সুমিত গাঙ্গুলি
দেড় সপ্তাহ চীনের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে এখনও ঝুজছে ভারত। ১৯৭৫ সালের পর এই প্রথম সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে বিবাদে সৈন্য নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলো। এখন ভারতের জন্য সমীচীন হবে একধাপ পিছিয়ে গিয়ে নিজেদের সামগ্রিক আঞ্চলিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা। এরপর নয়াদিল্লি বুঝবে যে তাদের সমস্যা শুধু বেইজিং-এ সীমাবদ্ধ নয়। নিজেদের সকল প্রতিবেশীর সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক এখন করুণ দশায় রয়েছে।
অথচ এই পরিস্থিতির একেবারে উল্টোটা হওয়ার কথা ছিল, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী ৭ দেশ অর্থাৎ সার্কের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানান। এই ধরণের আমন্ত্রণ ভারতের পূর্বের কোনো প্রধানমন্ত্রীই দেননি। ফলে কূটনীতিতে দারুণ চাল ছিল এটি। পাশাপাশি, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নির্বাচনী অঙ্গীকারের সঙ্গেও এটি সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।
দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ক্ষমতায় গেলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা হবে।
একই অনুষ্ঠানে মোদি তার ‘আগে প্রতিবেশী’ নীতি ঘোষণা দিলেন। বলা হলো, সার্ক সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যদি এই উদ্যোগ সফল হতো, তাহলে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে অতিপ্রয়োজনীয় গুরুত্বারোপ বাস্তবে রূপ নিতো। যা একইসঙ্গে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা নিরসনেও সহায়ক হতো। এছাড়া এই উদ্যোগের ফলে এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে একটি স্বাভাবিক কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী দেওয়ালও খাড়া হয়ে যেত।
মোদির প্রাথমিক তৎপরতাতে ওই নতুন নীতির প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন ছিল। যেমন, ২০১৪ সালের জুনে মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বিদেশ সফরের জন্য বেছে নেন হিমালয়ান দেশ ভুটানকে। আসামের বিদ্রোহীদের আশ্রয় বন্ধে ভারতকে দীর্ঘদিন সহায়তা দিয়ে আসছে ভুটান। সেই ভূমিকার প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ছিল মোদির ওই সফর। কিন্তু আঞ্চলিক সম্পর্ক সংহত করার পথে এত দারুণ শুরুর পরও, নয়াদিল্লির সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক এরপর ক্রমান্বয়েই খারাপ হতে থাকে। এতটাই খারাপ যে ২০১৯ সালে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধে জড়িয়ে যেত। দুই দেশের মধ্যে ঘন ঘন বড় আকারে সীমান্ত সংঘাত ঘটেছে, যেগুলো যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত।
আরেক দেশ বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্ক এখন দোদুল্যমান। নেপালের পার্লামেন্ট কয়েকদিন আগে নতুন মানচিত্র অনুমোদন দিয়েছে যেখানে এমন ভূখণ্ড অন্তর্ভুক্ত আছে যাতে দাবি আছে ভারতেরও। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে দুই দেশের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়েছে। শ্রিলংকা ও মালদ্বীপ ঐতিহাসিকভাবেই ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। কিন্তু দুই দেশই ক্রমেই চীনা প্রভাববলয়ের মধ্যে ঢুকছে। অপরদিকে আফগানিস্তানে সংকটে পড়েছে গণতন্ত্র। তালিবানের ক্ষমতা ও প্রভাব দুইই বেড়েছে। এর ফলে দেশটিতে কয়েক দশক ধরে ভারত যেই বিনিয়োগ আর কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে, তার জন্য বিরাট হুমকি তৈরি হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারতের সাথে যেই দেশটির সম্পর্ক এখনও উল্লেখজনকভাবে মধুর, সেটি হলো ভুটান। তবে এই হৃদ্যতা মূলত চীনের সঙ্গে ভুটানের সীমান্ত বিরোধ থাকায়।
