Abdul Zabbar Khan
০০১
১৯৯৫ সালের কথা।এক বাচ্চার বাবা।ভাগ্যলক্ষ্মী কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না।
ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে থাকি। ফ্ল্যাটের মালিক প্রত্যেক মাসেই ভাড়ার তাগাদা দিতে দিতে ক্লান্ত। একসময় এমন হলো যে আমাকে দেখলে, উনিই এদিক সেদিক মুখ লুকিয়ে ফেলেন। তাগাদা দিতে হবে, এটাই তার মানসিক চাপ। যে তাগাদায় কোন ফলোদয় হয় না, সেটা মানসিক চাপ বইকি।
প্রকৃতপক্ষে, আমি ছিলাম তার ভালোবাসাধন্য একজন মানুষ।
ব্যবসায় ছক্কা পেটানোর কাজ হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল। টাকা আসতে লাগলো বানের জলের মতো। রাখার জায়গা নেই।
কেউ একজন দয়া করে, ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলেন। আর খবর রাখি নাই।
তাই আমরা স্টিলের আলমারিতে, হ্যাঙ্গারে কাপড় ঝোলানোর জায়গায়, টাকার বান্ডেল রাখতে শুরু করলাম। পাঁচশো টাকার নোটে, সব পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডেল। ওই সময়ে ওটাই ছিলো সবচেয়ে বড় বান্ডেল। থরে থরে সাজিয়ে রাখতাম ওগুলো।
একদিন বড় ভাইকে, কি একটা কেনাকাটার জন্য টাকা দিতে হবে। তাকে নিয়ে বেডরুমে চলে গেলাম। আমার স্ত্রীর কাছ থেকে চেয়ে, আলমারির চাবি টা আগেই নিয়ে রেখেছি।
ভাইয়াকে বসিয়ে রেখে আলমারি টা খুললাম। হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়লো সাজানো টাকার বান্ডেলগুলো।
বেশ শব্দ করেই ফ্লোরে পড়লো বেশ কিছু।
আমি বিব্রত হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে।
খোলা আলমারির দিকে তাকিয়ে, ভীষণ অবাক হয়ে বললেন,
: এতো টাকা পেলে কোথায়? বাসায় কেন? আলমারি তে কেন?
আমি তখন ফ্লোর থেকে টাকা কুড়াতে ব্যস্ত।
বললাম,
: পটপট করে কথা না বলে, এগুলো একটু গোছাতে সাহায্য করেন। প্লীজ…!
ভাইয়াও আমার সঙ্গে টাকা তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেল।
একটা বান্ডেল হাতে রেখে আলমারি টা লক করে দিলাম।
ভাইয়া সহজ সরল মানুষ। কোন প্যাচঁঘোচে
গেল না। আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসলো,
: দেখো কুসুম, এতো গুলো ক্যাশ টাকা আমার পুরো জীবনে আমি চোখেও দেখিনি। অথচ তোমার আলমারি ভর্তি টাকা। রহস্য কি? তুমি আবার স্মাগলিং এ জড়িয়ে পড়ো নাই তো?
প্রশ্ন টা করে আতংকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমি গলা খাঁকারি দিয়ে স্টার্ট করলাম,
: বেশি বেশি হিন্দি সিনেমা আপনাকে ডুবিয়েছে। সারাক্ষণ অমরেশ পুরী আর স্মাগলিং! এগুলো ছাড়া কি টাকা কামানো যায় না? খামোখা দুশ্চিন্তা করবেন না!
