অধ্যাপক ডাঃ এমএ আজিজ
মহাসচিব
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)।
আগষ্ট মাস শোকের মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বাঙ্গালী জাতির জন্য একটি নিকৃষ্টতম দিন, এক কলঙ্কিত অধ্যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের নজির আছে কিন্তু অন্তস্বত্তা নারী ও শিশুসহ স্বপরিবারে হত্যাকান্ডের নজির কোথাও নেই। এই হত্যাকান্ড বিভিন্নভাবেই আলোচিত। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এর মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করা, আত্মস্বীকৃত খুনীদের পূনর্বাসিত করে পুরস্কৃত করা, অধ্যাদেশ বাতিলের পর বিচারকার্যে বিচারকদের বিব্রত হওয়া ইত্যাদি নানাভাবে আলোচিত এই হত্যাকান্ড। আগষ্ট মাস আসলেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে উঠে। এখনও তারা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের তেড়ে বেড়ায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুপরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা সহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূণ্য করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভয়াবহতম গ্রেণেড হামলা করা হয় এবং সেইদিন আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মীকে নিহত হন এবং শত শত নেতাকর্মীকে আহত হন যারা এখনো দুর্বিষহ জীবন যারন করছে। তাদেরই দোসররা ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট সারাদেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। সেই ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র আজো থেমে নেই।
গত ৫ই আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের ৭১ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আবাহনী ক্রীড়াচক্র মাঠে তাঁর প্রতিকৃতিতে ও বনানী কবরস্থানে তারঁ সমাধীতে পুষ্পস্তবক অর্পন করার পর আমার মনটা বেশ ভাড়াক্রান্ত ছিল। খবরের কাগজে বিভিন্ন লেখা ও প্রবন্ধে চোখ বুলাচ্ছিলাম, ১৫ আগষ্টে প্রথম শহীদ হন শেখ কামাল। মাত্র ২৬ বছর বয়সে একজন তরুন কিভাবে এমন প্রতিভাবান ও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি একজন ক্রীড়াবিধ, ক্রীড়া সংগঠক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র। তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন আবাহনী ক্রীড়া চক্র, স্পন্দন সাংস্কৃতিক জোট, ঢাকা থিয়েটার! সব মিলিয়েই তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তিনি বেঁচে থাকলে আমরা হয়তো আজ অন্য এক বাংলাদেশ দেখতে পেতাম।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের যে ছবিটি আমরা সবসময় দেখে আসছি তা দেখলেই মনের ভিতরে এক অন্যরকম অনুভুতির জন্ম নেয় এবং এই ছবিটি যেন প্রতিটি বাঙ্গালীর আত্মার-আত্মীয় ও আপন পরিবার। প্রতি বছর আগষ্ট মাস আসলেই আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আওয়ামীলীগ ও তার সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ১৫ আগষ্টের প্রেক্ষাপটে শোক-কে শক্তিতে রূপান্তরিত করা, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বিচারের দাবীতে প্রবন্ধ লেখাসহ অনেক আন্দোলন সংগ্রামও দেখেছি গত কয়েক দিন আগে অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী স্যারের একটি লেখা পড়েছি। হত্যাকান্ডের পিছনে যারা জড়িত তাদেরকে জানতে কমিশন গঠনের উপর তিনি জোর দিয়েছেন। আমি আমার লেখায় শুধু হত্যাকান্ডের এই দিক নিয়েই আলোকপাত করতে চাই।
হত্যাকান্ডের সাথে যারা সরাসরি জড়িত ছিল তাদের বিচারের রায় আমরা দেখেছি, কিন্তু তাদের পিছনে মদতদাতা কারা ছিল, তাদের ব্যাপারে জনগণ জানতে চায়, এটি এখন সময়ের দাবী। একটি বিচার বিভাগীয়
কমিশনের মাধ্যমে এই ব্যাপারে বর্তমান সরকারের একটি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তাহলেই পিছনের কুশলীবদের চিহ্নিত করা যাবে। আমরা জানি একটি গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতিবিদরা জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার পরিচালনা করে।জনগণই তাদের মূল শক্তির উৎস এবং জনগণের চাহিদা, আশা-আকাঙ্খা পূরনই হল তাদের মূল লক্ষ্য। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে সিভিল-আমলা, মিলিটারী-আমলা ও অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও গুরুত্ব অনেক বেশী।