প্রশ্ন হলো ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো যেই নতুন নীতিকে সাদরে স্বাগত জানিয়েছিল, সেই নীতিরই কেন আজ এত দুর্দশা। মোদি তার প্রথম মেয়াদে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময়, মনোযোগ ও শক্তি আঞ্চলিক পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত ইস্যুতে দিয়েছিলেন। অনেক দেশে তিনি সফর করেছেন। দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত হৃদ্যতার সম্পর্কও গড়ে তুলেছিলেন।
পাকিস্তানের কথা বাদ দিলে, অন্য প্রতিবেশীদের বেলায় সম্পর্কের এই অবনতির মূল কারণ হলো মোদি সরকারের কয়েকটি ব্যর্থতা। খুব গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি, যা আঞ্চলিক আস্থায় ফাটল ধরিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নেপাল ২০১৫ সালের এপ্রিলে ভয়াবহ ভূমিকম্পে পর্যদস্তু হয়ে পড়ে। তখন ভারত খুব দ্রুত সময়ে ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছিল। যা দুই দেশের সম্পর্ক উষ্ণ করতে ভূমিকা রাখে। তবে এই উষ্ণতা বেশিদিন থাকেনি। একই বছর নেপাল যখন নয়া সংবিধান সংশোধন করতে যাই, কাঠমান্ডু তখন স্থানীয়ভাবে কিছুটা বিরোধীতার সম্মুখীন হয়। মাধেসিস নামে একটি জনগোষ্ঠী থাকে নেপাল-ভারত সীমান্ত অঞ্চলে। তারা মনে করে যে নতুন সংবিধানে তাদের স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষা হয়নি। এই যুক্তির কিছুটা যৌক্তিকতাও ছিল। মাধেসিদের কেউ কেউ উত্তরাঞ্চলীয় ভারতেও বসবাস করে। আর তাদের প্রতি সমর্থন দিতে গিয়ে, তাদের ভোট পাওয়ার আশায়, মোদি সরকার স্থলবেষ্টিত নেপালে অনানুষ্ঠানিকভাবে অবরোধ আরোপ করে। নেপালের অর্থনীতির জন্য ওই অবরোধের প্রভাব ছিল মারাত্মক। যেমন, চালের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ৫ গুণ বেড়ে যায়। ফলে দুর্যোগে সহায়তার হাত বাড়িয়ে যেই সুনাম অর্জন করেছিল ভারত, তা মুহূর্তেই মিইয়ে যায়। অপরদিকে, এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে ভুল করেনি চীন। ভারত যখন আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিল, চীন তখন ভারতের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে নেপালকে বিভিন্ন প্রস্তাব দিল।
অন্যান্য ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীদের প্রতি মোদির অবস্থান তার প্রথম দিককার সাফল্যকে ভূলুণ্ঠিত করে দেয়। যেমন, ২০১৫ সালে নয়াদিল্লি বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি সম্পন্ন করে। ফলে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান (যা এখন বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠার সময় থেকে জিইয়ে থাকা এক জটিল ইস্যুর সমাধান হয়। এরপরও ইতিবাচক প্রভাব বেশিদিন থাকেনি। ২০১৯ সালে মোদি সরকার জাতীয় নাগরিকপঞ্জির কাজ শুরু করে। উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় আসাম অঙ্গরাজ্যে এই বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু হয় বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য। সরকার এই প্রকল্পে উৎসাহী ছিল কারণ ২০১৯ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসনকে মূল ইস্যু বানিয়েছিল বিজেপি। সত্য কথা বলতে, ভারতের জন্য অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি যৌক্তিক উদ্বেগের বিষয়, তবে মোদি সরকার একে ব্যবহার করেছে মূলত রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে। ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয় আর আতঙ্ক জাগিয়ে তুলতে।
