অনলাইন ডেস্ক: সৃষ্টির বৈচিত্র্যে, বহুমাত্রিকতায়, স্বকীয় প্রকাশভঙ্গির অনবদ্যতায় ট্রেভর স্টার্ন এলিয়ট সন্দেহাতীতভাবেই অনন্য। কবিতায়,গদ্যে, অদ্যাবধি প্রজন্ম ও কালকে তিনি শাসন করে চলেছেন প্রবল প্রতাপে।
“Crowd flow(ing) over London Bridge
Up the hill and down King William Street
To where St. Mary Woolnoth Keep (s)
The Hours”
কিংবা, এবংবিধ আরো অজস্র পঙতিতে লন্ডন জীবন্ত যেন ,
“Beside a public bar in lower Tames Street
The pleasant whining of a mandoline
and a clatter and a clatter from with in
where fishermen lounge at noon
where the walls of magnus martyrs hold
inexplicable splendour of Ionian white and gold”
-দ্য ওয়েষ্ট ল্যান্ড/ টি এস এলিয়ট।
নগর লন্ডনের সুবেশী নর-নারী, অফিসপাড়ার নিত্য ব্যস্ততা, ট্রাফিক-জট, ছাত্র-চাকুরে-ব্যবসায়ী-ভবগুরের ব্যতিব্যস্ত রাস্তা পারাপার, সেন্ট মেরী উলনথ ক্লকের ঘন্টাধ্বনী, জ্যামাইকান ওয়াইন হাউজের আড্ডা, তাঁর ক্লারেন্স গার্ডেন্সের ফ্ল্যাট হতে রাসেল স্ট্রিটের অফিসের হাঁটা পথের চিত্রভাষ্য, হাইড পার্ক, টেমস নদীর ধার, গ্রীনউইচ, হাইব্যুরি, রিচমন্ড, কিউয়্যি কিংবা ম্যুরগেটের কথা, গোটা নগরের টুকরো টুকরো অসংখ্য দৃশ্যকল্প ছড়িয়ে আছে তাঁর কবিতায়, গদ্যে, লেখায়।
কবি, গদ্যকার, সাহিত্য সমালোচক, সম্পাদক, প্রকাশক নোবেলজয়ী টি এস এলিয়টের জীবনে ও সাহিত্যে নগর লন্ডনের প্রভাব আলোচনা করতে গিয়ে অারেক সাহিত্য সমালোচক জন ব্যাটজিমান এলিয়টকে “এ পোয়েট অব লন্ডন” অভিধা দিয়েছিলেন। নগর লন্ডন যেমন কবি এলিয়টকে দিয়েছে যশ-খ্যাতি-বিত্ত, তেমনি আমৃত্যু এ শহর স্বাক্ষী ছিল তাঁর নি:সঙ্গতা, বেদনার্ততা, একাকীত্ব ও বহুমাত্রিক মনোদৈহিক যন্ত্রনা এবং নিয়ত অমোঘ অন্তর্দহনের। এ যেন এক আশ্চর্য শহর ও একজন মানুষের যাপিত জীবনের নিত্য-পুরাণ !
আমেরিকার মিসৌরির সেন্ট লুইসে জন্মেছিলেন টি এস এলিয়ট। মার্ক টোয়েনের জন্মস্থান থেকে অনতিদুরে। সেন্ট লুইসে, এলিয়ট বেড়ে ওঠেন একজন “সাউথ ওয়েস্টার্নার” পরিচয়ে, তাঁর পূর্বপুরুষদের কেউ একজন ইংল্যান্ড-এর সমারসেট থেকে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে।
সময়কাল ১৯৫৩। সাহিত্যে নোবেল এসে গেছে এলিয়টের ঝুড়িতে। এবং এলিয়ট, বলা চলে, ততদিনে, পুরোদস্তুর এক ব্রিটিশ নাগরিক, ইংরেজী ভাষা ও বিশ্ব সাহিত্যের প্রবাদতুল্য একজন “অথরিটি”-প্রায়; ২৫ বছরের তরতাজা যুব-বয়সে যিনি তাঁর “পারসোনাল ল্যান্ডস্কেপ”-এর বর্ননায় সেন্ট লুইস বিষয়ে লিখেছিলেন, “হোয়ার দ্য মিসিসিপি ওয়াজ দ্য মোষ্ট পাওয়ারফুল ফিচার অব নেচার”‘-এখানেই, মিসিসিপি নদীর ধারে, কেটেছে এলিয়টের দুরন্ত কৈশর, স্কুলবেলা আর গ্রীস্ম-অবকাশের স্মৃতিময় দিনগুলি।
জন্মসূত্রে আমেরিকান এলিয়টকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, নিজেকে তিনি মার্কিন না ব্রিটিশ লেখক পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? এলিয়টের উত্তর ছিল, দ্বিতীয়টি। এলিয়টের, স্বদেশ আমেরিকা ছেড়ে সুদৃর ইংল্যান্ডে অবস্হান, একপ্রকার “ব্যক্তিক নির্বাসন”, কবিতায় একটি “ভৌগলিক সাংষ্কৃতিক ভূমি”-র নিরন্তর অনুসন্ধান-এসব কিছুর নেপথ্যে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর সুপ্ত “আইডেনটিটি”ও ! অতএব, এলিয়টের জীবন ও সৃষ্টিকে সম্যক জানা-বোঝার জন্য তাঁর যাপিত জীবনে ইংল্যান্ড, বিশেষত নগর লন্ডনের প্রভাব উপলব্ধিও, সমভাবেই অত্যাবশ্যক।
হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রে গ্র্যাজুয়েশন শেষে ১৯১৪ সালের আগষ্টে ইংল্যান্ড আসেন এলিয়ট। লক্ষ্য, অক্সফোর্ডে উচতর পাঠ। লন্ডনে তাঁর আস্তানা ছিল ২৮, বেডফোর্ড প্লেস। প্রবাস জীবনের প্রারম্বিক প্রতিক্রিয়ায় কবি জানাচ্ছেন, “হোম সিকনেস”-এ আক্রান্ত তিনি! এক সহজাত স্বদেশ-কাতরতা! এ সময়, লন্ডনে, কবি এজরা পাউন্ডের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্টতা, পাউন্ডের সুবাদে এলিয়টের ” দ্য লাষ্ট সং অব জে আল্ফ্রেড প্রূফর্ক” সমকালীন প্রখ্যাত কবিতাপত্র ” পোয়েট্রি”-র জুন ১৯১৫ সংখ্যায় প্রকাশ এলিয়টের জীবনের মোড় বদলে দেয়। পাউন্ডের সুবাদে লন্ডনের কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবি মহলে ক্রমশ ঘনিষ্টতা বাড়তে থাকে এলিয়টের। এমনই সদ্য পরিচিতদের একজন ছিলেন সমকালীন ব্রিটিশ সাহিত্যপত্র “ব্লাস্ট”-এর সম্পদক উইস্টন লিউয়িস। তিনি, এলিয়টের লেখা “প্রিলিউডস”, এবং “রেপসোডি অন এ উইন্ডি নাইট” ব্লাস্ট-পত্রিকায় ছাপেন। পাউন্ড ও লিউয়িস এলিয়টের কাব্য-শক্তির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন যা ইংল্যান্ডে কবির ক্রম-পরিচিতি ও সামাজিক পরিসর বৃদ্ধিতে, স্বীয়-বলয় বিনির্মানে যতেষ্ট সহায়ক হয়।
স্মতর্ব্য, এলিয়ট, বাবা-মা ও পরিবারের ইচ্ছায়, লন্ডনে এসেছিলেন মূলত দর্শনে উচ্চতর অধ্যয়নের নিমিত্তে। সাহিত্য-প্রীতি ও শিল্প-বোদ্ধাদের সংশ্রবে এলিয়টের একাডেমিক পড়াশোনা তথন লাঠে ওঠার দশা।
এসময় ভিভিয়ান হেইউড নামের এক ইংরেজ তরুনীর সাথে এলিয়টের পরিচয় ও প্রণয় ঘটে। সতের বছরের এক দীর্ঘ ও অসুখী, কষ্টকর দাম্পত্য জীবন শেষে ১৯৩২-এ বিয়ে-বিচ্ছেদ হয় দুজনের।
অসমাপ্ত পাঠ, আকষ্মিক প্রণয়, বিচ্ছেদ এক প্রবল হতাশা ও যন্ত্রনাক্লিষ্টতার আবেশ তৈরী করে এলিয়টের মননে। এলিয়ট বাকিংহামশায়ারে এক স্কুলে শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হন। পরে, ১৯১৭-য় লন্ডনের কর্নহিল স্ট্রিটের “লইয়িডস্” অফিসে কিছুকাল সাধারণ করনিকের চাকুরীও করতে হয় এলিয়টকে, জীবিকার প্রয়োজনে, অপারগতা সত্ত্বেও।
একসময় এলিয়ট অধিকতর পাঠ-নিবিষ্ট হন, নিজেকে চিন্তা ও লেখায় ব্যস্ত রাখেন ক্রমাগত। কিছুকাল পরেই, এলিয়ট রাসেল স্ট্রিটে অবস্হিত প্রখ্যাত ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্হা “ফেবার এন্ড ফেবার”-এ যোগ দেন। আমৃত্যু এ প্রতিষ্টানটির সাথে পরিচালক হিসেবে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল।
যৌবনে বাবা মা ও পরিবারের আকাঙ্খানুযায়ী পড়াশুনা শেষ না করা, সফল ক্যারিয়ার না গড়া, অল্প-বয়সে অকষ্মাৎ প্রেম-পরিণয়-বিচ্ছেদ এবং যূদ্ধোত্তর ইউরোপে ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের নানা টানাপোড়েনে অহর্নিশি ক্ষত-বিক্ষত এলিয়টের মৃত্যুও ঘটে এ শহরে, লন্ডনে, জন্মভিটা আমেরিকা থেকে যোজন মাইল দুরে, যেখানে তিনি নিজের পরিচয় দিতেন “এক আবাসিক ভিনদেশী” - বলে।
মৃত্যু এলিয়টকে আপাত লন্ডন-বিচ্ছিন্ন করলেও তাঁর সাহিত্য করেছে চির-সংলগ্ন!