দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কথাশিল্পী রাহাত খান আর নেই। শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনের বাসায় তিনি মারা যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাহাত খানের স্ত্রী অপর্ণা খান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, রোববার বাসায় খাট থেকে নামতে গিয়ে কোমরে ব্যথা পান তিনি। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে এক্স-রে করা হলে পাঁজরে গভীর ক্ষত ধরা পড়ে। তারপর থেকে বাসায় বিশ্রামে ছিলেন তিনি। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে তাকে বারডেম হাসপাতালের আইসিউতে ভর্তি করা হয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, কিডনি, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ জটিলতায় ভুগছিলেন বলে জানান তার স্ত্রী।
অপর্ণা খান জানান, করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে তিনি সার্বক্ষণিকভাবে বাসাতেই অবস্থান করছিলেন। তবে গত দুই তিন দিন ধরে তিনি খাবার গ্রহণ করতে পারছিলেন না। প্রখ্যাত সাংবাদিক রাহাত খানের দ্রুত সুস্থতার জন্য তার স্ত্রী অপর্ণা খান সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।
রাহাত খান ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পূর্ব জাওয়ার গ্রামের খান পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেন। কর্মসূত্রে রাহাত খান আপাদমস্তক সাংবাদিক। ১৯৬৯ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তার সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি।
পরবর্তীতে ষাটের দশকে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগদান করেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক বর্তমান পত্রিকা। বর্তমানে তিনি দৈনিক প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
রাহাত খান ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। জনপ্রিয় ও বিখ্যাত থ্রিলার সিরিজ সিরিজ মাসুদ রানার রাহাত খান চরিত্রটি তার অনুসরণেই তৈরি করা।
রাহাত খান ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে রাহাত খান কিছুদিন জোট পারচেজ ও বীমা কোম্পানিতে চাকরি করে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে যোগদান করেন।
তারপর একে একে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করার সুযোগ আসে তার।
বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে রাহাত খান কথাশিল্প, ছোটগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও উপন্যাসের নিপুণ কারিগর হয়ে উঠেছেন। ১৯৭২ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ অনিশ্চিত লোকালয় প্রকাশিত হয়। তার পরবর্তী উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অমল ধবল চাকরি, ছায়াদম্পতি, শহর, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্য মাঠের খোলোয়াড়, এক প্রিয়দর্শিনী, মন্ত্রিসভার পতন, দুই নারী, কোলাহল ইত্যাদি।
