারতের জন্য মর্মবেদনার। সব ঠিক থাকলে ডিসেম্বরেই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হতে পারে। এ ছাড়া বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরআই প্রকল্পে বাংলাদেশে পরিকাঠামো গড়তে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের উদ্যোগ করেছে চীন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এ নৈকট্য ভারতকে চরম ভাবিয়ে তুলেছে।
রহস্যঘন এমন সময়েই বাংলাদেশের সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দেওয়ার ঝটিকা দাবিতে সোচ্চার একটি মহল। এ নিয়ে আদালতের দিকেও ছুটেছে তারা। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা চালু করার দাবিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ১০ জনকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশে এই চারজন ছাড়াও বিএনপির মহাসচিব, জাতীয় পার্টির মহাসচিব, গণফোরামের ড. কামাল হোসেন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননকে বিবাদী করা হয়েছে। নোটিশটি পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অশোক কুমার ঘোষ। তিনি বাংলাদেশ মাইনরিটি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি। লিগ্যাল নোটিশে বলা হয়েছে, সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ না দিলে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নও হবে না। এর ঠিক বিপরীত এবং ভয়ংকর আরেকটি তৎপরতাও জোরদার। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায়ে পর্যন্ত হিন্দু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা প্রচার শুরু হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। সিভিল সার্ভিস এবং সরকারের বড় বড় প্রকল্প, করপোরেশন ইত্যাদিতে হিন্দুদের শীর্ষ অবস্থানগুলো কবজা করা, খবরদারির ফিরিস্তি দিয়ে এই প্রচারণা বেশি বাড়তে দিলে দাঙ্গার মতো অঘটনের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যা হিন্দু সম্প্রদায় এবং ভারতের জন্য অত্যন্ত অ্যালার্মিং।