সুশান্ত হালদার -এর ফেসবুক পোস্ট
যে ক’জন ইউরোপের কবি আজকের দিনে অত্যন্ত আদরের সঙ্গে পঠিত, শার্ল বোদলেয়ার তাঁদের অন্যতম। অনেক মহৎ ফরাসি কবির মতো তাঁর জন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে।
৬০ বছর বয়সে তাঁর বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন ২৫ বছরের এক যুবতীকে, যে তাঁর বাবার বন্ধুর আশ্রয়ে লালিত। এতিম ও নিঃস্ব এই যুবতী এর চেয়ে ভালো কোনো পাত্রও আশা করেননি। প্রায় দুই বছর পর (এপ্রিল ৯, ১৮২১) এই ঘরে জন্ম নেন শার্লক বোদলেয়ার। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। তাঁর মা আবারও বিয়ে করেন মেধাবী সাহসী নীতিবান এক সৈনিককে (যিনি পরে রাষ্ট্রদূত ও সিনেটরও ছিলেন)। তাঁর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে বোদলেয়ার সহজে মেনে নিতে পারেননি এবং পরবর্তীকালে মানসিক ভারসাম্যতাহীন অসুখী জীবনের কারণও হয়ে দাঁড়ায়। তবে সৎবাবা তাঁকে ভালোবাসতেন এবং তাঁর সুন্দর ভবিষ্যৎ চাইতেন। কিন্তু বোদলেয়ার তাঁকে অনীহার চোখে দেখতেন।
বোদলেয়ারের লেখালেখির হাতেখড়ি লাতিন কবিতা দিয়ে। মা-বাবাকে খুশি রাখার জন্য স্কুলে গেলেও গোপনে লেখালেখিতেই মন ছিল। তাঁর বাবার বন্ধুর সঙ্গে তাঁকে ১২-১৫ মাসের জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেন। যাত্রাপথে ঝড়ে জাহাজের ক্ষতি হলে মেরামতের জন্য মরিসাসে নোঙর করে। জাহাজে বোদলেয়ার সঙ্গীদের একদম পছন্দ করেননি। তিনি ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় মরিসাসে সাহিত্যমোদি কিছু তরুণের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এবং যে বাড়িতে তিনি থাকতেন তাঁর স্ত্রীর প্রেমে পড়েন। বেশ আনন্দেই কাটছিল দিনকাল। তবে এ ভ্রমণই তাঁর ভেতরে জন্ম দেয় স্বদেশের আকুতি।
ফ্রান্সে ফিরে এসেই তিনি তাঁর বাবার রেখে যাওয়া বিপুল অর্থের মালিকানা পান উত্তরাধিকার সূত্রে এবং ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর এ সময়ের সাহিত্য রচনায় ঘৃণা, অমরত্ব এবং স্যাটানিক চিন্তাভাবনা প্রবল হয়ে উঠে। তিনি Les Fleurs du Mal-এর জন্য পুরোদমে কবিতা লিখতে শুরু করেন। Une Charogne-এর মতো বিখ্যাত প্রেমের প্রতি ঘৃণা ও অবক্ষয়ের কবিতাসহ ঈশ্বর নিন্দা ও স্যাটানিক প্রকৃতির বেশ কিছু কবিতা লেখেন। আর এ সময়েই তিনি উন্মাসিক ও প্রথাবিরোধী কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বলা যায়, এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়। বেহিসাবি খরচের জন্য বছর দুয়েকের মধ্যেই তাঁর গচ্ছিত সম্পদ অর্ধেকে নেমে আসে। আইন অনুযায়ী সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় এবং আরো নিয়ম করা হয় যে তিনি শুধু সম্পদের লভ্যাংশই খরচ করতে পারবেন, মূলধন নয়। এ সিদ্ধান্তে তিনি মর্মাহত হন। তিনি জাঁকজমক বেশভূষা চিরদিনের জন্য পরিত্যাগ করেন। হতাশার কবিতা লেখতে শুরু করেন। তিনি লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং লেখালেখি করেই জীবিকার্জনের চেষ্টা শুরু করেন। তাঁর প্রথম নন্দনতত্ত্ববিষয়ক লেখা Salons of 1845 and 1846 এ সময়েরই লেখা।