ইতিমধ্যেই বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৩), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), সুফী মোতাহার হোসেন পুরস্কার (১৯৭৯), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮২), ত্রয়ী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় একুশে পদক (১৯৯৬) পেয়েছেন।
রাহাত খানের উপন্যাসে বিচিত্র মানুষ
ভালোমন্দ মানুষ উপন্যাসে রাহাত খান মানব-মানবীর প্রেম-প্রণয়, মানসিক দ্বন্দ্ব ও ভারতীয় উপমহাদেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস ও চোরাচালান চক্রের কর্মকান্ড বর্ণনার পাশাপশি ভালো ও মন্দ মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করেছেন। আলোচ্য উপন্যাসে তিন গুচ্ছ মানুষের জীবনপ্রণালী চিত্রিত হয়েছে। প্রথম গুচ্ছে কানিজ রেজা ও আবিদুর রেজা, দ্বিতীয় গুচ্ছে শাফাত আরা কুঞ্চি-মাহমুদ দম্পতি ও তাদের বন্ধু সাজ্জাদ, তৃতীয় গুচ্ছে ভারতীয় সন্ত্রাসী জয়নাল ওরফে জয়ন্ত, নলিনী ও আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীরা। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও মিয়ানমার (বার্মা) এর আন্ডার ওয়ার্ল্ড তথা সন্ত্রাসী জগৎকেও লেখক এখানে চিত্রিত করেছেন।
উপন্যাসের প্রথম আখ্যানে বর্ণিত হয়েছে কানিজ রেজা ও আবিদুর রেজার জীবনযাত্রা। কানিজ রেজার স্বামী আবিদুর রেজা। চিকিৎসকের পরামর্শে হাওয়া বদলে তারা ঢাকা থেকে কক্সবাজারে এসেছেন। মধ্য আগস্টের এই সময়ে কক্সবাজারে পর্যটকের ভিড় অনেক কম। হোটেল-মোটেলে থাকা-খাওয়ার খরচও কম। শীত সিজনের মতো সি-বিচে ভিড় না হলেও লোকজন একেবারে কম নয়। তবে বিদেশিদের চেয়ে দেশি জনগণই বেশি। কানিজ রেজা গত পাঁচ দিন কক্সবাজারে এসে জয়নাল নামে এক যুবকের আকর্ষণে উদ্বেলিত। যদিও স্বামী আবিদুর রেজার সঙ্গেই থাকেন তিনি, তথাপি তার মন উচাটন। লেখক তার দেহের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
কানিজ রেজার দেহের গড়ন পাতলা। তার বয়স ৪৪ বছর। তাকে ঢের কম বয়স বলে মনে হয়। সব সময় গোছগাছ হয়ে থাকেন। আজ পরেছেন তিনি সবুজ সিল্কের তিন প্রস্থ সালোয়ার-কামিজ। ব্রার কল্যাণে তার স্তন জোড়া উন্নত ও সুডোল দেখায়। চোখে পরে আছেন আচ্ছা কালো রঙের গগল্স। (পৃ.৮)
জয়ন্তর খুনের হাতেখড়ি নলিনীর প্রেমিক যোগেশকে দিয়ে। নলিনী তার প্রেমিক ছিল। জয়ন্তর চেয়ে বয়সে অনেকটা বড় ছিল মহিলাটি। সে গোপনে হেরোইন পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। জয়ন্ত তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে অশ্বিনী স্কুলের মাঠে খেলতে যেত। নলিনী চুল বেঁধে, সেজেগুজে বসে থাকত বাড়ির সামনে। প্রায়ই জয়ন্তকে ডেকে আদর করে নাস্তা খাওয়াতো, টাকা দিত। এভাবেই জয়ন্তকে হাত করে সে। এরপর জয়ন্তকে দিয়ে হেরোইন ও গাঁজার চালান বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতো এবং তাকে যথেষ্ট পরিমাণে টাকা দিত। জয়ন্ত তখন কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী, স্বাস্থ্যটা ভালো। গাট্টাগোট্টা শরীর। খেলাধুলায় প্রাইজ পায়।
