নওরীণ সুলতানা
প্রকৃতি, পরিবেশ আর মানুষের কথা চিন্তা না করলে তার বিপর্যয় কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো এই করোনাভাইরাস মহামারি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আমরা ক্রমশই মুনাফার পিছনে ছুটেছি। মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি পরিবেশের কোন ক্ষতি হচ্ছে কিনা, সেদিকটা বেশিরভাগ সময়ই লাভ-ক্ষতির ব্যালেন্স শিটে জায়গা পেত না।
দু:খজনক হলেও সত্যি এখন পর্যন্ত মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় বিপর্যয়গুলের অন্যতম হয়েছে বাংলাদেশে। দু’হাজার তের সালের রানা প্লাজার দুর্ঘটনা তারই উদাহরণ।
পৃথিবী জুড়ে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে তাই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসছে পরিবেশ ও মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার বিশ্বাস থেকে। তারা উপলব্ধি করছে এর প্রয়োজনীয়তা। এই দায়বদ্ধতার কথা এতো দিন লেখা ছিল শুধু কাগজে কলমেই।
বাঁ দিক থেকে, আবদুল্লাহ আল খালেদ, রুমী আলী, তানজিনা মির্জা।, মাসরুর রিয়াজ এবং ইকবাল হোসেইন।
ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা
কী উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবসাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেটিই প্রথম প্রশ্ন বলে মনে করেন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক-এর সাবেক ডেপুটি গভর্নর রুমী আলী। তিনি বলেন, একটি ব্যবসা কীভাবে সাজানো হবে, কীভাবে চাহিদা ও যোগানের মিশ্রণ ঘটিয়ে ইকো-সিস্টেমে ঘাটতি পূরণ করা হবে, তার উপরই নির্ভর করে অনেক কিছু।
”মুনাফা অর্জনই যদি একমাত্র লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে স্বাভাবিকভাবেই তা অন্যকিছু দেখে না। তবে এই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাও মনে রাখা সম্ভব,” তিনি বলেন।
”বর্তমান এই মহামারি মোকাবিলার পরিস্থিতিতে মুক্তবাজার অর্থনীতির দুর্বলতাগুলো প্রকট হয়ে আমাদের সামনে চলে এসেছে। প্রকৃতি নিজেই এখন নিজেকে শুদ্ধ করছে। করোনা আমাদের চোখের সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার চিত্রগুলোকে,” মি. আলী বলেন।
ভার্চুয়াল দোকান: লাইভ স্ট্রিমিং-এর মাধ্যমে মডেল পোশাক প্রদর্শন করছেন।
বাংলাদেশ এই সচেতনতা বা উদ্যোগ গ্রহণে এখনো অনেক পিছিয়ে। তিনি বলেন বিশ্বায়নের যুগে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই পশ্চিমা বিশ্বকে অনুসরণ করে, ঠিক তেমনি করছে বাংলাদেশও।
” এই অনুসরণের গতি হয়ত আগে ধীর ছিল, তবে এখন তা অনেক বেগ পেয়েছে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে এখন সচেতন হয়েছে। তারা মুনাফার পাশাপাশি পরিবেশ বা মানুষের জন্যও বেশ কিছু করার কথা চিন্তা করে,” তিনি বলেন।
ব্যবসায় সাসটেইনিবিলিটির গুরুত্ব
কিন্তু এই কঠিন সময়ে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকার পরিবেশ বা উন্নয়ন বিষয়ে সরে আসার অনেক লক্ষণই দেখা গিয়েছে। প্যারিস অ্যাকর্ডে সই না করা, বর্তমান সময়ে জাতিসংঘের তহবিলে দান থেকে সরে আসার ইচ্ছা পোষণ তারই লক্ষণ।
কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব যাকে অর্থনীতিতে অনুসরণ করা হয়, সেখানে ব্যবসায় সাসটেইনিবিলিটি বা ধারণক্ষমতা কতখানি গুরুত্ব পেতে দেখেছেন জানতে চাওয়া হলে ব্যাংক অব মন্ট্রিয়লের ট্রেজারি এবং পেমেন্ট সলিউশনের পরিচালক আবদুল্লাহ আল খালেদ বলেন, “ব্যবসায় ধারণক্ষমতা বিশেষ করে পরিবেশ ও সামাজিক বিষয়ে, আসলে অনেক ক্ষেত্রেই বাণিজ্যিকিকরণের একটি উপায় মাত্র।”
মহামারী চলে গেলে সে সময়ের শিক্ষা কি ব্যবসায়ীরা মনে রাখবে?
