অনলাইন ডেস্ক : মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও শনিবার (১৫ আগস্ট) ওয়ারসতে পোলিশ সরকারের সাথে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেছেন যার আওতায় জার্মানিতে মার্কিন ঘাঁটি থেকে আপাতত এক হাজার সৈন্য পোল্যান্ডে মোতায়েন করা হবে। ফলে পূর্ব ইউরোপের এই দেশে মার্কিন সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াবে ৫,৫০০। এ নিয়ে রাজনীতির খবরাখবর এবং বিশ্লেষণের জন্য বিশেষায়িত মার্কিন সাময়িকী পলিটিকো সম্প্রতি তাদের এক বিশ্লেষণে লিখেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭৫ বছর পর স্বার্থের দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্র-জার্মান সম্পর্ক শুধু সঙ্কটেই পড়েনি, এই সম্পর্ক এখন “লাইফ সাপোর্টে।”
চুক্তির ফলে, মার্কিন সেনাবাহিনীর পঞ্চম কোরের সদর দপ্তর জার্মানি থেকে সরে পোল্যান্ডে স্থানান্তর করা হবে।
গত মাসের শেষে যখন মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় যে তারা জার্মানি থেকে ১২হাজার সৈন্য সরিয়ে নেবে তখন নেটোর জোটের সদস্য দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
ওই ১২ হাজারের মধ্যে অর্ধেকই নেয়া হবে পোল্যান্ডে। মি ট্রাম্প এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করলে জার্মানিতে মার্কিন সৈন্য সংখ্যা বর্তমানের ৩৬ হাজার থেকে নেমে দাঁড়াবে ২৪ হাজারে।
নেটো জোটের ওপর যেমন তেমনি জার্মানির সাথে সম্পর্কের ওপর এই সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুই দলের অনেক নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকরা আপত্তি তোলেন।
কিন্তু শনিবারের চুক্তি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইঙ্গিত দিলেন তিনি জার্মানির চেয়ে পোল্যান্ডকে বিশ্বস্ত মিত্র মনে করছেন।
পেন্টাগনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে জার্মানি থেকে সৈন্য সরিয়ে পোল্যান্ডে নেওয়ার এই সিদ্ধান্ত কৌশলগত, কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষক এর পেছনে ট্রাম্পের নিজস্ব রাজনীতি দেখছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত যতটা না সামরিক কৌশল তার চেয়ে বেশি রাজনীতি।
২০১৮ সাল থেকে পোল্যান্ডের রাজনীতিকরা আরও সৈন্য মোতায়েন করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ক্রমাগত দেন-দরবার করে চলেছেন। তথাকথিত ‘ফোর্ট ট্রাম্প‘ নামে পরিচিত এই প্রস্তাবে পোল্যান্ড বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যেন সেখানে স্থায়ী একটি ঘাঁটি তৈরি করে পুরো এক ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করে। শনিবারের চুক্তিতে তেমন কোনো প্রতিশ্রুতির কথা না থাকলেও ট্রাম্পের বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন তিনি কী চান।
“তিনি পরিষ্কার করেছেন যে পোল্যান্ডের মত যে দেশ প্রতিরক্ষার জন্য যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত, তেমন একটি দেশকেই তিনি মিত্র হিসাবে বেশি পছন্দ করেন।”
লাভবান হবে রাশিয়া: জার্মান কর্মকর্তারা মার্কিন এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছেন এটি নেটো জোটকে দুর্বল করবে এবং রাশিয়াকে শক্তিশালী করবে।
বাভারিয়া প্রদেশের সরকার প্রধান এবং প্রভাবশালী জার্মান রাজনীতিক মার্কাস সোয়েডার খোলাখুলি বলেছেন সৈন্য সরানোর এই সিদ্ধান্ত “জার্মান-মার্কিন সম্পর্ক নষ্ট করবে।“
নেতৃস্থানীয় অনেক মার্কিন রাজনীতিকও উদ্বিগ্ন। ডেমোক্র্যাট সেনেটর জ্যাক রিড মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ‘মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী কাজ।’
রিপাবলিকান পার্টির সেনেটর মিট রমনি বলেন, ‘মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। এটি বিশ্বস্ত একটি মিত্র দেশের গালে চড় মারার সামিল।’
সাবেক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা লে. জে. বেন হজেস, যিনি ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপে মার্কিন বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন, জার্মান মিডিয়া ডয়েসে ভেলের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এবং এই সিদ্ধান্ত কৌশলগত কোনো বিশ্লেষণের ভিত্তিতে করা হয়নি।
তিনি বলেন, সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র স্বার্থের বিরোধী কারণ এতে ‘আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশের সাথে সম্পর্ক খারাপ করবে যা রাশিয়ার জন্য ভালো হবে।’
ক্রেমলিনকে একটি উপহার দেওয়া হচ্ছে। জার্মানিতে ৩০ শতাংশ সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে দিলে, তা রাশিয়াকে দারুণ সাহায্য করবে।
যুক্তরাষ্ট্র-জার্মানি সম্পর্ক লাইফ সাপোর্টে