এই জয়ন্তই দেখে পুলিশ নলিনীর বাড়ি যায়, নাস্তা খায় আর সেলামির টাকা নিয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে যায়। নলিনী তাকে বুঝাতে সক্ষম হয়- টাকা ছাড়া দুনিয়া অচল। টাকাই এই ভবজগতে আসল ভগবান। যার টাকা আছে তার ইহকাল-পরকাল দুই-ই আছে। নলিনী সেদিন এরকম শিখিয়েছিল জয়ন্তকে। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল জয়ন্ত। তার তখন অভাবের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সংসারে টানাটানি কাকে বলে তা সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে শিখেছে। টাকা প্রসঙ্গে নলিনীর বক্তব্যটায় মুগ্ধ হয়ে যায় সে। নলিনী তাকে টাকার নেশা ধরিয়েছিল। আর ধরিয়েছিল মেয়ে মানুষের শরীরের নেশা। সেই মেয়ে মানুষটা আর কেউ নয়, নলিনী নিজেই। লেখকের ভাষায়-
এক দুপুরে নলিনী বলে : জয়ন্ত আয় একটু গল্প করি।
বিছানায় গিয়ে শোয় তারা দু’জন। নলিনীর বয়স ৩৬/৩৭। একটা বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর আর সে চেষ্টা করেনি। শরীরটা পাতলা ছিপছিপে। খুব সেজেগুজে থাকত। বিছানায় শোওয়ার পর গল্প বলা কিছুক্ষণের মধ্যেই শিকেয় ওঠে। নলিনী, ওকে সাপিনীর মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চুমুর পর চুমু খেতে থাকে। গায়ের জামা কি একটা বাহানায় আগেই খুলে ফেলেছিল সে। (পৃ.৩২)
এরপর নিয়মিতই রতিক্রিয়ায় মিলিত হতো তারা। তবে নলিনীর প্রেমিকের সংখ্যা ছিল একাধিক। জয়ন্ত সেটা সহ্য করতে না পেরে নলিনীর প্রেমিক যোগেশকে হত্যা করে। এরপর সে পালিয়ে যায় কলকাতায়। সেখানে দুলাল সিংয়ের ডেরায় ঠাঁই মেলে তার। দুলাল সিংয়ের একটা আন্তঃরাজ্য কিলিং স্কোয়াড আছে। বাংলাদেশ, বার্মা, নেপাল প্রভৃতি দেশেও দুলাল সিংয়ের লোকজন এবং মিত্র রয়েছে। আন্তঃদেশীয় কিলিং সিন্ডিকেটের সদস্য এরা। ওরা জয়ন্তকে ট্রেনিং দেয়। জয়ন্ত ভাড়াটে খুনি হিসেবে ঢুকে পড়ে দুলাল সিংয়ের দলে। এর মধ্যে পুলিশের হাতে সে কয়েকবার ধরা পড়েছে, জেলও খেটেছে দুই বছর। তবে এখন যাই ঘটুক, মাথার ওপর সিন্ডিকেটের ছাতা আছে তার। যেখানেই যাক, সিন্ডিকেট তাকে সাহায্য করবে।
আলোচ্য উপন্যাসের আরেক গুচ্ছ চরিত্র সাজ্জাদ ইমাম, শাফাত আরা কুঞ্চি ও মাহমুদ নজীর। একজন শিল্পপতি অন্য দুজন শিক্ষক। এদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো- এরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সাজ্জাদ ইমাম এমন একজন মানুষ, যার মনে দ্বৈতসত্তা বিদ্যমান। তার বাবা কাড়ি কাড়ি সম্পদের মালিক- শিল্পপতি। বাবার যে অঢেল ধন-সম্পদ আছে, তা দিয়েই সে এবং তার কয়েক পুরুষ বিনা পরিশ্রমে খেয়ে-দেয়ে আনন্দ-ফুর্তিতে সময় অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু সে অলস বা কর্মবিমুখ নয়, কাজের মধ্যেই