”বাংলাদেশে এই বিষয়ে আদতে কিছু করা হয় না বললেই চলে। তবে পশ্চিমা বিশ্বে যদি বলা হয়ে থাকে, তবে ষাট সত্তরভাগ ঠিকই করা হয়ে থাকে, অন্তত চক্ষুলজ্জার জন্য হলেও। এমনকি অনেক সময় ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও পরিবেশের সুরক্ষা শর্ত প্রযোজ্য হয়ে থাকে।
”বাংলাদেশে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক সময় অনেক কিছুই দেখা হয় না। বরং যেকোনো অনিয়ম ঘটানো সম্ভব,” তিনি বলেন।
আবদুল্লাহ আল খালেদ মনে করেন মানুষ দুর্যোগের সময় সত্যকে উপলব্ধি করলেও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে তা ভুলে যায়। তাই এই মহামারি চলে গেলেও এর শিক্ষা ব্যবসায়ীরা কতটা মনে রাখবে, সে বিষয়ে তিনি সন্দিহান।
”এমনকি এই দুর্যোগে পশ্চিমা বিশ্বে যেভাবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো, বা ব্যবসায়ীদের সাহায্য নিয়ে সমাজের পাশে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাও দেখা যায় নি। আর পার্থক্যটি এখানেই,” তিনি বলেন।
পশ্চিমা ক্রেতাদের চাপে ব্যবসায় পরিবর্তন আসতে পারে।
সাসটেইনিবিলিটি অনেকটাই ব্যবসার ধরনের উপর নির্ভর করে বলে মনে করেন প্রাইসওয়াটারহাউজ কুপার কানাডার সিনিয়র ম্যানেজার ইকবাল হোসেইন। আর এ কারণেই তিনি মনে করেন করোনা মহামারির আগের চিত্র আর পরের চিত্র হবে অনেকটাই ভিন্ন। কারণ প্রয়োজনটাও হবে ভিন্ন।
সাসটেইনিবিলিটির বিষয়ে আপোষ নেই
“পশ্চিমা বিশ্বে সরকারের নীতির কারণে সাসটেইনিবিলিটির বিষয়ে আপোষ করা যায় না বললেই চলে। এখানে সবকিছু নিয়ম মেনেই চলতে হয়। সেটা পরিবেশ, সামাজিক বা অর্থনৈতিক যে বিষয়েই হোক না কেন,” তিনি বলেন।
কানাডায় যেমন ওয়ার্ক সেইফটি বোর্ড রয়েছে, এর সঙ্গে জড়িত মানুষদের সুযোগ সুবিধা দেখার জন্য। এটি বাংলাদেশে নেই।
”বাংলাদেশে তখনি এই বিষয়গুলোতে জোর দেয়া হয়েছে যখন পশ্চিমা বিশ্বে ক্রেতারা চাপ দিয়েছে। তবে এই মহামারির পর ব্যবসার চিত্র অনেকটা বদলে যাবে ধারণা করা যায়।
শত কোটি ডলারের ব্যবসা হয়েও গার্মেন্টস শিল্প সাসটেইনিবিলিটি অর্জন করতে পারে নি?
”উন্নত দেশগুলো হয়ত তাদের দেশে অথবা নিকটবর্তী দেশে অনেকটাই উৎপাদনকে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সাসটেইনিবিলিটির আগে অবশ্যই এই মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা প্রথমে করবে,” মি. হোসেইন বলেন।
রানা প্লাজার পাশাপাশি তাজরিন গার্মেন্টসের ঘটনাও কিন্তু কম বড় নয়। তবে সমস্যা হলো এই সকল গার্মেন্টসগুলো ক্রেতাদের প্রথম পর্যায়ের গ্রাহক নয়। তাই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ বা কর্মীদের বিষয়ে কখনোই কিছু ভাবা হয়না।
প্রণোদনা আদায়ই মূল লক্ষ্য
চল্লিশ বছরের পুরনো একটি খাত যা কিনা দেশকে তৈরি পোশাকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি দেশ হিসেবে পরিচিত করেছে, যার বার্ষিক আয় ৩৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার, এই লকডাউনের শুরুতে পাঁচদিন যেতে না যেতেই তার মালিক গোষ্ঠীর প্রধানকে সামাজিক মাধ্যমে এসে ক্রেতাদের কাছে পাওনা টাকা চাইতে দেখা যায়।
তার দাবি সম্পূর্ণ যৌক্তিক হলেও এটি প্রশ্ন তোলে যে, তাদের ব্যবসা সাসটেইনিবিলিটিতে এত বছর তাহলে কী অবদান রেখেছে। তারা এমন একটি সময় তাদের দাবির কথা তুলেছে, যখন তাদের প্রধান ক্রেতা ইউরোপ মহামারির ভয়াবহতার শিকার।
বলাই বাহুল্য সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা আদায়ই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল। কিন্ত তার শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষদের জন্য তারা কতটা করেছে, এই কঠিন সময়ে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
ঢাকার হাজারীবাগে এক শ্রমিক শুকনো চামড়া ট্যানারিতে নিয়ে যাচ্ছে।
