অবশেষে রণেভঙ্গ দিয়ে শান্তিপূর্ণ পথে সীমান্ত সমস্যা মেটানোর পথে এককদম বাড়াল চিন। গলওয়ানের বিতর্কিত অংশ থেকে শুধু সেনা নয়, সাঁজায়া গাড়িও সরিয়ে নিল লাল ফৌজ। ভারতীয় ভূখণ্ডে চিনের অস্থায়ী অবৈধ পরিকাঠামোগুলিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।
হাইলাইটস
চিনা সেনা আগেই এক কিলোমিটার পিছিয়ে ছিল
সোমবার রাতে চিন সরালো সাঁজোয়া গাড়ি
গলওয়ানের ১৪ পেট্রোলিং পয়েন্টে চিন ভেঙেছে তাদের অবৈধ নির্মাণ
১৪ পয়েন্ট সম্পূর্ণ খালি, খালি করা হচ্ছে
১৫ পয়েন্টও
১৭ পেট্রোলিং পয়েন্ট থেকেও লাল ফৌজ কমানো হয়েছে
সূত্রের খবর, আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে লাল ফৌজ আরও পিছবে। ২০২০-র এপ্রিলের অবস্থানে ফিরে যাবে দুই দেশ
অনলাইন ডেস্ক: তৃতীয় তথা শেষ সামরিক বৈঠকেই পূর্ব লাদাখে ভারত-চিন দু-দেশই তাদের পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। কিন্তু, লাল ফৌজ কবে সরবে, তা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা ছিলই। এমত অবস্থায় রবিবার ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে চিনের বিদেশমন্ত্রীর বৈঠকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছবিটা দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে। সোমবার সকালেই লাল ফৌজ অন্তত এক কিলোমিটার পিছিয়ে গিয়েছিল। এদিন রাতে আক্ষরিক অর্থেই পিছু হটে চিন।
গলওয়ান সংঘাতের পর থেকেই আন্তর্জাতিক বিশ্বে ক্রামাগত কোণঠাসা হচ্ছিল চিন। আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, এমনকী ন্যাটো জোট চিনকে সতর্ক করে। আমেরিকা তো রণতরিও পাঠিয়ে দিয়েছে। ইউরোপ থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নিয়ে আসছে এশিয়ায়। সেইসঙ্গে ভারতীয় সেনা যুদ্ধ তত্পরতা। ক্রমাগত এই যুগপত্ চাপের মুখে পড়ে, শেষ পর্যন্ত সুর নরম করতে বাধ্য হয় বেজিং।
পূর্ব লাদাখের গলওয়ান উপত্যকা থেকে সোমবার রাতে আক্ষরিক অর্থেই পিছু হটেছে চিন। সূত্রের খবর, এদিন সকালেই লাল ফৌজ ভারতীয় ভূখণ্ড ছেড়ে প্রতিশ্রুতি মতো এক কিলোমিটার পিছিয়ে যায়। সোমবার রাতে গলওয়ান উপত্যকার পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪ থেকে চিন যাবতীয় অবৈধ পরিকাঠামো সরিয়ে নিয়েছে। এমনকী লাল ফৌজের সাঁজোয়ো গাড়িও সেখান থেকে সরানো হয়েছে বলে খবর।
শুধু ১৪ পয়েন্ট নয়, পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৫ ও ১৭ও খালি করতে শুরু করেছে চিনাসেনা। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, গলওয়ান উপত্যকার বিতর্কতি অংশ থেকে সরে যাওয়ার জন্য রবিবারই লাল ফৌজের কাছে বেজিংয়ের বার্তা আসে। দোভালের সঙ্গে চিনের বিদেশি মন্ত্রীর বৈঠকের পরেই লাল ফৌজের কাছে নির্দেশ আসে। সেই মতো চিনের সেনা সরানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ট
সোমবার সকাল থেকে পুরোদমে পিছিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে চিন। গলওয়ানের পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪ জোর করে দখল করেছিল চিন। এমনকী সেখানে পরিকাঠামো বানানো কাজও শুরু হয়ে গিয়েছিল।
সোমবার রাতের খবর, গলওয়ানের ১৪ নম্বর পেট্রোলিং পয়েন্ট সম্পূর্ণ ভাবে খালি করেছে চিন। গত কয়েক দিন ধরে যে অস্থায়ী পরিকাঠামো সেখানে গড়ে তোলা হয়েছিল, তা লাল ফৌজ নিজেরা ভেঙে ফেলেছে। এমনকী নির্মাণকাজের জন্য আনা বুলডোজারগুলিও সেখান থেকে সরানো হয়েছে। সরানো হচ্ছে মোতায়েন করা যাবতীয় যুদ্ধযানও।
১৫ জুন রাতে এই ১৪ পেট্রোলিং পয়েন্টেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল ভারত-চিন। ভারতীয় ভূখণ্ডে চিনের অবৈধ নির্মাণে বাধা দিলে, লাল ফৌজ অতর্কিতে হামলা চালায়। যার জেরে শহিদ হন ২০ ভারতীয় জওয়ান। ভারতীয় সেনার পালটা প্রতিরোধে একাধিক চিনা সেনাও ১৫ জুনের ওই রাতে নিহত হয়।
১৯৭৫ সালের পর গলওয়ানেই প্রথম চিন ও ভারতের মধ্যে প্রাণহানি হওয়ার মতো এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১৯৬২ সালে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে দু-দেশের মধ্যে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়।