তার সার্থকতা খুঁজে পায়। তার মনে যে দ্বৈতসত্তা সক্রিয়, সেখানে একটি সত্তা তাকে বসে বসে আরাম-আয়েশ ভোগ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে; আরেকটি সত্তা দেশের দরিদ্র জনসাধারণের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে শিল্প-কারখানায় অর্থ বিনিয়োগের আহ্বান জানায়। তার সামনে উদ্ভাসিত হয় ‘টাটা’, ‘বিড়লা’, ‘ওয়ালটন’, ‘ওয়ালমার্ট’ ইত্যাদি বিখ্যাত মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি। তার ভাষায়-’ব্যবসা করুম, লক্ষ্য থাকবে গরিবি হটানো। দেশে ৪ হাজার কোটি টাকার অর্থ সঞ্চালন কইরা আমি বাংলাদেশে ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করুম।’(পৃ.১৬)
সাজ্জাদ ইমাম কক্সবাজারে এসেছে ব্যবসায়িক কর্মসূচি নিয়ে। ছাত্রজীবনে সে শাফাত আরা কুঞ্চির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, তাদের মনের গ্রন্থিও ছিল খুব কাছাকাছি। কিন্তু মাহমুদের সঙ্গে পরিচয়ে তাদের সে গ্রন্থিতে ছেদ পড়ে। মাহমুদ ও কুঞ্চি শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হয়। সাজ্জাদ আপাত দৃষ্টিতে তাদের সম্মুখ থেকে হারিয়ে যায়। পাড়ি জমায় বোম্বাই, আগ্রা ও দিলিস্নতে। দীর্ঘ দেড় মাস পর দেশে ফিরে এলেও কুঞ্চির সঙ্গে আগের মতো আর ঘনিষ্ঠ হতে পারে না। অথচ ছাত্রজীবনে তারা অনেক ঘনিষ্ঠ ছিল- ওরা দুজন সপ্তাহ শেষে শহরের বাইরে ঘুরতে যেত, খেতে যেত বিভিন্ন ফাস্টফুডের দোকানে, রেস্তোরাঁয়। দেখা হলে দুজনার দুজনকে জড়িয়ে ধরা, গালে চুমু খাওয়া, ক্যাম্পাসে হাত ধরাধরি করে হাঁটা- এগুলি ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। আগের সেই সম্পর্ক না থাকলেও এ আচরণে তারা এখনও অভ্যস্ত, আর মাহমুদেরও এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তার চিন্তা সংসার নিয়ে। মাহমুদ সরকারি কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক, কুঞ্চি গার্লস কলেজের ম্যাডাম। দুজনের মিলিত আয় থেকে প্রতিমাসে একটা অংশ তাদের সন্তান ‘নান্নে’র জন্য তারা সঞ্চয় করে। নান্নের লেখাপড়া, বিদেশ গমন প্রভৃতি কাজে এ সঞ্চয় সহায়ক হবে। ফলে তাদের সংসারে মাঝে মাঝে একটু টানাটানি হয়। দুজনেই এ টানাটনি হাসিমুখে বরণ করে।
কুঞ্চি ও মাহমুদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাজ্জাদ। সাজ্জাদই তাদের প্রথম পরিচয়ের অনুঘটক। জীবিকা উপার্জনে কুঞ্চি ও মাহমুদ এখন কক্সবাজারে, আর সাজ্জাদ ঢাকায়। আশচর্যজনক বিষয় হলো কুঞ্চি-মাহমুদের ঘর আলো করে একটি সন্তান এলেও সাজ্জাদ এখন পর্যন্ত বিয়েই করেনি। সে ছাত্রজীবনে কবিতা রচনা ও গানচর্চা করত, যার সঙ্গে পরিচয় ছিল কুঞ্চির। সাজ্জাদ কক্সবাজারে আসায় তিন জন নবীন কবি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে এবং কুঞ্চি ও মাহমুদের কাছ থেকে তারা যে কবির কবিত্বশক্তির পরিচয় জেনেছে- সে কথাও উলেস্নখ করে। নবীন কবিরা নাছোড় বান্দা। তারা কবিকে নিজেদের কবিতা শোনাবে এবং