রাজনৈতিক দলের আদর্শের দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা কর্ম পরিকল্পনা যদি সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে না পারে, তাহলে সরকার ব্যর্থ হয়। মুক্তি যুদ্ধের সময় অনেক সিভিল কর্মকর্তা যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন আবার অনেকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল পাকিস্তানী আমলা দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন চলবে কিনা? এই সংশয়ই পরবর্তিতে সত্য হয়। বঙ্গবন্ধু মানুষকে সহজেই অনেক পছন্দ করতেন, ভালোবাসতেন এবং ছিলেন উদার প্রকৃতির। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের সময় ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন “আপনার দেশ কেমন চলছে”? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “দেশ ভালো আছে। অনেক ভালো সিএসপি অফিসার আছে”। ফিদেল কাস্ত্রো তখন বলেছিলেন “এত ভালো অফিসার থাকতে পাকিস্তান রক্ষা করতে পারলো না কেন। আমাকে ৩১ বার মারার চেষ্টা করেছে, আমার খাবার খেয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। ভালো অফিসার হলেই হবে না আনুগত্য আছে কিনা তা দেখতে হবে”। মাহবুব আলম চাষী, এম কেরামত আলী, হোসেন আলী সহ তাদের মতো আরো অনেকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন এবং ষড়যন্ত্রের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। মার্কিন সাংবাদিক লরেঞ্জ রিফসো বঙ্গবন্ধুহত্যার ৪ বছর পর ১৯৭৯ সালে গার্ডিয়ানে প্রবন্ধ লিখেছিলেন ঢাকায় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত David Eugene Boster এর উদ্ধৃতি দিয়ে। রিফসো লিখেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের কথা মার্কিন দূতাবাস জানতো। সিআইএ’র ষ্টেশন চীফ ফিলিপ চেরীর সঙ্গে খুনী ফারুক-রশিদের কথোপকথনের ব্যাপারে লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনী ফারককে জিজ্ঞাসা করেছিলো তারা অভ্যূত্থানের আগে কি ভাবেছে, ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? উত্তরে ফারুক বলেছিলো এই বিষয়ে তারা অনেক ভেবেছে তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল। হত্যাকারীরা রাত সাড়ে তিনটায় যখন ট্যাংক নিয়ে রাস্তায় বের হয় তখন মিলিটারী ইন্টিলিজেন্সের কর্মকর্তা কর্ণেল সালাউদ্দিন সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে অবহিত করেন। ঘাতকদল বঙ্গবন্ধুকে ভোর ৬ টায় হত্যা করেন, এই আড়াই ঘন্টার মধ্যে সফিউল্লাহ কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বিগ্রেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন তার বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় বইয়েতে লিখেছেন ১৫ আগষ্ট সকালে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্ণেল সাফায়াত জামিল এর কক্ষে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ডেপুটি জিয়াউর রহমান, সিজিএস খালেদ মোশারফ, ডিজিএফআই এর প্রধান আব্দুর রউফ প্রবেশ করেন। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ এগিয়ে প্রচলিত রীতিনীতি ভেঙ্গে ব্রিগেড কমান্ডার সাফায়াত জামিলের চেয়ারে বসে পরেন। এই সময় ডিজিএফআই এর প্রধান বিগ্রেডিয়ার রউফ বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খালিদের সাথে যোগাযোগ করেন, ফোনটি সেনাপ্রধানের হাতে দিলে তিনি খলিলকে জিজ্ঞেস করেন রেডিওতে তার আনুগত্য প্রকাশের বক্তব্য শুনেছে কিনা? খলিলকে বলেন তুমি এখনই রেডিওতে গিয়ে সরকারের আনুগত্য স্বীকার কর। আমরা সবাই এর সাথে আছি। রক্ষী বাহিনী তখনো সাড়েন্ডার করেনি, কোন ঘোষনাও দেয়নি। রক্ষী বাহিনীর প্রধান কর্ণেল নূরুজ্জামান দেশের বাহিরে ছিলেন। খালেদ মোশারফ রক্ষী বাহিনীর মেজর শরীফকে রেডিওতে গিয়ে আনুগত্য স্বীকার করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশারফ রাজেন্দ্রপুর থেকে ট্যাংকগুলোতে গোলাবারুদ আনার