রাজনীতিতে এক অধ্যায়ের অবসান। প্রয়াত হলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র। বুধবার গভীর রাতে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। বয়স হয়েছিল ৭৮।
দীর্ঘদিন ধরেই হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন সোমেনবাবু। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় সম্প্রতি তাঁর ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি ধরা পড়ে। সেজন্য গত ২১ জুলাই তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার ওই হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছিল। কিডনির সমস্যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছিল। তবে তাঁর করোনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসেছিল। ডায়ালিসিসের পর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল। পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা। পেসমেকারের বিষয়েও ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছিল। কিন্তু তারইমধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গতরাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
হাসপাতাল সূত্রে খবর, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাত দেড়টা নাগাদ সোমেনবাবুর মৃত্যু হয়েছে। ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘তিনি ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) এবং অন্যান্য বয়সজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন।’
ষাট এবং সত্তরের দশকে প্রভাবশালী এবং আগুনে রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর উত্থান। ছাত্র রাজনীতির হাত ধরে ষাটের দশকের শেষভাগে যোগ দিয়েছিলেন কংগ্রেসে। ১৯৭২ সালে শিয়ালদহ বিধানসভা আসন থেকে জয়ী হয়েছিলেন। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই আসন থেকে সাতবার জিতেছিলেন। গনি খান চৌধুরীর শিষ্য হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
রাজনীতির ‘ছোড়দা’ সোমেনবাবু তিনবারের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হয়েছিলেন। প্রথম দফায় ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল, দ্বিতীয় দফায় ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রদেশ কংগ্রেসের শীর্ষপদে ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ফের তাঁকে রাজ্যে কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
যদিও তারমধ্যে একাধিক ঘটনার সাক্ষী থাকে রাজনৈতিক মহল। ঘোর দুর্দিনেও কংগ্রেসে থাকা সোমেনবাবু ২০০৮ সালে দল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তৈরি করেছিলেন নিজের দল ‘প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস’। পরে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সেই দল মিশিয়ে দিয়েছিলেন এবং ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূলে গিয়েছিলেন। ঘাসফুল টিকিটে দাঁড়িয়ে ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র থেকে জয়লাভও করেছিলেন। হারিয়েছিলেন সিপিআইএম সাংসদ শমীক লাহিড়িকে। কিন্তু ২০১৪ সালে তৃণমূল ছেড়ে আবারও নিজের ঘরে ফিরে এসেছিলে। তারপর থেকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কংগ্রেসেই ছিলেন। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট তৈরির অন্যতম স্থপতিকার ছিলেন তিনি। সেই মাপের এক নেতার মৃত্যুতে রাজনৈতিক মহলের শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
দলের বিভাজন রোধ করতে ব্যর্থ হওয়া এক নেতা
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস প্রদেশ কংগ্রেস প্রধান সোমেন মিত্রকে মনে রাখবে দলের বিভাজন রোধ করতে ব্যর্থ হওয়া এক নেতা হিসেবে। নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের সঙ্গে কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচনে লড়াইয়ের পরেই দল ছাড়েন তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম নেয় তৃণমূল কংগ্রেস।
এ ভাবেই মহাশক্তিধর বাম দুর্গে ফাটল ধরানোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ব্যাটন কংগ্রেসের হাত থেকে চলে আসে মমতার নেতৃত্বাধীন নবীন ঘাসফুল শিবিরের হাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার বুকে ক্রমে গুরুত্ব হারাতে থাকে শতাব্দীপ্রাচীন কংগ্রেস। নির্বাচনে বিপর্যয়ের দায় নিয়ে, ১৯৯৮ সালে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান সোমেন মিত্রও।
পরে মমতার ডাকে সাড়া দিয়ে তৃণমূলে যোগ দিলেও সে অভিযান বিশেষ সুখকর হয়নি কোনও পক্ষের কাছেই। প্রায় দুই দশক পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ফের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদে ফেরেন। আমৃত্যু সেই দায়িত্বেই ছিলেন ছোড়দা।
১৯৪১ সােলর ৩১ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলায় জন্ম সোমেন মিত্রর। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ষাটের দশকের অস্থির পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। ১৯৬৭ সালে ছাত্রনেতা হিসেবে অভিষেকের পরে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর বাগ্মীতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে দ্রুত জনপ্রিয় বিরোধী মুখ হয়ে ওঠেন তিনি।
তাঁকে বরকত গনিখান চৌধুরীর শিষ্য বলা হত। আমহার্স্ট স্ট্রিটের ‘ছোড়দা’ নামেই অবশ্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন। ক্লাব আর পুজো। এই দুটোই ছিল সোমেনবাবুর সংগঠন তৈরির মূলমন্ত্র।
কংগ্রেস রাজনীতিতে তথা বাংলার রাজনীতিতে পাঁচ দশকব্যাপী সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সাদা জামা আর সাদা চপ্পলে উজ্জ্বল উপস্থিতির এই কংগ্রেস নেতার অবদান কখনই ভোলার নয়। একদা সহযোদ্ধা প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি বিদায় নিয়েছেন আগেই। এবার তাঁরই অনুগামী হলেন বাংলার ছোড়দা।