জাহিদ মুস্তাফা
বাংলার আধুনিক চারুশিল্পের শক্তিমান পুরোধা এস এম সুলতান। পূর্ণনাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। বাঙালির গর্ব করার মতো বিরল সুসন্তানদের একজন। ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট তাঁর জন্ম চিত্রা নদীবিধৌত নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে।
১৯৮৩ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে আমি শিল্পী এস এম সুলতানের নড়াইলের বাড়িতে যাই। আমার ভ্রমণসংগী হিসেবে ছিলেন দুই সহপাঠী ভাস্কর মাহবুব জামাল শামিম, হিরন্ময় চন্দ ও অনুজ শিল্পী রউফুর রহিম। প্রথম দু’জন যশোর চারুপীঠের সংগঠক ও সুলতানের ছাত্র। ক্যামেরায় ছবি তোলার দায়িত্ব ছিল শেষোক্ত জনের। কখন যে তাঁর ক্যামেরার ফিল্ম ছিঁড়ে গেছে- সে টেরই পায় নি। ফলে একটা ছবিও আমরা পাই নি!
জ্যৈষ্ঠ মাসের সেই নিদাঘ অপরাহ্নে হাট থেকে কেনা আম নিজ হাতে কেটে পরম যত্নে- তিনি আমাদের খাইয়েছিলেন সেদিন। এই স্মৃতি আমাদের অমূল্য সম্পদ। এখনো শ্রদ্ধায় অবনত হই সেই মহানুভবের স্মরণে। বড় মানুষ হয়েও তাঁর ব্যতিক্রমী ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন আজও আমাদের প্রাণিত করে।
সুলতানে আমার মুগ্ধতা ১৯৭৬ সালে তাঁর পুনরাবির্ভাবের সময় থেকে। লেখক-দার্শনিক আহমদ ছফার প্রচেষ্টায় সেবারই দীর্ঘ ২৩ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা সুলতানের একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। পত্র-পত্রিকার পাতায় পাতায় সুলতানের বিস্তর প্রশস্তি পাঠ করেছি আর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে। ১৯৮১ সালে এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আন্তর্জাতিক সেমিনারে অনর্গল ইংরেজীতে শিল্প নিয়ে অসাধারণ এক বক্তৃতা করেছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কেন তাঁকে যথাযথ সম্মানের সাথে আমন্ত্রণ জানানো হয় নি এ নিয়ে শিল্পীদের বিক্ষোভও হয়েছে।
নড়াইলের সাধারণ মানুষের কাছে তিনি লাল মিয়া নামে পরিচিত ছিলেন। সেই ছেলেবেলায় কাঠমিস্ত্রী বাবার কাঠের নকশা দেখে আঁকাজোকায় তাঁর আগ্রহ জন্মে। কয়লা দিয়ে আঁকতে আঁকতে একসময় নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হলেন। তখন কাগজের উপর পেন্সিলে আঁকাআঁকি করেছেন। নড়াইলের জমিদারদের স্নেহের দৃষ্টি পড়লো লাল মিয়ার উপর। স্কুল শেষে জমিদার বাড়িতেই তাঁর ওঠবস। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৩৮ সালে তাঁর কলকাতা যাত্রা। শিল্পসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেন সুলতান। যেন নিজের জায়গাটা ঠিকঠাক পেয়ে গেলেন তিনি। ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক করণ-কৌশল শেখার সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের সহজাত প্রতিভাকে বিকশিত করায় মনোযোগী হলেন এস এম সুলতান। প্রথম দু’বছর ভালো ফলাফলও করলেন। ওল্ডমাস্টারদের কাজ কপি করতেন। পরবর্তীকালে তাঁর চিত্রকর্মে এর প্রভাব আমরা লক্ষ্য করেছি। তৃতীয় বর্ষে পাঠকালে তাঁর মনে হলো - এখান থেকে যা শেখার তা তাঁর শেখা হয়ে গেছে। ১৯৪৪ সালে বেরিয়ে পড়লেন ভারতবর্ষ পরিভ্রমণে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেই সময়ে সৈনিকদের ছবি এঁকে নিজের ভ্রমণ ও আহার খরচ জুটিয়েছেন। নানা প্রান্ত ঘুরে ১৯৪৬ সালে সিমলায় নিজের আঁকা ছবির একটি প্রদর্শনী করেন। এরপর ১৯৪৮ সালে লাহোরে ও ১৯৪৯ সালে করাচিতে তাঁর চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন হয়।
