বিয়াল্লিশ বছর আগে পরিবারের বেশীরভাগ সদস্য সহ বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন ঢাকায় তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে। দুই মেয়ে - শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা - তখন বিদেশে, ফলে এই দু’জনই কেবল প্রাণে বাঁচেন। স্ত্রী শেখ হাসিনা ও শ্যালিকা শেখ রেহানা যেভাবে পিতা, মাতা আর ভাইদের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন, তা নিয়ে লিখেছিলেন পরমানু বিজ্ঞানী ড: এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া।
১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট দিনটি ছিল শুক্রবার। ভোর ছয়টার দিকে ওয়াজেদ মিয়ার ঘুম ভাঙ্গে বেলজিয়ামে তখনকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের স্ত্রীর ডাকে - কারণ জার্মানির বন থেকে সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী টেলিফোনে জরুরী কথা বলতে চান।
মি: চৌধুরীর সাথে কথা বলার জন্য ওয়াজেদ মিয়া স্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু দুই-এক মিনিট পর শেখ হাসিনা ফিরে তাঁর স্বামীকে জানান যে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়ার সাথেই কথা বলতে চান।
ওয়াজেদ মিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে তখন ভীষণ চিন্তিত এবং উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছিল।
টেলিফোন ধরার জন্য ওয়াজেদ মিয়া দ্রুত নিচে নামেন। তখন সেখানে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা নিচু করে পায়চারি করছিলেন সানাউল হক।
ফোনের রিসিভার ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বলেন, “আজ ভোরে বাংলাদেশে ক্যু-দে-টা হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। এক্ষুনি আপনারা আমার এখানে বনে চলে আসুন।”
শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত বিজ্ঞানী ড: এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বইয়ে এভাবেই বর্ণনা করেছেন তখনকার ঘটনাপ্রবাহ। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত বইটির শিরোনাম “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ”।
১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে নিয়ে ড: ওয়াজেদ মিয়ার ব্রাসেলস থেকে প্যারিস যাওয়ার কথা ছিল।
টেলিফোনে কথা বলার পর ওয়াজেদ মিয়া যখন বাসার উপরে যান তখন শেখ হাসিনা অশ্রুজড়িত কণ্ঠে ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জানতে চান রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছে।
তখন ওয়াজেদ মিয়া স্ত্রীকে জানান যে রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তাদের প্যারিস যাত্রা বাতিল করে সেদিনই জার্মানির বনে ফিরে যেতে বলেছেন।
শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা - দুজনেই কাঁদতে কাঁদতে বলেন যে নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ আছে যেটি ওয়াজেদ মিয়া তাদেরকে বলতে চাইছেন না।
আর তখন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বলেন যে প্যারিসের যাত্রা বাতিল করার কারণ পরিষ্কারভাবে না বললে তাঁরা সে বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না।
বাধ্য হয়ে ওয়াজেদ মিয়া বলেন যে বাংলাদেশে “কি একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে যার জন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসংগত হবে না। এ কথা শুনে তারা দু’বোন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাদের কান্নায় ছেলে মেয়েদেরও ঘুম ভেঙ্গে যায়।”
সকাল সাড়ে দশটার দিকে তাঁরা ব্রাসেলস ছেড়ে জার্মানীর বনের উদ্দেশ্য রওনা হন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায় গিয়ে পৌঁছান তারা।
সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড: কামাল হোসেন যুগোশ্লাভিয়া সফর শেষে বাংলাদেশে ফেরার পথে ফ্রাঙ্কফুর্টে যাত্রাবিরতি করেন এবং পরে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায় ওঠেন। ড: কামাল হোসেন, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী - এ তিন জন মিলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে ধরাধরি করে বাসার ভেতর নিয়ে যান।
তখন ড্রইং রুমে বসে ড: কামাল হোসেন, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং ওয়াজেদ মিয়া উৎকণ্ঠিত অবস্থায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
এরই এক ফাঁকে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে ওয়াজেদ মিয়া ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান।
নিরাপদ স্থানে না পৌঁছানো পর্যন্ত শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে কোন কিছু জানানো হবে না, এই শর্তে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন, “বিবিসি-এর এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত এক বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ বেঁচে নেই।”
এমন অবস্থায় মি: চৌধুরী - যিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদের স্পিকার হয়েছিলেন - মনে করেছিলেন, একমাত্র ভারতে আশ্রয় নেয়াটা তাদের জন্য নিরাপদ হবে।
১৬ই অগাস্ট ড: কামাল হোসেন লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রার জন্য বন বিমানবন্দরে যান। বিমানবন্দর থেকে বিদায় নেবার সময় ওয়াজেদ মিয়া ড: কামাল হোসেনকে একটি অনুরোধ করেন।
ড: কামাল হোসেনের হাত ধরে ওয়াজেদ মিয়া বলেন, “খন্দকার মোশতাক আহমদ খুব সম্ভবত আপনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখার চেষ্টা করবেন। অনুগ্রহ করে আমার কাছে ওয়াদা করুন যে, আপনি কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে আপোষ করে তাঁর মন্ত্রিপরিষদে যোগদান করবেন না।”
ড: কামাল হোসেন তখন ওয়াজেদ মিয়াকে যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটি ছিল এ রকম, “ড: ওয়াজেদ, প্রয়োজন হলে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আপোষ করে আমি দেশে ফিরতে পারি না।”
১৬ই অগাস্ট রাত ১১টার দিকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং তার স্ত্রী ওয়াজেদ মিয়াকে সাথে নিয়ে বাইরে যান। উদ্দেশ্য ছিল ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া।
নির্ধারিত স্থানে ভারতীয় দূতাবাসের সেই কর্মকর্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সেখান থেকে চলে যান। তখন ভারতীয় দূতাবাসের ঐ কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়াকে রাষ্ট্রদূতের বাসায় নিয়ে যান। তখন জার্মানিতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন একজন মুসলমান সাংবাদিক।
আলোচনার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রদূত ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন যে ভারত সরকারের কাছে তারা ঠিক কী চান, সেটি লিখে দিতে। এ কথা বলে রাষ্ট্রদূত একটি সাদা কাগজ ও কলম এগিয়ে দেন ওয়াজেদ মিয়ার দিকে।
সে কাগজে ওয়াজেদ মিয়া যা লিখেছিলেন সেটি ছিল এ রকম, “শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশু ছেলে জয়, শিশু মেয়ে পুতুল এবং আমার নিজের কেবলমাত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের নিকট কামনা করি রাজনৈতিক আশ্রয়।”
সেই কঠিন সময়ে ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার হাতে কোন টাকা ছিল না। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দু’জনেই ২৫ ডলার সাথে নিয়ে দেশ থেকে এসেছিলেন।
রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাদের কোন টাকা-পয়সা লাগবে কি-না?