১৮৪৮ সালের বিপ্লবে সামান্য ভূমিকাও রাখেন। বিখ্যাত চিত্রকর কোরবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং যাঁর সক্রিয় প্রভাবে তাঁর কবিতায় রিয়ালিজমের উন্মেষ ঘটে। তাঁর মতে, সেই লেখকই টিকে থাকবেন, যাঁর লেখা তাঁর সময়কে সঠিকভাবে ধরে রাখতে পারবেন। এবং তিনিই প্রথম কবি, যিনি আধুনিক শহরের সৌন্দর্য এবং ক্ষয়ে যাওয়া একই ক্যানভাসে তুলে ধরেন। ফরাসি বিপ্লবের অপ্রত্যাশিত ফলাফলে অন্য লেখকদের সঙ্গে তিনিও বিষণ্ন ও নিরুৎসাহে গা ভাসিয়ে দেন। এই সময় সুইডিস দার্শনিক সুইডেনবর্গ ও এলেন পোর রচনাবলি তাঁকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে। ১৮৫২-১৮৫৭ অর্থাৎ Les Fleurs du Mal-এর প্রকাশকাল পর্যন্ত তাঁর লেখা ছিল সবচেয়ে পরিশীলিত এবং পরিপক্ব। অনেকের ধারণা, বোদলেয়ার লেখক হিসেবে খ্যাতি না পেলেও এলেন পো-র অনুবাদক হিসেবে ফরাসি সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেতে সক্ষম হতেন।
তিনি বিশ্বাস করেন যে বস্তুর অস্তিত্ব আছে। কারণ তারা আমাদের মননে প্রোথিত। তিনি এ-ও মনে করেন যে পৃথিবীর সব কিছুই বস্তুত বর্ণমালার চিত্রলিপি আর শিল্পীর কাজ তাঁর রহস্য উদ্ধার। বস্তুর সৌন্দর্যে সার্থকতা নেই,যদি কবি সেই সৌন্দর্যকে তাঁর সৃষ্টিতে ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। সৌন্দর্য হচ্ছে আগুনের শিখা, শক্তির লাভা। তাঁর মতে, তিনিই প্রকৃত কবি, যাঁর কবিতায় আধ্যাত্মিক ভাবনার উত্তরোত্তর পরিণতি এবং নির্মাণ কৌশলে তার সুস্পষ্ট ছাপ রাখতে সমর্থ হবেন। বোদলেয়ারের এই ভাবনা শতাব্দীর শেষপাদে ফরাসি কবিতাকে ভীষণভাবে বদলে দেয়। ১৮৫৭ সালে Les Fleurs du Mal-এর প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়। বোদলেয়ার তাঁর বইয়ের সাফল্য আশা করেছিলেন মনেপ্রাণে। কিন্তু ঘটে গেল ভিন্ন এক ঘটনা। Les Fleurs du Mal প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতা এবং ঈশ্বর নিন্দার অভিযোগ আনা হয়। পরে আদালত ঈশ্বর নিন্দার অভিযোগ তুলে নিলেও অশ্লীলতার জন্য অভিযোগ বহাল রাখে এবং কিছু কবিতা বাদ দিয়ে বাজারজাত করার অনুমতি দেন। অবশেষে তিনি পরবর্তী সংস্করণ বাজারজাত করতে রাজি হন এই ভেবে যে, বাতিলকৃত কবিতার স্থলে নতুন কবিতা জুড়ে দেবেন এবং তাঁর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রথম সংস্করণের চেয়ে উন্নতমানের হবে । সমালোচকরাও তা স্বীকার করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর লেখা সব কবিতাই তৃতীয় সংস্করণে স্থান পায়।
Les Fleurs du Mal-এর অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতায় বোদলেয়ার এতটাই নিরাশ হয়ে পড়েন যে তাঁর নিজস্ব কাব্য দর্শনের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এ সময় তাঁর শরীরেও ভাঙন দেখা দিতে শুরু করে। তিনি নৈরাশ্যবাদী কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। Les Fleurs du Mal-এর দ্বিতীয় সংস্করণও অর্থনৈতিকভাবে কোনো সুফল আনেনি। তাঁর প্রকাশক ১৮৬২ সালে দেউলিয়া হয়ে পড়েন এবং পাওনাদারদের ভয়ে বেলজিয়ামে পালিয়ে যান।
প্রকাশকের ঋণ কিছুটা শোধ করার জন্য বোদলেয়ার নিজেও পাড়ি দেন বেলজিয়ামে, ১৮৬৪ সালে বক্তৃতা সফরে। দ্বিতীয় সম্রাটের সময় ফ্রান্সের অনেক লেখক তখন ব্রাসেলসে নির্বাসিত ছিলেন, ফলে ব্রাসেলসের সাহিত্যাঙ্গন তখন বেশ রমরমা। তাঁর বক্তৃতাও বেলজিয়ামে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি এবং তাঁর লেখারও তেমন কেউ কদর করেননি। তাঁর অহংবোধ তাঁকে প্যারিসে ফিরতে বাধা দেয়। সেখান থেকেই তিনি ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের প্রকাশকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান তাঁর লেখার নতুন সংস্করণ প্রকাশের জন্য। কিন্তু প্রকাশকদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই তিনি পক্ষাঘাতে অক্রান্ত হন। সামান্য সেরে উঠতেই তিনি প্যারিসে ফিরে যান; কিন্তু তাঁর বাকশক্তি আর তিনি ফিরে পাননি।