তবে বাংলাদেশে পশ্চিমা ক্রেতাদের সাসটেইনিবিলিটির ক্ষেত্রে শর্ত পূরণে একটি ইতিবাচক বিষয় উল্লেখ করেন বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি এক্সচেঞ্জ-এর চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, পশ্চিমা বিশ্বের ক্রেতারা যখনি যা করতে বলেছে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প তা অনুসরণ করেছে।
”প্রথম স্তরের পোশাক কারখানাগুলো প্রথমে ওয়ার্ক প্লেস স্ট্যান্ডার্ড ও পরবর্তীতে ওয়ার্ক প্লেস সেফটি নিশ্চিত করেছে। এমনকি ইউ এস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল প্রদত্ত লিড সার্টিফিকেশন প্ল্যাটিনাম ক্যাটেগরিতে বাংলাদেশেরই একটি প্রতিষ্ঠান প্রথম স্থান অর্জন করে,”তিনি বলেন।
ইপিজেড গুলো অনেক এগিয়ে
তিনি আরো মনে করেন, বাংলাদেশ এখনো এই বিষয়ে অনেক নবীন। তাই নিয়মনীতি প্রয়োগের মাধম্যেই এখনো এর বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড) গুলো এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে রয়েছে। তাদের আইন ও নীতি অনুযায়ী সাসটেইনিবিলিটি মেনে চলার মানদণ্ড অনেক উঁচুতে।
”তবে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি চামড়া ও চামড়া জাত শিল্পকেও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা জরুরি। এটি শুধু দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাতই নয়, এই খাতে পরিবেশের ঝুঁকি অনেক বেশি,” তিনি বলেন।
বাংলাদেশে অনেক শিল্পে শ্রমিকরা এখনো ঝুঁকির মুখেই কাজ করেন।
পশ্চিমা ক্রেতারা সচেতন
সাসটেইনিবিলিটি চর্চার ক্ষেত্রে কিছুটা পেছনে ফিরে দেখতে সাহায্য করলেন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এনজিও প্ল্যান কানাডার মধ্যবর্তী সময়ের সহ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানজিনা মির্জা। তিনি বলেন, ব্যবসায় ধারণক্ষমতা বিষয়ে সচেতনতা শুরু হয় ইউরোপে।
”নর্থ আমেরিকায় এর চর্চা তুলনামূলক ভাবে নতুন। আর বাংলাদেশ তো দেশ হিসেবেই এখনো নতুন। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ক্রেতা গোষ্ঠীর চাপেই তার শুরু।
”পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিষ্ঠানগুলোই শুধু এর প্রয়োগ করে আসছে তা নয়, সাধারণ ক্রেতারাও এই বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা যেকোনো কিছু ক্রয়ের ক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠান পরিবেশ, প্রকৃতি বা মানুষের সামগ্রিক মঙ্গলের কথা চিন্তা করে, তা সেটিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে,” মিজ মির্জা বলেন।
এর পেছনের কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন কিছুদিন আগ পর্যন্তও এই ক্রেতা গোষ্ঠী মূলত ছিল বেবি বুমার্স (১৯৫০ এবং ৬০-এর দশকে যাদের জন্ম)। তাদের আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে মিলেনিয়ালদের (১৯৮০ এবং ৯০-এর দশকে যাদের জন্ম) সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ধারাটি বদলেছে। সেই সঙ্গে পশ্চিমা দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও এ বিষয়ে সচেতন।
যেখানে অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্ব জুড়ে দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে, সেখানে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সাসটেইনিবিলিটি রক্ষার্থে নিকট ভবিষ্যতে উন্নয়নে কতটা অংশ নিবে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এই মহামারি আসলে আমাদের সামনে একটি বড় সুযোগ এনে দিয়েছে পৃথিবীকে সুন্দর করার, পরিচ্ছন্ন ভাবে। এই দুর্যোগ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে - আমরা এককভাবে কেউ-ই নিরাপদ নই যদি না সবাই নিরাপদ হই।”
আর সেকারণেই হয়ত মাসরুর রিয়াজ মনে করেন, “করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আরো বেশি মানবিক হবে। এগিয়ে আসবে মানুষের আরো কাছাকাছি।”
খুব খারাপ সময়ের হয়ত এটিই একটি ভালো দিক!