প্রেসিপেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব কোনো কথারই তোয়াক্কা করছেন না, এবং জার্মানিকে লক্ষ্য করে এমন সব কথা বলছেন যার নজির বিরল। তিনি মন্তব্য করেছেন, প্রতিরক্ষার জন্য জার্মানি পয়সা খরচ তো করছেই না বরঞ্চ মার্কিন ঘাঁটি থেকে তারা পয়সা বানাচ্ছে। তিনি বলেন, “আমরা সৈন্য সারাচ্ছি কারণ তারা (জার্মানি) খরচ বহন করছে না। খুব সহজ কথা। আমরা আর তাদের খাওয়াতে পারবো না।”
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বলছেন ইউরোপিয়ান সদস্যরা নেটোতে যথেষ্ট পয়সা দিচ্ছে না, প্রতিশ্রুতি মত (জিডিপির ২ শতাংশ) প্রতিরক্ষায় খরচ করছে না। মি ট্রাম্পের এসব মন্তব্য এবং সিদ্ধান্তে জার্মানিতে মার্কিন বিরোধী মনোভাব দিন দিন প্রবল হচ্ছে।
রাজনীতির খবরাখবর এবং বিশ্লেষণের জন্য বিশেষায়িত মার্কিন সাময়িকী পলিটিকো সম্প্রতি তাদের এক বিশ্লেষণে লিখেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭৫ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র-জার্মান সম্পর্ক শুধু সঙ্কটেই পড়েনি, এই সম্পর্ক এখন “লাইফ সাপোর্টে।”
পলিটিকো অতি সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপের ফলাফল উদ্ধৃত করে লিখেছে ৮৫ শতাংশ জার্মান নাগরিক মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক এখন খারাপ বা খুবই খারাপ, এবং সিংহভাগ জার্মান এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব চাইছে।
এদিকে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন জার্মানি থেকে সাড়ে ৯ হাজার মার্কিন সেনা ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর তার প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে ট্রাম্পকে কখনও সেভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে দেখা যায়নি। এমনকি জার্মান নেতা সম্পর্কে কটু কথাও বলতে ছাড়েননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তার এবারের ক্ষোভের কারণ আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও ট্রাম্পের কাছে তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। করোনা সংকট সত্ত্বেও তিনি ওয়াশিংটনে জি-সেভেন শীর্ষ সম্মেলনে সশরীরে নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ম্যার্কেল সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করায় বেজায় চটেছেন ট্রাম্প।
সেই ক্রোধের বশে জার্মানিতে মোতায়েন মার্কিন সেনাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন ট্রাম্প। মৌখিক বক্তব্যের বাইরে সরকারিভাবে অবশ্য এখনও পর্যন্ত এমন কোনও সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়নি। তা সত্ত্বেও জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন।
‘বিল্ড আম সনটাগ’ সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ট্রাম্পের আমলে আটলান্টিকের দুই প্রান্তের মধ্যে সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়লেও নিবিড় সহযোগিতার ফলে আখেরে দুই দেশেরই লাভ হচ্ছে। তার মতে, বেশ কয়েক দশক ধরে এই সম্পর্ক তিলে তিলে গড়ে উঠেছে। শীতল যুদ্ধের সময় থেকে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি মার্কিন সেনা জার্মানিতেই মোতায়েন করা হয়েছে।
জার্মানির সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্কের অবনতির কথাও স্বীকার করেন হাইকো মাস। ম্যার্কেলের দফতরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত সমন্বয়ক পেটার বায়ার বলেন, ট্রাম্প সত্যিই একতরফাভাবে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর এর গভীর প্রভাব পড়বে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, পেন্টাগনকে জার্মানিতে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প।
বর্তমানে জার্মানিতে ৩৪ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৯ হাজার জনকে দেশে ফেরাতে চান ট্রাম্প। ভবিষ্যতে জার্মানিতে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার মার্কিন সেনা রাখতে চান ট্রাম্প। এই সিদ্ধান্ত সত্যি কার্যকর হলে ন্যাটোর ছত্রছায়ায় ইউরোপের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান কমে যাবে।
শেষ পর্যন্ত জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে আখেরে রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের লাভ হবে হবে বলে মনে করছেন অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ। সংবাদমাধ্যমগুলোকে তারা বলেছেন, জার্মানিকে কেন্দ্র করে মার্কিন সেনারা শুধু ন্যাটো দেশগুলোর সুরক্ষাই নিশ্চিত করে না; বরং ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রেও মূল ঘাঁটি হিসেবে জার্মানির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক কারণে ট্রাম্প এমন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিলে তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক সতর্ক করে দিচ্ছেন।