আমার সব টাকাই সৎ পথে কামাই করা।
ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট আছে ঠিকই।
যাওয়ার সময় নেই। আসলে অভ্যাস নেই।
ভাইয়াকে দেখলাম হাঁফ ছেড়ে রিল্যাক্সড হলেন। সেটাও সিনেমাটিক কায়দায়।
বললেন,
: কালই এগুলো ব্যাংকে জমা করে দিতে হবে। বাসায় রাখা ভীষণ রিস্কি। কেউ টের পেলে ডাকাতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
সুমি ( আমার স্ত্রী ) বিপদে পড়ে যাবে।
আমি খুবই বিনয়ের সঙ্গে সম্মতি দিয়ে দিলাম।
০০২
ব্যবসার প্রথম উপার্জন দিয়ে একটা গাড়ি আর মোবাইল সেট কিনে ফেললাম।
ঢাউস সাইজের মোবাইল সেট। সাথে লাইনের কথা বলছি না। কারণ, ওই সময়ে আলাদা সিম ছিলো না। সেটের সাথেই লাইন কানেকশন।
ডাকাত কোম্পানি সিটিসেল এই ডাকাতির আয়োজন টা প্রথম করেছিলো। আউটগোয়িং বিল মিনিটে আঠারো টাকা, ইনকামিং বিল মিনিটে পনেরো টাকা।
অর্থাৎ কেউ এক মিনিট কথা বললে, ডাকাতদের ইনকাম ছিলো প্রতি মিনিটে তেত্রিশ টাকা।
১৯৯৫ সালের ব্যাপার। টাকা অনেক দামি ছিলো। দেশটাকে একচেটিয়া লুটে নিয়ে, ওই ডাকাতটা কয়েকদিন আগে, সরকারের কোন একটা অংশকে ম্যানেজ করে, লক ডাউনের মধ্যেই লন্ডন চলে গেছে।
যাই হোক, প্রথমেই গাড়ি আর মোবাইলের পেছনে সব টাকা ঢেলে দেয়ার ব্যাপারটা, আমার স্ত্রী সুমি ভালোভাবে নেয়নি।
আমি ইনিয়ে বিনিয়ে বোঝালাম,
: দেখো, এখন ব্যবসায়ে সাফল্য পেতে হলে, তিনটা জিনিস খুব জরুরি। গাড়ি, মোবাইল আর হাজী টাইটেল। দুটো আমার হয়ে গেছে। এক ফাঁকে হজ্ব করে, হাজী টাইটেলটাও বাগিয়ে নেবো।
সুমি আর তর্কে গেল না।
আমার কথা আমি রেখেছিলাম।
ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেল।
আর ব্যস্ততা মানেই টাকা।
প্রতিদিন একগাদা টাকা নিয়ে বাসায় আসি।
আর সুমি ওগুলো আলমারি তে ভরে রাখে।
পরিস্থিতি এমন হলো যে আমরা টাকার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম।
প্রথম প্রথম যখন অনেকগুলো করে টাকা নিয়ে আসতাম, আমি ভীষণ এক্সাইটেড থাকতাম। সুমিও ভীষণ খুশি হতো। ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।
সংসার এবং সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনায় তার মুখ প্রশান্তিতে ছেয়ে যেত।
মাঝে মাঝে আমরা প্ল্যান করতাম, অবসর পেলে কি কি করবো।
ধীরে ধীরে এসব উত্তেজনা হারিয়ে গেল।
গভীর রাতে বাসায় ফিরি। টাকাগুলো ওর হাতে দেই। ও নিরাসক্ত চেহারা নিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে আলমারি খোলে। টাকার বান্ডেলগুলো আগের গুলোর ওপর রেখে দেয়। আলমারি টা বন্ধ করে ডিনারের আয়োজন করতে চলে যায়।
এরিমধ্যে, ভাইয়া অনেকটা জোর করেই একদিন, আলমারির ওই টাকার পাহাড়, ব্যাংকে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করে।
এরপর থেকে বাধ্য হয়েই আমি ব্যাংকমুখী হই। চেকে লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে উঠি।
০০৩