২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী উদীয়মান বিদেশী মেধাবী শিল্পীদের জন্য যুক্তরাষ্টের একটি ফেলোশিপ প্রোগ্রাম ছিল। ১৯৫০ সালে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক শিক্ষা ইনস্টিটিউট ও পাকিস্তান শিক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথভাবে সুলতানকে সেই ফেলোশিপের জন্য মনোনীত করেন। সে বছরেই তিনি নিউইয়র্কে যান। এ ফেলোশিপের অধীনে ছিল শিল্পকলায় পাঠ, গুণিশিল্পীদের সাথে মতবিনিময়, সৃজনশীল কাজ করাসহ নানা মিউজিয়াম পরিদর্শনের সুযোগ। নিউইয়র্ক ছাড়াও তিনি ওয়াশিংটন ডিসি, বোস্টন যান এবং শিকাগো ও মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং লন্ডনের হ্যাম্পস্টিডে ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্ট বাগানের উন্মুক্ত স্থানে আয়োজিত বার্ষিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। পাবলো পিকাসোসহ সে সময়ের পৃথিবীশ্রেষ্ঠ শিল্পীরা এই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন।
এরপর করাচিতে এসে শিল্পী আবদুর রহমান চুঘতাই ও শাকির আলীর সাহচর্য পান এবং তাঁদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ১৯৫২ সালে শিল্পসমালোচক এস আমজাদ আলী পাকিস্তান কোয়াটার্লিতে লিখেন- সুলতান একজন ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার। তাতে মানুষ আসেন অনুষঙ্গ হয়ে। পরে আমরা দেখি- সুলতানের চিত্রপটে মানুষ প্রধান আর প্রকৃতি এসেছে পরিবেশ সৃজনের লক্ষ্যে।
১৯৫৩ সালে সুলতান ঢাকা হয়ে নড়াইলে ফিরে আসেন। এরপর দীর্ঘ ২৩ বছর তিনি বাউলশিল্পী ও যাত্রাদলের সঙ্গে বোহেমিয় জীবন কাটিয়েছেন। কুকুর-বিড়াল, পাখ-পাখালি, এমনকি সাপ-বেজি নিয়ে একভিটায় বসবাস করেছেন। ১৯৬৯ সালে খুলনা ক্লাবে তাঁর আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে একটি একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন হয় খুলনা তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইনাম আহমেদ চৌধুরীর উদ্যোগে। সেই প্রদর্শনী থেকে সংগ্রহ করা দু’টি চিত্রকর্ম তাঁর কাছে আছে। এগুলোর অংকনরীতি ওল্ড মাস্টারদের কাজের ন্যায়! (তথ্যসূত্রঃ শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী)।
এর ছয়বছর পর ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে তিনি অংশ নেন।
১৯৭৬ সালে এস এম সুলতানের শিল্পীজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একক প্রদর্শনীর আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সমকালীন চারুশিল্পে এবং জাতীয় জীবনে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন নিভৃতচারী এ শিল্পী। সুলতানকে নতুন করে আবিস্কার করার ক্ষেত্রে লেখক দার্শনিক আহমদ ছফার ভূমিকা আমি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে শুধু শিল্পী নয় এক দার্শনিক সুলতানের সন্ধান পাই আমরা। হাজার বছরের খেটে খাওয়া বাংলার কৃষকের ভেঙে পড়া রুগ্ন চেহারার বদলে তাঁর চিত্রপটে পেশিবহুল এ কোন শক্তিমান কৃষক! সুলতান বললেন- যাঁরা শ্রম দেয়, ফসল ফলায় তাঁরা ক্ষয়িষ্ণু ও ভগ্নস্বাস্থ্যের হতে পারেনা। তাঁরা তুমুল শক্তিমান। তাঁদের শ্রমে ঘামেই আমাদের মুখে অন্ন জোটে। নিজের আঁকায় তাঁদের অন্তর্শক্তির প্রকাশ ঘটেছে পেশির বাহুল্যে। এ নিয়ে আমার এক কবিতার কয়েকটি পংক্তি তুলে ধরার ইচ্ছে সংবরণ করা গেলো না।
মাটিতে এ শুধু বীজ রোপা নয় মৃত্তিকা অধিবাস
চেয়ে দেখো দূরদৃষ্টির চোখে সুলতানি ক্যানভাস
সে পটচিত্রে কৃষক-দেবতা প্রবল শক্তিধর!
