এমন মনিষীদের কাহিনী বারবার পড়তে ভালো লাগে। অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং সম্মান ।
সাত ভাইবোনের জন্য মা শুধু ভাত রাঁধতেন। কিন্তু ছোট ছেলেটার জন্য করতেন বাড়তি কয়েকটা রুটি। ভোর চারটেয় উঠে পড়তে বসবে ছেলেটা। তখন খিদে পাবে তো। শুধু তা-ই নয়। দিন-আনি-দিন-খাইয়ের সংসারে নামমাত্র পুঁজি থেকে কিনতেন বাড়তি কেরোসিন। কত রাত পর্যন্ত ছেলে পড়াশোনা করবে কে জানে!
লেখাপড়া শিখেই যে এই ছেলে অনেক দূর যাবে, ঠিক জানতেন মা। স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের বাড়ির খুব কাছেই যে বঙ্গোপসাগর, সেই বিশাল সমুদ্রও ছাড়িয়ে যাবে তাঁর ছেলের নাম়ডাক।
মায়ের সেই স্বপ্ন সত্যি করেছিলেন আব্দুল। তবে রাস্তাটা নেহাত সোজা ছিল না।
১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর। তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে এক অতি দরিদ্র মুসলিম পরিবারে
জন্মগ্রহণ করেন আবুল পকির জয়নুলআবদিন আব্দুল কালাম। বাবা জয়নুলআবদিন ছিলেন এক সাধারণ মৎস্যজীবী। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই রোজগারের তাগিদে খবরের
কাগজ বিক্রি করতে হতো আব্দুলকে। স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ার জন্য একটা বৃত্তি পান তিনি। ভর্তি হন তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজে। ১৯৫৪ সালে সেখান থেকেই পদার্থবিদ্যায় স্নাতক। তার পর ফের স্কলারশিপ নিয়ে চেন্নাইয়ে। পড়তে শুরু করেন এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং। তাঁর স্বপ্ন ছিল ভারতীয় বায়ুসেনায় বিমানচালক হবেন। তাঁর ক্লাসের প্রথম আট জনকে বায়ুসেনায় যোগ দেবার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল।
কালাম হয়েছিলেন নবম। সে-যাত্রায় তাই আর যুদ্ধবিমানের চালক হয়ে ওঠা হয়নি কালামের।
বিমানচালক হয়ে ওঠা হল না। তবে নিজের অদম্য চেষ্টায় তিনি হয়ে উঠলেন দেশের ‘মিসাইল ম্যান’। ১৯৯৮ সালে পোখরান বিস্ফোরণ পরীক্ষার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। পড়াশোনার জন্য এক বারই শুধু গিয়েছিলেন বিদেশে, ১৯৬৩-৬৪ সালে
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’য়। যে বঙ্গোপসাগরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতেন মা আসিম্মা, সেই সমুদ্রসৈকতেই
দু’দশক ধরে একের পর এক
ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ করে
গিয়েছেন ছেলে।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে ছিলেন ডিআরডিও, ইসরোয়। মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণায় তাঁর অবদানের জন্য পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ ও ভারতরত্নে সম্মানিত হয়েছিলেন আব্দুল কালাম।
২০০২ সালে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এপিজে। রাষ্ট্রপতি ভবনে ছিলেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। তাঁর সময়ে
রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা সর্বসাধারণ, বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল।
ছেলে-বুড়ো,বিজ্ঞানী-শিক্ষক সকলের
কাছেই তিনি ছিলেন ‘সর্বসাধারণের রাষ্ট্রপতি’।
রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আবার ফিরে যান পড়াশোনার জগতে। শিলং, ইনদওর ও আমদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, তিরুঅনন্তপুরমের ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে নিয়মিত পড়াতেন।
এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মঞ্চেই বক্তৃতা দিতে দিতে তাঁর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া তাই এক আশ্চর্য সমাপতন!