কবির কবিতাও শুনবে, সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি নিয়ে কবির দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতে বলবে। অপরপক্ষে সাজ্জাদ মনে করে তার সকাল-দুপুরটা মাটি করার ষড়যন্ত্র করেই কুঞ্চি-মাহমুদ এই তিন স্থানীয় কবিকে তার কাছে পাঠিয়েছে। সে তাদের দশ মিনিটের ভেতর বিদায় দেয়ার পরিকল্পনা করে। সে নবীন কবিদের কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখার পরামর্শ দেয়। সে বলে- ঢাকাইয়া, মৈমনসিংহ, নোয়াখাইল্যা ও বরিশাইল্যা ভাষায় যদি কবিতা লেখা যায়, তাহলে কক্সবাজারের ভাষায়ও কবিতা লেখা যাবে। নিরেট আঞ্চলিক শব্দ নিয়ে লিখতে হবে কবিতা। তার ভাষায়-
বাংলা কবিতার একটা বিপস্নব ঘটাতে হবে। আঞ্চলিক ভাষায় ভাব প্রকাশ করা সহজ হয়। শব্দগুলো প্রাণের সঙ্গে মিশে থাকে। বাংলাদেশে সবকটা আঞ্চলিক ভাষায় যদি এভাবে কবিতা লেখা হতে থাকে, তাহলে একদিন না একদিন বাংলা কবিতার রূপান্তর ঘটতে বাধ্য। আমরা বিভিন্ন অঞ্চলের কবিতা থেকে পেয়ে যাব অনেক নতুন শব্দ। বহু বৈচিত্র্যপূর্ণ বাকভঙ্গি। তবে বৈচিত্র্যেও দিক থেকেও ঐশ্বর্য জোগাবে বাংলা ভাষাকে। (পৃ.১৮)
এভাবে বক্তৃতা দিয়ে মিনিট দশেকের ভেতর তিন কবিকে বিদায় করে সাজ্জাদ ইমাম। এ কৌশল অবলম্বন করা ছাড়া উপায় ছিল না তার। সে আজ মহাব্যস্ত। সারাদিন তার রুটিন ওয়ার্ক নির্ধারিত। যেমন- সাড়ে ১০টায় মার্কেটিং টিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ, পুরো দেড় থেকে দুই ঘণ্টা চলবে মতবিনিময়। এরপর লাঞ্চ, তারপর আড়াইটার সময়ে টুরিস্ট লজের সাইট দেখতে যাওয়া। সাইট দেখতে তাকে নিয়ে যাবে স্থানীয় এক লোক, সঙ্গে থাকবে কুঞ্চি ও মাহমুদ। অথবা শুধু মাহমুদ। কুঞ্চি যাবে কি না, এখনও নিশ্চিত করে বলেনি। তবে কুঞ্চি গেলে বড়ই খুশি হয় সাজ্জাদ। এই একটা মেয়ে, যাকে দুই সাজ্জাদ ইমামই অনুমোদন দেয়। তবে কুঞ্চি সাজ্জাদ ইমামের হয়ে থাকতে চাইল না কেন যেন। দুজনের বন্ধুত্বের কোনো ঘাটতি ছিল না। একসঙ্গে আহার-বিহার সবই ছিল। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক নাগাড়ে তারা বসে থেকেছে রমনা গ্রিনে। ভালোলাগা-ভালোবাসা কাউকে প্রথমে ভাসিয়ে নিয়ে বোকা বানিয়ে দেয়। কুঞ্চির পালস্নায় পড়ে সাজ্জাদ কিছুদিন ওই রকম হয়ে গিয়েছিল। নিরেট মস্তিষ্ক, গবেট ইত্যাদি। কিন্তু বেশিদিন না। পরে এই মায়াজাল ছিন্ন করতে সক্ষম হয় সাজ্জাদ। কুঞ্চির কোনো কিছু ছিন্ন করার প্রয়োজন হয়নি। কারণ সে ভালোবাসতো মাহমুদকে। সাজ্জাদ ছিল তার একজন ভালো বন্ধু। কুঞ্চি এক সন্তানের জননী হলেও সাজ্জাদ তাকে আগের মতোই পছন্দ করে।
আড়াইটার দিকে তাদের সবার রামগড়ের দিকে প্রস্তাবিত টুরিস্ট লজের সাইট দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা পাকা হয়ে আছে। কুঞ্চি যেতে না চাইলেও তাকে সম্মত করায় সাজ্জাদ ইমাম। তাদের দুজনের ফোনালাপেও তাদের প্রেমের নস্টালজিয়া উত্থিত হয়-
: তুমি আমার কথা কোনোদিন চিন্তা করছ নাকি!