ব্যবস্থা করে। বিগ্রেডিয়ার সাখাওয়াত তার বইয়ে লিখেছেন, “আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমায় কমান্ডার কর্ণেল সাফায়াত জামিল ১৫ আগষ্ট ভোরে সর্ব প্রথম যখন খবরটি পায় তখন উপ-প্রধানের বাড়ীতে গিয়ে জানান, তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিরুত্তাপ অভিব্যক্তিতে রাষ্ট্রপতি নিহত হওয়ার খবর শুনে বলেছিলেন ” “So What! If president is killed vice president is there”। সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার বই “Bangladesh A legacy of Blood` ‘Page-54’” এ লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর খুনী মেজর ফারুক তাকে জানায় ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধা ৭টা ৩০ মিনিটের দিকে মেজর ফারুক জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে জিয়ার সাথে দেখা করে এবং তাকে বলে ‘The Country Required a Change’ জিয়া বলেন ‘yes yes lets go outside and talk’। তখন জিয়া ফারুককে নিয়ে বাইরে যায়।
সেখানে ফারুক পুনরায় বলে, ‘We have to have change, We want your support and leadership’ জিয়া বলেন “if you want to do something you Junior Officers should do it yourself”। বিগ্রেডিয়ার সাখাওয়াত সাহেব এর বইয়ে আরো উল্লেখ করেছিলেন ১৮ আগষ্ট তিনি মেজর ডালিমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন জুনিয়র অফিসারদের মাত্র দুইটি ইউনিট নিয়ে এতবড় একটা ঝুকি নেওয়া কতটুকু যুক্তিসংগত ছিল। তার জবাবে ডালিম হাসতে হাসতে বলল সিনিয়র অফিসাররা সবাই আমাদের সাথে আছে। সুতরাং এর মাধ্যমেই বুঝা যায় সামরিক বাহিনী, সিভিল আমলা এবং কুখ্যাত খুনী মোস্তাক-এর রাজনৈতিক আশ্রয়ে তারা সেই দিন ১৫ আগষ্টের এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।
১৫ আগষ্ট সকালে যখন বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ সিঁড়িতে পড়েছিল এরা কেউ তাকে দেখতে ৩২ নম্বরে যায়নি। বরং তারা ব্যস্ত ছিল রাষ্ট্রপতির আনুগত্য নিয়ে এবং সবাই গিয়েছিল রেডিও ষ্টেশনে। দূঃখ হয় পরবর্তী সময়ে এই সফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, এ কে খন্দকার, খুনী ফারুক, রশিদ, হুদা, ডালিম, আজিজ পাশা, মহিউদ্দিন, নূর, খাইরুজ্জামান ও মোছলেমদের বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে প্রশাসনে ব্যাপক রদ-বদল করেন এবং তার পরিকল্পনা মোতাবেক ১লা সেপ্টেম্বর যদি দায়িতপ্রাপ্ত গভর্ণররা দায়িত্ব গ্রহন করতে পারত তাহলে আমালাদের গুরুত্ব অনেক কমে আসতো। বঙ্গবন্ধুর সেনা বাহিনীকেও দেশের জেলা পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলেন। যা ছিল একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ এবং তা বাস্তবায়িত হলে এদেশ হতো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ কিন্তু বিশ্বাস ঘাতকেরা জাতির পিতার সেই স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে দেয়নি। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হবার আগেই ষড়যন্ত্রের কাছে হেরে যান তিনি। তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়িত হচ্ছে। তারই নেতৃত্বে ‘৭১ এর যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার হয়েছে, ১৫ আগষ্টের খুনীদের বিচার হয়েছে। স্বল্প আয়ের দেশ থেকে আজকে মধ্যম আয়ের দেশ এই বাংলাদেশ। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সালে দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ এবং ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যানের লক্ষ্য বাস্তবায়নের অদম্য লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে একের পর এক স্বপ্ন দেখাচ্ছে এবং সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেমন ৭৫ এর খুনীদের বিচার হয়েছে এবং তারই নেতৃত্বে স্বাধীন বিচার কমিশনের মাধ্যমে এই হত্যাকারীদের পিছনের কুশীলবদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসবে সেই প্রত্যাশায় জাতি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
সংগ্রহ : ডা: হোসাইন আহমদ গোলোন্দাজের ফেসবুক পোস্ট থেকে।