স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে
প্রবাসী কর্মীদের ওপর নিপীড়নের কথা প্রকাশ করে মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ বন্দরের যুবক রায়হান কবির। মুক্তি পেয়ে শুক্রবার রাতে তিনি দেশে ফিরেছেন। গতকাল রায়হান সাংবাদিকদের বলেন, প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করতে চাই। প্রবাসীরা রেমিটেন্স যোদ্ধা। এই করোনাকালীন সময়েও টানা দুইবার রেমিটেন্সের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে প্রবাসীরা। কিন্তু এই প্রবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা দেখার লোক খুবই কম। তাদের কথাগুলো কেউ শোনে না, তাদের গল্পগুলো বাইরে যায় না। সেই প্রবাসীদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই ছিল।
এটাই আমার জীবনের লক্ষ্য বলতে পারেন। আমি মনে করি, লক্ষ্য ঠিক থাকলে ইউ ক্যান বি ওয়ান ম্যান আর্মি।
শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন শাহী মসজিদ এলাকায় নিজ বাসায় সাংবাদিকদের এ কথা বলেন রায়হান। এরআগে রাত দেড়টায় ঢাকায় এয়ারপোর্টে নামেন তিনি। এ সময় বিমানবন্দরে রায়হান কবিরের স্বজনরা ও ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান তাকে রিসিভ করেন। সেখান থেকে সরাসরি বাড়ি ফেরেন। গত ২৪ জুলাই অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি মালয়েশিয়া সরকারের আচরণ নিয়ে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাকে গ্রেপ্তার করে দেশটির পুলিশ। এরপর টানা ২৭ দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
রায়হান কবির বলেন, ‘মালয়েশিয়াতে স্টুডেন্ট লিডার ছিলাম আমি। সেখানে স্টুডেন্টদের যেসব সংগঠন সেগুলোর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমি। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে বাঙ্গালি কমিউনিটিতে আমি পরিচিত মুখ। যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটে, আমি সেই এলাকাতেই থাকতাম। মূলত রেইড নিয়ে ঘটনাটা। সেজন্য বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে আল জাজিরা আমাকে খুঁজে বের করে ও আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে। আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে রেইডে গ্রেপ্তার হয়েছিল। আমি বিভিন্ন জায়গায় ওর জন্য অনেক তদবির করছিলাম, যেটা সবাই জানে। সেটি আমার উইক পয়েন্ট ছিল।
তিনি আরও বলেন, আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তুমি তোমার ফ্রেন্ডের জন্য বা তোমার কমিউনিটির জন্য লিডার হিসেবে কিছু বলতে চাও কি-না। সেই হিসেবে আমি আমার বিবৃতি দিয়েছি। আল জাজিরা আমাকে বলেছিল, ক্যামেরার সামনে মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে। আমি তো সত্য বলব, তো আমি কেন মাস্ক ব্যবহার করব। আমি মুখ ঢাকতে কোনোকিছু ব্যবহার করিনি। কারণ এটি আমার পার্সোনালিটির বাইরে।
রায়হান বলেন, ‘সেখানকার পুলিশ, ৯টি সংস্থা ও আইজিপি আমার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছেন এবং জানতে পেরেছেন কোনো কিছুর প্ররোচনায় নয়, মূলত আমি প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করি বলেই তাদের স্বার্থে কথা বলেছি। আমি প্রবাসীদের জন্য কাজ করেছি, করছি। প্রবাসীদের জন্য প্রয়োজনে আমি একাই লড়ব।
গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওই সাক্ষাৎকারে এমন কোন কথা বলিনি যা ওই দেশের বিরুদ্ধে যায়। যেটা সত্য সেটাই বলেছি। কিন্তু আমার বক্তব্য নেতিবাচকভাবে ভাইরাল হয়ে গেল। ওই দেশের পাবলিক ডিমান্ডের কারণে পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বারবার জানতে চেয়েছে যে, আমার উপর পলিটিক্যাল কোন প্রভাব আছে কিনা। কখনও কোন বাঙালি এসবের প্রতিবাদ করেনি। আমিই কেন করলাম? এটাই ছিল তাদের জিজ্ঞাসা।
পরিবারের কাছে ফিরে আসার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না বলে মন্তব্য করেন রায়হান কবির। তিনি বলেন, আমি পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি এটাই আমার কাছে অনেক কিছু। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বাংলাদেশের জনগণের এবং মিডিয়া কর্মীদের। যারা আমার পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে লেখালেখি করেছেন। আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
রায়হান কবির ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। পরে মালয়েশিয়া গিয়ে পার্টটাইম চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা করছিল। সেখানে বিএ পাস করার পর গত ঈদুল ফিতরের আগে একটি কোম্পানিতে স্থায়ী চাকরি হয় তার। কিন্তু কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর বিপত্তিতে পড়েন রায়হান কবির।