ধর্মের গোঁড়ামি এড়িয়ে চলতেন বাবা-মা।
ছোটবেলা থেকে মুক্তমনা ছিলেন
আব্দুলও। গড়গড় করে মুখস্থ বলতে
পারতেন ভগবদ্গীতা। কোরান শরিফও।
তবে শুধু বইয়েই ডুবে থাকতেন না তিনি। তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, কোথাও যাওয়ার আগেই পকেট
থেকে বার করে ফেলতেন ছোট্ট চিরুনি।
নামাজাদা হেয়ার স্টাইলিস্টের কল্যাণে তৈরি হয়েছিল তাঁর নিজস্ব চুলের ছাঁট। আর সব সময় বলতেন, লেখাপড়ার কোনও বিকল্প হয় না।
স্কুলপড়ুয়াদেরও বারবার অনুপ্রাণিত করে বলেছেন, নিজের ভবিষ্যতের কারিগর হতে গেলে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।
আর কখনও কাজে ফাঁকি দেবে না। নিজের জীবনেও এ কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছেন।
কর্মজীবনে ঠিক দু’দিন
ছুটি নিয়েছিলেন, মায়ের আর বাবার মৃত্যুদিনে।
বলে গিয়েছিলেন, ‘‘আমার মৃত্যুতে ছুটি
ঘোষণা কোরো না। আমায় যদি ভালবাসো,
মন দিয়ে কাজ করো সে দিন।’’
ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আবদুল কালামকে নিয়ে তাঁর সাবেক সচিব অবসরপ্রাপ্ত আইএএস কর্মকর্তা পি এম নায়ারের একটি সাক্ষাৎকার দূরদর্শনের তামিলভাষী আঞ্চলিক চ্যানেল ডিডিপোধিগাই প্রচার করেছিল। এর অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হলো:
১. ড. এ পি জে আবদুল কালাম যখনই বিদেশ যেতেন, তখনই দামি উপঢৌকন নিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। এর কারণ, এটাই রাষ্ট্রাচার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ ও জাতিরাষ্ট্রের কাছ থেকে সফররত বিদেশি রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের এ ধরনের উপঢৌকন নেওয়া একটি বৈশ্বিক প্রথা হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। এই উপঢৌকন প্রত্যাখ্যান করা হলে তা কোনো জাতির প্রতি একটা উপহাস এবং ভারতের জন্য তা বিব্রতকর। সুতরাং, তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে এসব উপঢৌকন নিতেন। কিন্তু তিনি ফিরে আসার পরে তাঁর নির্দেশ থাকত, সব উপহারসামগ্রীর আলোকচিত্র তুলতে হবে। এর ক্যাটালগ করতে হবে। এরপর তা মহাফেজখানায় দিতে হবে। এরপরে তাঁকে আর কখনো উপহারসামগ্রীর দিকে ফিরে তাকাতেও দেখা যায়নি। তিনি যখন রাষ্ট্রপতি ভবন ত্যাগ করেছিলেন, তাঁকে এমনকি একটি পেনসিলও নিয়ে যেতে দেখা যায়নি।
২. ২০০২ সালে ড. আবদুল কালাম যখন রাষ্ট্রপতির পদ নিয়েছিলেন, তখন রমজান মাস। ভারতীয় রাষ্ট্রপতির জন্য এটা একটা নিয়মিত রেওয়াজ যে তিনি একটি ইফতার পার্টির আয়োজন করবেন। একদিন ড. কালাম তাঁর সচিব মি. নায়রাকে বললেন, কেন তিনি একটি পার্টির আয়োজন করবেন? কারণ, এমন পার্টির অতিথিরা সর্বদা ভালো খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। তিনি মি. নায়ারের কাছে জানতে চাইলেন, একটি ইফতার পার্টির আয়োজনে কত খরচ পড়ে? মি. নায়ার তাঁকে জানালেন, প্রায় ২২ লাখ রুপি। ড. কালাম তাঁকে নির্দেশ দিলেন, কতিপয় নির্দিষ্ট এতিমখানায় এই অর্থ, খাদ্য, পোশাক ও কম্বল কিনে দান করতে হবে। রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম এতিমখানা বাছাইয়ের দায়িত্ব পেয়েছিল। ড. কালাম এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করেননি। এতিমখানা বাছাইয়ের পরে ড. কালাম মি. নায়ারকে তাঁর কক্ষে ডাকলেন এবং এক লাখ রুপির একটি চেক দিলেন। তিনি বললেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে কিছু অর্থ দান করছেন। কিন্তু এ তথ্য কারও কাছে প্রকাশ করা যাবে না। মি. নায়ার এতটাই আঘাত পান যে তিনি বললেন, ‘স্যার, আমি এখনই বাইরে যাব এবং সবাইকে বলব। কারণ, মানুষের জানা উচিত, এখানে এমন একজন মানুষ রয়েছেন, যে অর্থ তাঁর খরচ করা উচিত, শুধু সেটাই তিনি দান করেননি, তিনি সেই সঙ্গে নিজের অর্থও বিলিয়েছেন।’ ড. কালাম যদিও একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন; কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকার বছরগুলোতে কোনো ইফতার পার্টি দেননি।