বিয়ের পর, কোন কোন সময় বন্ধু বান্ধবদের আড্ডায় একত্রিত হয়েছি। দেখলাম, প্রায় সবাই নিজেদের গাড়ি নিয়ে হাজির। আমরাই কেবল রিকশা প্যাসেঞ্জার। একটু মন খারাপ হয়নি, এমন নয়। তবে, আমি কখনোই হতোদ্যম ছিলাম না। জানতাম, স্ত্রী সুমিকেও বলতাম, পরিস্থিতি বদলাবে। আমরাও একসময় নিজেদের গাড়ি করেই এসব আড্ডায় যোগ দেবো। ডিনার শেষে, গভীর রাতে রিকশায় করে দুজনে বাসায় ফিরতাম।
গাড়ি কেনার পর এসব যুদ্ধ শেষ।
দিনরাত কেবল কঠোর পরিশ্রম।
প্রতিদিনই সকাল সাতটায় বেরিয়ে যাই। ফিরে আসি, রাত বারোটা একটার দিকে। বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতের খাবার নিয়ে বসেছি দু’জনে। বাসার ফোন, মোবাইল ফোন বেজেই চলেছে।
সুমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে যেতো।
কিন্তু কিছু বলতো না।
এর মধ্যে যোগ হলো নতুন আরেকটা ইস্যু।
আমার ছোটবেলার বন্ধুকে ব্যবসার পার্টনার করে নিয়েছি।
একদিন কি একটা কাজে, ঢাকার মালিবাগে গেছি। ফেরার সময়, গাড়ি রিকশার জ্যামে পড়েছে। রাস্তার পাশের চুল কাটার দোকান অর্থাৎ সেলুন থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো আমার ওই বন্ধু। গ্লাস নামিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। সে বারবার অনুরোধ করলো, এক কাপ চা খাওয়ার জন্য। ড্রাইভারকে গাড়ি সাইড করতে বললাম।
রাস্তার পাশের একটা রেস্টুরেন্টে, দু’জনে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিলাম। অনেক বিষয় নিয়ে কথা হলো। তার বেকারত্ব নিয়ে গভীর হতাশার কথা বললো। আমি বারবার বললাম যে তার চেষ্টায় ত্রুটি আছে।
নইলে, এরকম ব্রিলিয়ান্ট একজন ছাত্র, যে কিনা ছাত্র রাজনীতিতেও মোটামুটি সফল, তার ক্যারিয়ার গড়তে তো সমস্যা হবার কথা নয়। তার একটাই কথা, কপাল খারাপ। আমি বললাম, এগুলো কাওয়ার্ড টাইপ কথাবার্তা।
বিদায়ের সময়, মাঝে মাঝে তার ওখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। আমি ঠিকানা চাইতেই, সে ওই সেলুনটা দেখিয়ে বললো যে ওখানে গিয়ে তাকে খুঁজলেই ওরা ডেকে দেবে। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বললাম,
: কিছু মনে করিস না দোস্ত। এই বয়সে এখন কি আর পাড়ার সেলুনে, রেস্টুরেন্টে দেখা করাটা শোভন হবে?
সে খুব বিব্রত হয়ে বললো,
: দোস্ত, কিছু মনে করিস না। বেকার মানুষ। সস্তা মেসে থাকি। এই একটু ভেতরের দিকেই। তোকে ওখানে যাওয়ার কথা বলতে পারছি না।
: থাক। বলা লাগবে না। এই ভিজিটিং কার্ড টা রাখ। আগামী কাল আমার অফিসে চলে আয়। দেখি, তোর জন্য কিছু করা যায় কিনা!
বলে, তার দিকে আমার একটা বিজনেস কার্ড এগিয়ে দিলাম।
আমার বন্ধুর চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো।
কার্ডটা দেখতে দেখতে খুব খুশি হয়ে বললো,
: আমি কাল সকালেই চলে আসবো।
পরদিন বন্ধু আমার অফিসে আসার পর, ওর সাথে দীর্ঘ একটা ক্লোজডোর মিটিং হলো। সবকিছু বুঝিয়ে ওকে আমার বিজনেস পার্টনার করে নিলাম।
তার অবাক চেহারা আমার এখনও মনে আছে। বারবার বলছিলো,
: আমার তো কোন ক্যাপিটেল নেই। কিভাবে কি?