: অবশ্যই।
: তারপর…
\হকুঞ্চি একটু হেসে বলে : মাহমুদকে বাইছা নিলাম…
: ভালো কর নাই। আমার হৃদয় ভাইঙ্গা দিছ তুমি… (পৃ.২০-২১)
অতঃপর তারা রামগড়ের টুরিস্ট স্পট দেখে ফেরৎ আসে এবং জঙ্গলের কাছ ঘেঁষে একটা ছায়াময় নিরিবিলি জায়গায় শতরঞ্চি বিছিয়ে বসে যায়। গাড়ি থেকে খাবারের প্যাকেট নামানো হয়। এই সুযোগে সাজ্জাদ কুহ্িচর ছেলে নান্নেকে নিয়ে বন ঘুরে দেখায়। নান্নে বনে-জঙ্গলে ঘেরা পাখ-পাখালির কল-কাকলিতে মুখর এই জায়গা দেখে খুবই আনন্দিত হয়। নান্নের আসতে দেরি দেখে মাহমুদ তার অনুসন্ধানে বনের ভেতর প্রবেশ করে। ঠিক সে মুহূর্তে সাজ্জাদ নান্নেকে নিয়ে ফেরৎ আসে। মাহমুদের অনুপস্থিতিতে দুজন দুজনের মনের জানালা খুলে কথা বলে। কুঞ্চি সাজ্জাদকে সংসারী হওয়ার জন্য বিয়ে করতে বলে আর সাজ্জাদ যে এখনও তার জন্য অপেক্ষমাণ সে কথা জানায়। কিন্তু কুঞ্চি যে মাহমুদের স্ত্রী, নান্নের জননী- একথা সে ভুলে যায়। দুজনের মনের আঙ্গিনায় অদৃশ্য ঝড় শুরু হয়। মাহমুদ তাদের কাছে উপস্থিত না থাকলেও সে ঝড় উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এই তিন জন মানব-মানবীর হৃদয়-ঘটিত দ্বন্দ্ব এখানে প্রকটিত হয়েছে। কুঞ্চি ও সাজ্জাদের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসা, মুখে হাত দেয়া মাহমুদকে পীড়িত করে। সে ভাবে- ‘কুঞ্চির সঙ্গে সাজ্জাদের সম্পর্কটা কতদূর গড়িয়েছিল ?… একজন বিবাহিতা মহিলার জন্য এটা বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কি!’ (পৃ.২৮)
টুরিস্ট স্পট দেখে আসার পরের দিন মাহমুদ কলেজে ক্লাস নিলেও মানসিক প্রশান্তিতে ছিল না। সাধারণত ক্লাস শেষে সে লাইব্রেরিতে যায়। সেখানে সে অধ্যয়ন-অনুশীলনে নিমগ্ন হয়। আজও অভ্যাসবশত অমর্ত্য সেনের দুর্ভিক্ষের ওপর রচিত অর্থনীতির বইটির কয়েক পৃষ্ঠা পড়েও ফেলে। কিন্তু পড়াতে তার মন বসে না। সে পাড়ি জমায় নস্টালজিয়ায়। যেখানে কুঞ্চি-সাজ্জাদ ও মাহমুদের আনাগোনা। অপরদিকে কুঞ্চিও সাজ্জাদের সঙ্গে বাইরে ঘুরে লাঞ্চ সেরে আসার বিষয়টি মাহমুদকে জানায়। মাহমুদ হারিয়ে যায় মনঃসমীক্ষণের অন্তর্বাস্তবতায়। তার মনেও ঈর্ষা জেগে ওঠে। তথাপি সে ধৈর্যসহকারে মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সাজ্জাদ কুঞ্চি ও নান্নেকে নিয়ে যায় সমুদ্র সৈকত ঘেঁষে সবে তৈরি হওয়া কক্সবাজারের একমাত্র তারকা হোটেলে। হোটেলের স্বত্বাধিকারী প্রৌঢ়বয়সী যুবক তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জানালার ধারে তারা বসে। একটু দূরেই সমুদ্র। খাবার তৈরি হতে যতটুকু সময় লাগবে, ততটুকু সময় কুঞ্চি ও সাজ্জাদ একান্ত মনের কথা বিনিময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আর