৩. ড. কালাম ‘ইয়েস স্যার’ ধরনের লোক পছন্দ করতেন না। একবার যখন ভারতের প্রধান বিচারপতি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে এলেন এবং কোনো একটি পর্যায়ে ড. কালাম তাঁর সচিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কি আমার এ কথার সঙ্গে একমত?’ মি. নায়ার ভাবলেশহীনভাবে বললেন, ‘না স্যার, আমি আপনার সঙ্গে একমত নই।’ অবাক হয়ে গেলেন প্রধান বিচারপতি। তিনি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একজন সিভিল সার্ভেন্টের পক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দ্বিমত করা এবং এতটা প্রকাশ্যে করা, তা ভাবাও যায়নি। মি. নায়ার প্রধান বিচারপতিকে বলেন, রাষ্ট্রপতি পরে তাঁকে প্রশ্ন করবেন, জানতে চাইবেন, কেন তিনি তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এবং যদি মি. নায়ারের যুক্তি ৯৯ শতাংশ সংগত হয়, তাহলে তিনি তাঁর মন পরিবর্তন করবেন।
৪. ড. কালাম তাঁর আত্মীয়দের একবার দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁরা সবাই রাষ্ট্রপতি ভবনে অবস্থান নিলেন। তাঁদের নগর পরিদর্শন করাতে তিনি একটি বাস ভাড়া করলেন এবং সে অর্থ তিনি পরিশোধ করেন। কোনা সরকারি গাড়ি তাঁর আত্মীয়দের জন্য ব্যবহৃত হয়নি। ড. কালামের নির্দেশনা অনুসারে, তাঁদের থাকা-খাওয়ার খরচ হিসাব করা হলো। বিল দাঁড়াল দুই লাখ রুপি, যা তিনি পরিশোধ করেছেন। ভারতীয় ইতিহাসে এটা আর কেউ করেননি।
এখানেই শেষ নয়, এবার বরং আরও নাটকীয়তার জন্য অপেক্ষা করুন। ড. কালাম একবার চাইলেন তাঁর সঙ্গে তাঁর বড় ভাই পুরো এক সপ্তাহ যাতে সময় কাটান। তা-ই হলো। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরে তাঁর রুমভাড়া বাবদ তিনি অর্থ পরিশোধ করতে চাইলেন। কল্পনা করুন, একটি দেশের রাষ্ট্রপতি এমন একটি কক্ষের জন্য ভাড়া পরিশোধ করতে চাইছেন, যা তাঁর নিজের জন্যই বরাদ্দ। এবারে রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা পূরণ হলো না। কারণ, তাঁর ব্যক্তিগত স্টাফরা ভেবেছিলেন, এতখানি সততা অনুসরণ তাঁদের পক্ষে বিদ্যমান বিধির আওতায় সামাল দেওয়া কঠিন।
৫. মেয়াদ শেষ হয়ে এলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করে বিদায়ী শ্রদ্ধা জানান। মি. নায়ার এভাবেই শ্রদ্ধা জানাতে রাষ্ট্রপতির কাছে একা গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। কারণ, স্ত্রীর পা ভেঙে গিয়েছিল বলে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। ড. কালাম জানতে চাইলেন, তিনি কেন তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসেননি। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ার কারণে তিনি শয্যাশায়ী।
পরের দিন। মি. নায়ার শশব্যস্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকালেন। কারণ, তিনি হঠাৎ দেখলেন, তাঁর ঘরের চারপাশে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী ছেয়ে ফেলেছে। নিরাপত্তারক্ষীরা জানালেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁর ঘরে আসছেন। রাষ্ট্রপতি গৃহে প্রবেশ করলেন। মিসেস নায়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। এবং কিছুক্ষণ খোশগল্পের পরে চলে গেলেন। মি. নায়ার তাঁর ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট একজন সিভিল সার্ভেন্টের ঘরে এভাবে যাবেন না। তাও এমন এক ঠুনকো অজুহাতে।’
এ পি জে আবদুল কালামের ছোট ভাই একটি ছাতা মেরামতের দোকান চালান। মি. নায়ার তাঁর দেখা পেয়েছিলেন আবদুল কালামের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। তখন রাষ্ট্রপতির ভাই মি. নায়ারের কদমবুসি করলেন, যা ছিল তাঁর তরফে মি. নায়ার এবং তাঁর প্রয়াত ভাই ড. আবদুল কালামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।