শেখ হাসিনার সাথে কথা বলে ওয়াজেদ মিয়া জানান, হাজার খানেক জার্মান মুদ্রা দিলেই তাঁরা মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারবেন।
১৮ই অগাস্ট বন শহর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে কার্লসরুয়ে শহরে যান ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। সেখানে গবেষণা সংক্রান্ত কিছু কাগজ এবং বই ছিল ওয়াজেদ মিয়ার। এছাড়া আরো কিছু কাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজন ছিল।
২৩শে অগাস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়াকে টেলিফোন করে জানান যে ভারতীয় দূতাবাসের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি কার্লসরুয়েতে তাদের সাথে দেখা করবেন।
সেদিন দুপুর দুইটার দিকে ঐ কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়ার সাথে দেখা করে বলেছিলেন, পরের দিন অর্থাৎ ২৪শে অগাস্ট সকাল নয়টায় তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় দূতাবাসের ঐ কর্মকর্তা ২৪শে অগাস্ট তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তবে তাদের গন্তব্যের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।
এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে করে ২৫শে অগাস্ট সকাল সাড়ে আটটার দিকে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান। কিন্তু বিমানবন্দরে নামার পর তাদের প্রায় চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
ভারত সরকারের দুই কর্মকর্তা দুপুরের দিকে তাদেরকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যান নয়াদিল্লির ডিফেন্স কলোনীর একটি বাসায়। ঐ বাসায় ছিল একটি ড্রইং-কাম-ডাইনিং রুম এবং দু’টো শয়নকক্ষ - যার প্রত্যেকটির সাথে একটি করে বাথরুম।
ঐ বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সেখানকার কারো কাছে তাদের পরিচয় না দেয়া এবং দিল্লির কারো সাথে যোগাযোগ না রাখা - ভারতের কর্মকর্তারা তাদের এই তিনটি পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ভারতে তখন জরুরী অবস্থা চলছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোন খবরাখবর ভারতের পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে না। কাজেই তখনকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলেন ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।
এভাবেই তাদের কেটে যায় প্রায় দু’সপ্তাহ।
ইতোমধ্যে ভারত সরকারের একজন যুগ্ম-সচিব শেখ হাসিনা এবং ওয়াজেদ মিয়াকে জানান যে তাদের একটি বিশেষ বাসায় নেয়া হবে গুরুত্বপূর্ণ এক সাক্ষাৎকারের জন্য।
সেদিন রাত আটটায় ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় পৌঁছান।
প্রায় দশ মিনিট পরে ইন্দিরা গান্ধী কক্ষে প্রবেশ করে শেখ হাসিনার পাশে বসেন। এরপর ইন্দিরা গান্ধী ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জানতে চান, ১৫ই অগাস্টের ঘটনা সম্পর্কে তারা পুরোপুরি অবগত রয়েছেন কি-না।
জবাবে ওয়াজেদ মিয়া রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ পরিবেশিত এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত দুটো ভাষ্যের কথা উল্লেখ করেন।
তখন ইন্দিরা গান্ধী সেখানে উপস্থিত এক কর্মকর্তাকে ১৫ই অগাস্টের ঘটনা সম্পর্কে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য জানাতে বলেন।
তখন ঐ কর্মকর্তা ইন্দিরা গান্ধীকে জানান যে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের কেউ-ই বেঁচে নেই।
এই সংবাদ শুনে শেখ হাসিনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ইন্দিরা গান্ধী তখন শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন।
শেখ হাসিনাকে সান্ত্বনা দেবার সময় ইন্দিরা গান্ধী যে কথাগুলো বলেছিলেন সেটি ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বইয়ে বর্ণনা করেছেন এভাবে: “তুমি যা হারিয়েছো, তা আর কোনভাবেই পূরণ করা যাবে না। তোমার একটি শিশু ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তোমার ছেলেকেই তোমার আব্বা এবং মেয়েকে তোমার মা হিসেবে ভাবতে হবে।”
“এ ছাড়াও তোমার ছোট বোন ও তোমার স্বামী রয়েছে তোমার সঙ্গে। এখন তোমার ছেলে-মেয়ে ও বোনকে মানুষ করার ভার তোমাকেই নিতে হবে। অতএব, এখন তোমার কোন অবস্থাতেই ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।”
ঐ মেয়াদে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে এটাই ছিল শেখ হাসিনা এবং ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর একমাত্র সাক্ষাত।