নান্নেও কিডস্ পেস্ন-গ্রাউন্ডে খেলায় মেতে ওঠে। তাদের কথোপকথনেও তাদের ভালোবাসার কথা উচ্চারিত হয়। সাজ্জাদ জানায়, তার দুটি ক্যাপিটেল আছে, এক: বাবার টাকা, বাড়ি, সম্পত্তি। দুই : কুঞ্চি বিবির ভালোবাসা। কুঞ্চিও জানায়- ‘তয় একটা ক্যাপিটেল ভাঙানো যাইব। ব্যবহার করা যাইব যেমন খুশি। আর একটা ক্যাপিটেল ভাঙানো যাইব না। মনের ব্যাংকে এফডিআরে হোল লাইফের জন্য জমা রাখতে পারো বড়জোর।’(পৃ.৪৬) কুঞ্চিকে সাজ্জাদ জানায়, সে বিয়ে করতে চায়। একটা ছেলে চায়। বউকে প্রাণভরে ভালোবাসতেও চায়। এসবই তো মানুষ তার জীবৎকালে পেতে চায়। বিয়ে করে সংসারী হতে চাইছে সাজ্জাদ, এটা তো কুঞ্চির কাছে খুশির খবর। তবে সাজ্জাদের আন-রিয়েলিস্টিক মনের কারণে সে আবার শঙ্কিতও হয়। তারপরও ‘মেয়েটি কে’ তা সে জানতে চায়। সাজ্জাদের বাবা ইশতিয়াক আর কুঞ্চির বাবা ইমদাদ খান ধানমন্ডির ১২ নম্বর রোডের প্রতিবেশী, ছাত্রজীবনে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের সহপাঠী; দুজনে ও দুপরিবারের ঘনিষ্ঠতা অনেক। তারা ভেবেছিলেন কুঞ্চি ও সাজ্জাদ বিয়ে করে আনন্দে দিন যাপন করবে। কিন্তু কুঞ্চি তাতে বাঁধসাধে। ফলে সাজ্জাদ সংসারী না হয়ে ব্যবসায়ী হয়ে যায়। এখন সে বিয়ের পিড়িতে বসতে চায়। মেয়েটা তার তিন বছরের ছোট, গুলশানের জাবিন। যে ছাত্রজীবনে ইডেন কলেজে ইনডোর গেমসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কুঞ্চি তার সম্পর্কে বলে- ‘খুব মানাবে জাবিনকে তোমার সঙ্গে। লম্বায় শুধু একটুখানি খাটো আছে। পাঁচ ফিট এক-দেড়ের বেশি হবে না বোধ হয়। আর একটু লম্বা হলে ওকে আমি ফুল নাম্বার দিতাম। বাট আদারওয়াইজ, শি ইজ অ্যান এক্সিলেন্ট চয়েস…’ (পৃ.৪৯)। কথা বলতে বলতে টেবিলে খাবার সার্ভ করা শুরু হয়। চিলড্রেন কর্নার থেকে নান্নেকে আনতে যায় সাজ্জাদ। কুঞ্চি জানালার ধারে বসে নিজের মনের জানালা খুলে দ্যায়। সে একটু উল্টা-পাল্টা ভাবতে শুরু করে। মাঝে মাঝে তার মনে এরূপ ধারণা উদিত হয়। যেমন- মাহমুদকে ত্যাগ করে যদি সে নান্নেকে নিয়ে সাজ্জাদের ওখানে ওঠে, তাহলে কেমন হয়? সাজ্জাদ তাকে এত ভালোবাসে! এ ভালোবাসা তো কুঞ্চি চেয়েছিল। সংসার জীবনে সাজ্জাদকে সে খুব অনুভব করে। সে ভাবে একই নারীর যদি এক সঙ্গে দুজন পুরুষকে বিয়ে করার অথবা বিয়ে না করেও একসঙ্গে থাকার উপায় থাকতো! কুঞ্চি জানে এসব উল্টা-পাল্টা চিন্তার কোনো অর্থ নেই। মানুষের জীবন তো একলার নয়। তার সঙ্গে অন্য মানুষ থাকে, সমাজ থাকে, সমাজের নিয়ম-কানুন থাকে। তার ওপর আছে- ধর্ম, বিবেক, বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক বিবেচনা; এসব কিছুর দায় ও দাবি মিটিয়েই মানুষকে