তার পর থেকেই ভারত-চিন সীমান্তে উত্তেজনা চরমে ওঠে। চিন ভিতরে ভিতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলে, ভারতও সেনা মোতায়েন বাড়িয়ে দেয়। চিনের হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না করে, তিন বাহিনীর সবমিলিয়ে ৮০ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয় পূর্ব লাদাখে। চিনের যে কোনও ধরনের উস্কানির জবাব দিতে ভারতীয় বায়ুসেনা পূ্র্ণশক্তিতে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। সুখোই, মিগ ২৯, অ্যাপাচে অ্যাটাক হেলিকপ্টার, চিনুক এয়ারবেসগুলি থেকে ওঠানামা শুরু করে দেয়। ২৪ ঘণ্টা লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় আকাশপথে নজরদারি শুরু হয়।
এই যুদ্ধ আবহের মধ্যেই সামরিক পর্যায়ে তৃতীয় বৈঠকে গলওয়ানের বিতর্কিত অংশ থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেইমতো আগে সেনা সরানো হয়। তার পর ধীরে ধীরে, পরিকাঠামো সরিয়ে, শেষে সাঁজোয়া গাড়িও সরিয়েছে চিন।
সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, সোমবার সকালই পূর্ব লাদাখের গলওয়ান উপত্যকার যেখানে সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছিলেন, সেখান থেকে চিন এবং ভারত নিজেদের সেনাদের প্রায় এক কিলোমিটারের মতো সরিয়ে নেয়। এর পর সে জায়গাকে বানানো হয়েছে বাফার জোন (নিরাপদ অঞ্চল)।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লাদাখ সফরের তিন দিন পর গলওয়ান উপত্যকা থেকে সেনা সরাল চিন। পিছিয়ে ভারতও। মাঝখানে একটা বাফার জোন তৈরি করা হয়েছে। এই ‘বাফার জোন’ আদতে কতটা কার্যকর হবে, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
সূত্রের খবর, লাদাখের সীমান্ত সমস্যা শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা করার বিষয়ে সর্বশেষ সামরিক বৈঠকেই সহমত হয়েছিল দু-দেশ। ভারত ও চিনের মধ্যে কম্যান্ডার পর্যায়ের বৈঠকের পর সেই প্রক্রিয়াই শুরু হয়। সূত্রের খবর, শুধু ১৪ পয়েন্ট নয়, প্রতিশ্রুতি মতো পূর্ব লাদাখের ৩টি জায়গা থেকে সেনা সরাবে চিন।
এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, পূর্ব লাদাখের গলওয়ান উপত্যকা, পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৫ ও হটস্প্রিং এলাকায় ২ থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে সরে গিয়েছে চিনা সেনা।
জানা গিয়েছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় তৈরি হওয়া সমস্যা নিয়ে আরও একদফা বৈঠক হবে দু-দেশের মধ্যে। গলওান এলাকার ১৪, ১৫ নম্বর পেট্রোলিং পয়েন্ট ও হটস্প্রিং এলাকায় আগামী সপ্তাহেই ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রবিবার কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং জানিয়েছিলেন, ভারত চায় কয়েক দশক পুরনো সীমান্ত সমস্যা যত দ্রুত সম্ভব মিটিয়ে ফেলতে। তার আগে দু-পক্ষের মধ্য শান্তির প্রয়োজন। সেনা বৈঠক ও ওই বিবৃতির পরই এই পদক্ষেপ নিল দু-দেশ।
ভারতীয় সেনা সূত্রে খবর, শুধু ১৪ পেট্রোলিং পয়েন্ট নয়, ১৫ পেট্রোলিং পয়েন্ট থেকেও ২০টি তাঁবু সরিয়েছে চিন। ১০০ থেকে ২০০ ট্রুপ সেনাও ১৫ পেট্রোলিং পয়েন্ট থেকে পিছু হটেছে। পদাতিক যুদ্ধের গাড়ি এবং আর্টিলারি বন্দুকও ১৫ পয়েন্টে নেই। চিন ১৫ পয়েন্টও পুরোপুরি খালি করবে।
পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৭ পুরোপুরি খালি না-করলেও, সেখান থেকে সেনা সমাবেশ কমিয়েছে চিন। সেখানে থাকা চিনের বুলডোজার ও তাঁবুও সরানো হয়েছে।
রবিবার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ( Ajit Doval )-এর সঙ্গে চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াই ই-র ফোনে কথা হয়। তার পর ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক থেকে ঘোষণা করা হয়, দু-পক্ষই যত দ্রুত সম্ভব পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে সম্মত হয়েছে।
সূত্রের খবর, আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে চিন আরও পিছু হটবে। ২০২০ সালের এপ্রিলের অবস্থানে ফিরে যাবে।