আমি আশ্বাস দিয়ে বললাম,
: এগুলো আমি দেখবো। এখন ওই মেস ছেড়ে দে। আমার বাসার চারতলায় একটা ফ্ল্যাট খালি আছে। বাড়িওয়ালা কে রাতেই বলে রেখেছি। তুই এই মাস শেষেই শিফট কর! ফার্নিচার, বাড়িভাড়া, এগুলো আমি দেখবো। তুই আমার বন্ধু। তোকে আমি লো লেভেলে থাকতে দিতে পারি না। ভবিষ্যতে লাভ হলে, ওখান থেকে এই খরচ গুলো কেটে নেবো। নতুন বাসায় উঠে, গ্রাম থেকে খালাম্মা কে নিয়ে আসিস।
আমার মনে আছে। দু’দিন পরই বানিজ্য মেলা শুরু হলো। সুমি, আমি এবং আমার বন্ধু, তিনজন মিলে বানিজ্য মেলা থেকেই ওর বাসার জন্য প্রায় সব কেনাকাটা শেষ করে ফেললাম।
এর মধ্যে ছিলো, টেলিভিশন, ফ্রীজ, খাট, কার্পেট, সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল সহ হাউজহোল্ড সব আইটেম। বন্ধু টি বিব্রত হলেও মহাখুশি এগুলো দেখে।
পরের দিন তাকে আমার মতোই একটা সিটিসেল মোবাইল সেট কিনে উপহার দিলাম। টেইলার্স এ নিয়ে গিয়ে স্যুট ব্লেজার সহ একগাদা ড্রেসের অর্ডার দিয়েছি।
রাস্তার ভ্যাগাবন্ড থেকে মাত্র কয়েক দিনে একেবারে কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব বানিয়ে ছেড়েছি। ওর এই চেঞ্জ দেখে আমার সার্কেলের সবারই তখন মাথা নষ্ট।
পুরো ব্যাপারটাই অনেকটা সিনেমাটিক।
বন্ধুদের আড্ডায় সবাই তাকে বলতো যে কুসুমের মতো বন্ধু, তোর জীবনের সেরা প্রাপ্তি। অনেকটা অ্যানজেল টাইপ। ওর সাথে কখনো বেইমানি করিস না। সারাজীবন এটাকে সন্মান দেখিয়ে চলবি।
বলাবাহুল্য, আমি এসব কথায় খুবই বিব্রত বোধ করতাম।
আমার ওই পার্টনারের মা আসার আগ পর্যন্ত, আমরা রাতে বাসায় ফিরে সুমির রান্নাই খেতাম। গভীর রাত। ঘুম ঘুম চোখে সুমি দু’জন কে খাবার বেড়ে খাওয়াচ্ছে।
এদিকে ফোন বেজে চলেছে।
আমিও সব কল অ্যাটেন্ড করছি।
খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার!
কিন্তু সুমি কঠিন ধৈর্যশীল হয়ে এগুলো ম্যানেজ করে নিয়েছে।
ফলে ডিনার টাইমটা আরও বেশি দীর্ঘ হয়ে যেত। বাচ্চা টা তখন গভীর ঘুমে।
০০৪
টাকা পয়সা ইনকাম করার সাথে সাথে মানুষের দায়িত্ব বাড়ে, বুদ্ধিও বাড়ে।
আমার গেল কমে।
সাধারণ নিয়ম হলো, আগে বাড়ি, পরে গাড়ি। আমি তো প্রথমেই গাড়ি কিনে ফেলেছি। এরপর ফ্ল্যাট বা বাড়ির ব্যাপারটা আসতে পারতো।
কিন্তু তা হলো না।
একজন বোঝালো যে টয়োটা ক্যারিনা, ফ্যামিলি কার হিসেবে ঠিক আছে।
কিন্তু এখন লেটেস্ট একটা গাড়ি এসেছে। সেইরকম স্টাইলের। টয়োটা এক্জিভ। অনেকটা স্পোর্টস মডেল টাইপ।
দেখতে গিয়ে ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল।
সাথে সাথেই কিনে ফেললাম।
রাস্তায় হঠাৎ করেই চোখে পড়লো বিশাল সাইজের নিশান সাফারি এসইউবি। এটাতে সানরুফ সিস্টেম আছে, জানতাম। জেনারেল এরশাদকে এই গাড়ি থেকে, বিভিন্ন পথসভায়, কচ্ছপের মতো ওপর দিয়ে মাথা বের করে, মেগাফোনের সাহায্যে অনেক বক্তৃতা দিতে দেখেছি। এসব কথা মনে করে, সেইম গাড়ি একটা কিনে নিলাম। ভেবেছি, এরশাদ পারলে, আমি পারবো না কেন?