এভাবেই যেন বেঁচে থাকে কৃষি, কৃষকের গোলাঘর।
(সুলতানি ক্যানভাস/ জাহিদ মুস্তাফা)
সুলতানের শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির শিরনাম-প্রথম বৃক্ষরোপণ (১৯৭৫), চরদখল (১৯৭৬), চাষাবাদ (১৯৮৬) ও মাছধরা (১৯৯১) ইত্যাদি। প্রথম বৃক্ষরোপণের শক্তিমান কৃষক যেন আদম। বৃক্ষরোপণের মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁর কাছে শুভকামনা নিয়ে ছুটে এসেছে দেবীরা। ওল্ডমাস্টারদের কাজের সাথে তুলনীয় অসাধারণ এক চিত্রকর্ম। চরদখল মানুষে মানুষে যুদ্ধ-হানাহানির চিত্রকল্পময় এক অনন্য সৃজন। শিল্পী এটিকে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম হিসেবে তুলে ধরেছেন। চাষাবাদ ও মাছধরায় বাংলার কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়ের শ্রমজীবনের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। সুলতানের চিত্রপটের নারীরাও দীঘল ও পেশিবহুল। কিন্তু কি আশ্চর্য- তাতে নারীদের কমনীয়তা যথাযথভাবে বিদ্যমান! নিজের দেশ মাটি মানুষ প্রকৃতিকে অনেক বড় করে দেখতেন। দেশি উপকরণ ও পিগমেন্ট ব্যবহার করে তিনি রং তৈরি করতেন এবং এ বিষয়ে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে এস এম সুলতান ছিলেন নিতান্ত শান্তিপ্রিয়, শিশুবৎসল অকৃতদার একজন মহান মানুষ। শিশুদের মননশীলতা গড়ে তোলার জন্য চিত্রকলাবিদ্যাচর্চার সপক্ষে সোচ্চার ছিলেন তিনি। শিশুদের নিয়ে নদী ও সমুদ্রভ্রমণের আগ্রহে শিশুস্বর্গ নামে বড় একটি নৌকা তৈরি করেছিলেন তিনি। একবার ভ্রমণের উদ্দেশে যাত্রারম্ভ করেও ফিরে আসতে হয়েছে নৌকার নির্মাণত্রটির জন্য।
আশির দশকের মধ্যভাগে ঢাকার ধানমন্ডিতে জার্মান কালচারাল সেন্টার গ্যেটে ইনস্টিটিউটে তাঁর চিত্রকর্মের একটি বিশেষ ও সফল প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূতের আগ্রহে আহমদ ছফা সাহেবের মধ্যস্থতায় এটি আয়োজিত হয়েছিল ।
বাংলার মেহনতী মানুষের এই গুণি চিত্রকরের মৃত্যু হয়েছে ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর। কিন্তু যে স্বপ্নবীজ তিনি রোপণ করে গিয়েছেন এ দেশের চারুশিল্পাঙ্গনে তা আজ অনেকটাই পল্লবিত।
সুলতানের প্রতিকৃতি অংকনেঃ শিল্পী শাকিলা খান চয়ন।