৩১ আগস্ট ১৮৬৭ সালে তিনি মারা যান। গ্রীষ্মের ছুটিতে প্যারিস তখন প্রায় সাহিত্যবোদ্ধাশূন্য ছিল। তাঁর সৎবাবার পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠজনও অনুপস্থিত ছিলেন। এমনকি Les Fleurs du Mal বইটি যে বন্ধুকে উৎসর্গ করেছিলেন, তিনিও গরহাজির ছিলেন। তাঁর মাত্র দুজন বন্ধু কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সামান্য কিছু বলেন। তাও তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়েই, সাহিত্যের নয়। তাঁদের মধ্যে একজন তরুণ কবি, যাঁর সঙ্গে কোনো দিন বোদলেয়ারের সাক্ষাৎ ঘটেনি, বোদলেয়ারের তিরোধানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি, পল ভারলেইন, তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন মাত্র ২১ বছর বয়সে। এবং তাঁর কবিতা ছিল বোদলেয়ার দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত।
বোদলেয়ারের সব লেখা নিলামে বিক্রি করা হয় ৭০ পাউন্ডে। তাঁর মৃত্যুর ৭০ বছর পর্যন্ত তাঁর রচনাবলি পাঠক সমালোচকদের মধ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আলোচনায় আসে। ফ্রাঙ্কো-প্রুসিয়ান যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয়ের পর দ্বিতীয় সম্রাটের সব চিন্তাভাবনা বর্জন করে আকস্মিকভাবেই পটপরিবর্তন হতে থাকে এবং লেখকরা নতুন ভাবনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ সময় অনেকেই বোদলেয়ারের রচনা ও দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। আশি ও নব্বইয়ের দশকে তিনি এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন যে, যা কিছু অধঃপতিত, নীতিবিরোধী, কলুষিত এবং বিকৃত তার সঙ্গেই বোদলেয়ারের নাম যুক্ত হতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ শান্তির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং তাঁর প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণাগুলোও বদলাতে থাকে। ইতিমধ্যে তাঁর রচনাবলি কপিরাইটমুক্ত হয়। ফলে নতুন করে তাঁর বইয়ের অসংখ্য সংস্করণ বের হতে থাকে। এ কথা নিশ্চিত যে বোদলেয়ার বৈচিত্র্যময় কবিসত্তার অধিকারী ছিলেন। আর তাই একদিকে তিনি যেমন কলুষিত ও কুৎসিতের প্রতীক ছিলেন আবার অন্যদিকে একজন মহৎ আধ্যাত্মিক কবিও ছিলেন। তাঁকে বলা হয় সূক্ষ্ম ও বিরল অনুভূতির কবি, আবার তিনি স্মৃতি জাগানিয়া ও ইঙ্গিতময় এবং একই সঙ্গে জীবনমুখী বাস্তবতার কবিও। প্রেমের কবি হিসেবে তিনি ফরাসিদের মধ্যে অন্যতম এবং সেরা আধ্যাত্মিক কবিদের একজন। কিছু কবিতায় তিনি ঈশ্বর ও অধিবিদ্যায় সমর্পিত আবার কিছু কবিতায় তিনি সমাজ ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার রূপকার। আজকের দিনে কাব্যবোদ্ধাদের অনেকেই মনে করেন, তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর উৎকর্ষ চিরকালের মহৎ কবিতার মধ্যে অন্যতম।
শার্লক বোদলেয়ারের ভাষান্তরিত একটি কবিতা –
অচেনা মানুষ
- বলো আমাকে, রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে বেশী ভালবাস:
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নীকে?
- পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী - কিছুই নেই আমার।
- তোমার বন্ধরা?
- ঐ শব্দের অর্থ আমি কখনো জানিনি।
- তোমার দেশ?
- জানি না কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।
- সৌন্দর্য?
- পারতাম বটে তাকে ভালবাসতে- দেবী তিনি।
- কাঞ্চন?
- ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ভগবানকে।
- বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কি ভালবাসো তুমি?
- আমি ভালবাসি মেঘ…চলিঞ্চু মেঘ…ঐ উঁচুতে….ঐ উঁচুতে….
আমি ভালবাসি আশ্চর্য মানুষ!