বাংলাদেশ বেশ কড়াভাবেই জাতীয় নাগরিকপঞ্জির প্রতিবাদ জানিয়েছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, এরপর থেকে দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি তখন চাঙ্গা, কেবল বিস্তৃত হচ্ছিল। ফলে ভারত সত্যিকার অর্থেই সুযোগ হারিয়েছে। এরপর করোনাভাইরাস আসার পর চীন বাংলাদেশের জন্য জরুরী মেডিকেল সামগ্রি নিয়ে এগিয়ে এসেছে।
শ্রিলংকায়ও ব্যাপক প্রভাব খুইয়েছে ভারত। মোদি সরকার ব্যপকভাবে সমর্থন দিয়েছিল মাইথ্রিপালা সিরিসেনা সরকারকে। তবে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসে তার বিরোধী গোতাবায়া রাজাপাকসে। ফলে নয়াদিল্লি বিপাকে পড়ে যায়। রাজাপাকসে ভাইদের (আরেক ভাই সাবেক প্রেসিডেন্ট) সঙ্গে বেইজিং-এর ইতিমধ্যেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ফের ভারত সুযোগ হারায়। দেশটি শ্রিলংকায় অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ নিতে পারতো।
এরপর চিরশত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে অবনতি হয়েছে। দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ এমনিতেই। মোদির দায় এখানে কিছুটা কম। পাকিস্তানের প্রতি ২০১৪ সালে মোদি হাত বাড়িয়ে দিলেও জবাবে তেমন প্রত্যুত্তর মিলেনি। বরং, ভারতে দু’টি বড় সন্ত্রাসী হামলার উৎস পাকিস্তানে বলে অনেকে মনে করেন। দ্বিতীয়ত, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত উত্তেজনা এতটাই বেড়ে যায় যে ভারতের বিমান ১৯৭১ সালের পর প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। উত্তেজনা পরে ঠান্ডা হলেও ভারত ২০১৯ সালের আগস্টে বিবদমান জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে। এতে করে দুই দেশের সম্পর্কে নাটকীয় অবনতি ঘটে। পাকিস্তান রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়। ইসলামাবাদ থেকে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কও বাতিল করে। অপরদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বৈশ্বিক মঞ্চে, জাতিসংঘে ও পশ্চিমা পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ লিখে ভারতের সমালোচনা করেন। যদিও পাকিস্তানের ওই পদক্ষেপে তারা সাফল্য খুব বেশি পায়নি, তবে দুই দেশের সম্পর্ক এখনও আগের মতোই আছে। আর ফের চীন সেটার সুবিধা নিয়েছে। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের অংশ হিসেবে বেইজিং পাকিস্তানে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। নতুন সড়ক, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গাদারে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান করছে।
মোদির ‘প্রথমে প্রতিবেশী’ নীতির ৬ বছর পর, অগ্রগতি খুব কমই। বরং বেশিরভাগ প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতি হয়েছে। ফলে নয়াদিল্লি বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য সুযোগ হারিয়েছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো যেত, অভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যা যেমন পরিবেশহানি, খাদ্য ও পানি নিরাপত্তার মতো ইস্যুতে আঞ্চলিক দেশগুলো এক হতে পারতো। প্রত্যেক অগ্রগতি একত্রিতভাবে চীনের প্রবেশকেও ঠেকাতে পারতো। এ নিয়ে প্রশ্ন নেই যে মোদির প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী ছিল। পূর্বের সরকারগুলোর ব্যর্থ নীতি থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষণ ছিল সেখানে। তবে এই প্রতিশ্রুতি আর উদ্যোগ ধরে রাখতে না পারায় ভারত এখন আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে। ‘প্রথমে প্রতিবেশী’ নীতি এখন যেন ‘প্রথমে চীন’ নীতিতে পরিণত হয়েছে।
(সুমিত গাঙ্গুলির এই নিবন্ধ যুক্তরাষ্ট্রের ফরেইন পলিসি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিভাগের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়ারম্যান ও রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক।)