করোনাকালে মালয়েশিয়া সরকার ‘মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার’ (এমসিও) জারি করে। গত ৩ জুলাই আল-জাজিরায় প্রচারিত লকড আপ ইন মালয়েশিয়াস লকডাউন্থ তথ্যচিত্রে বলা হয়, এ আদেশের ফলে অভিবাসী কর্মীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এতে রায়হান কবিরের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। তিনি অভিবাসীদের ওপর নিপীড়নের তথ্য তুলে ধরেন। তার এ বক্তব্যে মালয় জাতীয়তাবাদীরা ক্ষুব্ধ হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রায়হান বুলিংএর শিকার হন। তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা বলেছেন, রায়হান সাক্ষাৎকারে মিথ্যা বলেননি। অভিবাসীদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছেন। তিনি সত্য বলার মূল্য দিয়েছেন।
গত ৮ জুলাই ওয়ার্ক পারমিট বাতিলের পর ২৬ জুলাই গ্রেপ্তার হন রায়হান কবির। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ছাড়াও মালয়েশিয়ার মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তাকে গ্রেপ্তারের নিন্দা করে মুক্তির দাবি জানায়। ২৫ জুলাই রায়হানকে ১৪ দিনের এবং পরে আবার ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয় মালয় পুলিশ। আল-জাজিরার কার্যালয়েও তল্লাশি চলে। গত বুধবার তার আইনজীবী সুমিথা শান্তিনি কিশনার বরাতে ‘ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে’ জানিয়েছিল, রায়হানের বিরুদ্ধে আদালতে কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি অভিবাসন কর্তৃপক্ষ।
দেশে ফিরলেন রায়হান কবির, বিমানবন্দরে আবেগঘন দৃশ্য
বহুল আলোচিত রায়হান কবিরকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া। গত রাত একটার দিকে তিনি ঢাকায় অবতরণ করেন। এ সময় বিমানবন্দরে এক আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়। সন্তানকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন পিতা শাহ আলম। এ সময় তিনি হাউমাউ করে আবেগাপ্লুত হন বিমানবন্দরে উপস্থিত মানুষ। রায়হান কবির মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন ভাগ্য ফেরানোর আশায়। সম্প্রতি করোনাভাইরাস মহামারিতে সেখানে আটক অবৈধ অভিবাসীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহার নিয়ে আল- জাজিরা টেলিভিশনকে একটি সাক্ষাৎকার দেন তিনি। ওই সাক্ষাৎকারই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ তাকে ধরিয়ে দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। প্রকাশ করে তার ছবি সহ বিস্তারিত তথ্য। তার ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করা হয়। ঘোষণা দেয়া হয় তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। তিনি মালয়েশিয়ায় চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হবেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাত একটার দিকে তাকে বহনকারী মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট এমএইচ-১৯৬ ঢাকায় অবতরণ করে। এ সময় সন্তানকে কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার পিতা শাহ আলম। বিমানবন্দরে তিনি বলেছেন, ছেলেকে কাছে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের ‘ঈদের চাঁদ’ হাতে এসেছে।
অন্যদিকে অনুভূতি ব্যক্ত করে রায়হান কবির বলেছেন, এই আনন্দ প্রকাশ করার মতো নয়। গত ৬ বছরে আমি অনেকবার দেশে এসেছি। আবার গিয়েছি। কিন্তু এবারকার অনুভূতি ভিন্ন। আমার বাংলাদেশ, আমার মাতৃভূমি, আমার মা, আমার পিতামাতা…এই অনুভূতি আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না। আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা দেশে ও বিদেশে যারা আমার পাশে ছিলেন সবার প্রতি।
মালয়েশিয়ায় রায়হান কবিরের পক্ষে আইনি লড়াই করেন সুমিতা সান্তিনি কৃষ্ণা এবং সেলভারাজা চিন্নিয়া। মিডিয়ার প্রশ্নের জবাবে সুমিতা বলেছেন, শুক্রবার বিকালে পুত্রজয়া ইমিগ্রেশন অফিস থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় রায়হানকে। সব প্রক্রিয়া শেখ করার পর তাকে স্থানীয় সময় রাত ১১টায় একটি বিমানে তুলে দেয়া হয়। এ সময় তার করোনাভাইরাস টেস্ট নেগেটিভ ছিল। যেহেতু তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি মালয়েশিয়া পুলিশ, তাই তাকে কোনো আইনগত জটিলতায় পড়তে হয় নি।
রায়হান কবিরের পরিবারের বসবাস নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলায়। স্থানীয়রা বলছেন, তিনি নিজের বই ও অর্থ দিয়ে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতেন। এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।