মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মেজর
মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) আর নেই। আজ মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।
সি আর দত্তের ভাগ্নে ও হবিগঞ্জ মোটর মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক শঙ্খ রায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন চিত্ত রঞ্জন দত্ত। তাঁর পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ও মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত।
শিলংয়ের লাবান গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন সি আর দত্ত। পরে তাঁর বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন তিনি। এরপর খুলনার দৌলতপুর কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। পরে এই কলেজ থেকেই বিএসসি পাস করেন।
১৯৫১ সালে চিত্ত রঞ্জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিছুদিন পর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন পান তিনি। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। ওই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে পুরস্কৃত করে।
বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন সি আর দত্ত। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেডকোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। এর পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় ৪ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন সি আর দত্ত।
দায়িত্ব নিয়েই প্রথমে সিলেটের রশিদপুরে ক্যাম্প তৈরি করেন সি আর দত্ত। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চা বাগান থাকার সুবাদে আড়াল থেকে শত্রুদের ঘায়েল করেন দ্রুত সময়ে। পরে তিনি রশিদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজার ক্যাম্প স্থাপন করেন। তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সি আর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়।
ভোরের কাগজকে দেয়া সি আর দত্তের একটি সাক্ষাৎকার:
আমি তখন মেজর। ৯০ দিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জে এলাম। দেশের পরিস্থিতি ভালো নেই। তত দিনে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদের নির্বাচন শেষ হয়েছে। উভয় নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব আসনে জয়ী হয়েছে। তাই আমাদের মনে হচ্ছিল, সহসাই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে আওয়ামী লীগের কাছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে থাকল। আর বাড়তে থাকল দেশে অস্থিরতাও। গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সামরিক জ্ঞানে আমার মনে হচ্ছিল, এখনই রাজনৈতিক সমাধান না হলে সংঘাত অনিবার্য। এর মধ্যে শুরু হয়েছে উত্তাল মার্চ। এদিকে আমার ছুটিও আর বেশিদিন নেই। বুঝতে পারছি না কী করব, মনের মধ্যে নানা শঙ্কা। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকায় শুরু হওয়া পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের খবর পেলাম হবিগঞ্জে বসে, ২৬ মার্চ হবিগঞ্জে বসেই জানতে পারলাম, রাজনৈতিক সমঝোতার পথ ছেড়ে নারকীয় যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছে সামরিক সরকার।
দৈনিক ভোরের কাগজের সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত বলেন, এ সময় কিছু ছাত্র এসে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আমার সাহায্য চাইল। আমি তাদের বললাম, যুদ্ধ সামরিক বাহিনীর কাজ, কিন্তু যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনীতিবিদদের। সেই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ বা নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই ছিলেন বৈধ রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
সি আর দত্ত জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল আবদুর রব তার বাসায় ডাকলেন। তো তার বসার ঘরে গিয়ে আমি দেখলাম, কয়েকজন ছেলে বসে আছে। আমি তখন দাদাকে (রব) বললাম, এদের আপনি কোথায় পেলেন। তখন দাদা বললেন, যেভাবেই হোক পাকিস্তানিদের কাছ থেকে সিলেট শত্রুমুক্ত করতে হবে এবং আমাকে এই অভিযানের নেতৃত্ব দিতে হবে। তার প্রস্তাবে সম্মত হলাম সানন্দেই। এরপর ওই দিন বিকেল ৫টায় আমার বাড়ির সামনে এসে পৌঁছল একটি জিপ এবং পাঁচটি বাস ও ট্রাক, তাতে মুক্তিযোদ্ধারা। ‘স্বাধীনতার ডাক এসেছে, আমাকে এখনই যেতে হবে’। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম আমি। এভাবেই মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে অংশ নেয়ার কথা জানালেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্ত রঞ্জন দত্ত বীর-উত্তম।
ইতিহাসের সেই ভয়ংকর সময় তুলে ধরে সি আর দত্ত জানান, মাত্র ৩০-৩৫ জন সেনা আর সঙ্গে কিছু থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এই ছিল সম্বল। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ দুর্ধর্ষ শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এরপরও পিছপা হইনি, হারাইনি মনোবল। এই মনোবলই রণক্ষেত্রে আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে। যুদ্ধ জয়ের পর এনে দিয়েছে বীর-উত্তম খেতাব। আজ জীবন সায়াহ্নে এসে অনেক কিছুই ভুলে গেছি। কিন্তু ভুলতে পারিনি যুদ্ধ সময়ের কথা, ভুলতে পারিনি সহযোদ্ধাদের কথা, দেশপ্রেমের গৌরবগাঁথা ইতিহাসের কথা।
সাক্ষাৎকারে মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত বলেন, শুরুতে তার সঙ্গে স্বল্পসংখ্যক সেনা আর হালকা অস্ত্র থাকলেও একসময় তা বাড়তে থাকে। শেষমেশ সেনা সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে তিনশ’র মতো। সঙ্গে ভারী অস্ত্রশস্ত্র। তাই নিয়েই সিলেট জয় করেন এই বীরসেনা। তিনি বলেন, সিলেটের যুদ্ধের সময় আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে একজন মেজর হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার ছিল।
তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় যে ছেলেগুলোকে আমি পেয়েছিলাম, তারা আমাকে বলেছিল যে স্যার আমরা যারা আছি তারাই পাকিস্তানিদের ধ্বংস করতে পারব। এই যে একটা শক্তি আমি তাদের কাছ থেকে পেলাম, সেটা দারুণ কাজে লেগেছে। এই শক্তি নিয়েই আমরা এগিয়ে গিয়েছি এবং পাকিস্তানিদের ধ্বংস করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি।
ভারতীয় সেনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতীয় সৈন্য এবং ভারতীয় কমান্ডার যারা ছিলেন, ব্রিগেডিয়ার ওয়াসকে, আমাকে সব দিক থেকে সাহায্য করেছেন। দু’জায়গায় আমার যুদ্ধের সময় ওনারা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে শেলিং করেছেন। পাকিস্তানিদের ধ্বংস করেছেন। ভারতীয়রা আমাকে হাতিয়ার দিয়েও সাহায্য করেছে।
তরুণ প্রজন্মের সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের প্রশংসা করে মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত বলেন, বর্তমান প্রজন্ম অনেক সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করছে। তাই তাদের প্রতি আমার আন্তরিক অভিনন্দন। দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসার আহ্বান জানান তিনি।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করেন তিনি এবং জানালেন, এই দেশের কাছে যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন। অবশ্য তারপরও একটা আশা এখনো রয়ে গেছে। এ বিজয়ী সেনা চান, বাংলাদেশে সবাই মিলেমিশে থাকুক। সবাই মিলেই দেশটাকে আরো সুন্দর করে গড়ে তুলুক।