সমাজে চলতে হয়। মনের বদ্ধ দুয়ারের এসব নেতিবাচক চিন্তা আপনাতেই আবার বন্ধ করে দেয় কুঞ্চি। এরপর খেয়েদেয়ে তারা বের হয়। গাড়ি শহর ও শহরতলীতে কিছুক্ষণ ঘুরতে থাকে। নান্নে নানা গাছপালা-পাখি দেখে সময় অতিবাহিত করে, কুঞ্চি সাজ্জাদের নিকটবর্তী হয়, ডান বাহুতে হেলান দেয়া তার মাথা। কুঞ্চির চোখ দুটি বোজা, আর তপ্ত অশ্রম্ন গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে। সাজ্জাদ কুঞ্চির স্পর্শ পেয়ে আশ্চার্যান্বিত হয়, উপলব্ধি করে কুঞ্চির মনোবেদনা।
অপরদিকে আকস্মিকভাবে জয়নালের হারিয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারে না কানিজ রেজা। যাকে নিয়ে সে জীবনের আরেকটা বড় স্বপ্ন দেখেছিল, সে-ই কি না এভাবে জীবন থেকে উধাও হয়ে গেল। নিজের আনুগত্যশীল স্বামীকে তাই সে জয়নালের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত করে। আবিদুর রেজা বাধ্য হয়েই বউয়ের পাতানো ভাইয়ের খোঁজে সময় ব্যয় করে। ইতঃপূর্বে ফেরদৌস নামক আরেক ছোট ভাইয়ের প্রতিও তার দরদের কোনো শেষ ছিল না। ফেরদৌসকে নিয়ে বাপের বাড়ি কুষ্টিয়াতে বেড়িয়ে আসতো সপ্তাহ-কাল। তাকে নিয়ে কিছু বললেও কানিজ ক্ষেপে যেত। কাজেই বউয়ের মান-অভিমান থেকে আত্মরক্ষায় জয়নালের খোঁজে তিনি বিভিন্ন জায়গায় যান। সেদিন বিকালে সাগর-সৈকতে সাক্ষাৎ হয় মাহমুদ নজীরের। মাহমুদ নজীর তাকে একটি সংবাদপত্র ধরিয়ে দিয়ে বলেন, দ্যাখেন কী নিউজ আছে! নিউজে দেখা যায় আবিদুর রেজার পাতানো ছোট ভাই জয়নালের বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ।
খবরের কাগজে লেখা হয়েছে- জয়নাল ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। সে ভারতে মানুষ খুন করে বাংলাদেশে পালিয়েছিল, কিন্তু বাঁচতে পারেনি। কক্সবাজার শহর থেকে বান্দরবনের গভীর অরণ্যে সেদিন সে পাড়ি জমিয়েছিল। কিন্তু তার আততায়ী ওই হোটেলেই দুদিন আগে এসে হাজির হয়। তারপর সে যখন হোটেল থেকে পালিয়ে যায়, তার পিছে পিছে তার আততায়ী দলও রওনা হয় এবং পরদিন ভোরেই তাকে বুলেটবিদ্ধ করে হত্যা করে।
আলোচ্য উপন্যাসে লেখক মানবীয় ভালোমন্দ গুণাবলি এবং এসব গুণ লালনকারী কিছু মানুষের চরিত্র চিত্রণে সফলতা অর্জন করেছেন। নৈতিক বিবেচনায় সব মানুষই ভালো, আবার সব মানুষই মন্দ- এমন বলা যায় না। ভালো গুণাবলির আলোকে গড়ে ওঠে ভালো মানুষের জীবনপ্রণালী, আর খারাব গুণাবলির আলোকে গড়ে ওঠে মন্দ মানুষের জীবনপ্রবাহ। এই জীবন গঠনে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনৈতিক অবস্থা তাকে প্রভাবিত করে। জয়ন্ত মন্দ হওয়ার পশ্চাতে তার সমাজব্যবস্থা অনুঘটক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।