পাগলামি কাকে বলে! মানুষ তিনজন।
গাড়িও তিনটা। ড্রাইভারের সংখ্যাও বেড়ে গেল। বাড়ির খবর নেই। ফার্নিচার কেনার খবর নেই। ভালো কিছু কিনবো একসময়, এটা ভেবেই দিন পার হচ্ছে। আমরা একটা ভাঙ্গা পুরনো পড়ার টেবিলের ওপর কাপড় বিছিয়ে, তার ওপর খাবার খাই।
আমাকে কেউ কিছু বলেও না। ভাবে, এতো বুদ্ধিমান মানুষ। স্বভাবে লিডার টাইপ। কি বলতে কি বলে ফেলি! বুদ্ধির নমুনা হলো এই যে ব্যাংকে অগাধ টাকা, লেটেস্ট মডেলের গাড়ি তিনটা। কিন্তু ঘরে একটা বহু পুরনো সোফা, বহু পুরনো চেয়ার টেবিল দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি।
অনেক সময়, জিনিসপত্র রেখে টেবিল ভরে ফেললে, ফ্লোরে মাদুর বিছিয়ে খেতে বসে যাই। এসব দেখে মেহমানরা বিব্রত হলেও, আমার কোন বিকার ছিলো না।
কে কি মনে করে বসে থাকলো, এসব আমি জীবনেও পাত্তা দেইনি। এখনও দেই না।
একদিন যথারীতি রাত বারোটার দিকে বাসায় ফিরেছি। সেদিন একাই ছিলাম। বন্ধু গাড়ি থেকে নেমে, তার ফ্ল্যাটে চলে গেছে। ড্রইং রুমের দরজা খুলতেই দেখি, আমার স্ত্রী সুমির পেছনে, বড় মেয়ে ওয়ামিয়া দাড়িয়ে আছে। এক বছরের কিছু কম হবে বয়স। এসময়টায় তার গভীর ঘুমে থাকার কথা।
আমি বাচ্চাটাকে সজাগ দেখে খুব খুশি হয়ে গেলাম। মার জামা ধরে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি একটু ঝুঁকে, হাসিমুখে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি, বাচ্চা টা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বেডরুমের দিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। সেই সাথে গগনবিদারী চিৎকার।
হতভম্ব আমি! সুমির দিকে বিব্রত এবং দুঃখিত চেহারা নিয়ে তাকালাম। ও কোন কথা না বলে, বাচ্চা টাকে ঠান্ডা করতে বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
আধঘন্টা পর সুমি ডিনার সার্ভ করে সামনে এসে বসলো। বললো,
: মুখটা এমন করে রেখেছো কেন?
বাচ্চার ব্যবহারে মন খারাপ?
আমি ওপর নিচ মাথা নাড়লাম।
বললাম,
: আমি তো ওর বাবা। আমি আদর করতে চেয়েছি। ও ভয় পেলো কেন?
সুমি খানিকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। তারপর বললো,
: দেখো কুসুম। তুমি ওর বাবা। এটা তুমি জানো। ও কি তা জানে? তুমি ওকে ঘুমে রেখে কপালে একটা চুমু দিয়ে সেই সকালে বের হয়ে যাও। রাতে যখন বাসায় ফেরো, ও তখন গভীর ঘুমে। তাই, প্র্যাকটিক্যালি, ও তোমাকে কখনোই দেখেনি। চিনবে কি করে? দুএকদিন হয়তো জেগে ছিলো। কিন্তু তোমার বন্ধুর কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে এদিকে আসেনি। একা একা বড় হচ্ছে। বাইরের মানুষ দেখলে ভয় পায়।
তোমাকেও সে বাইরের মানুষ বলেই মনে করেছে। তাই ভয়ে এমনটা করেছে।
আমি বোবা দৃষ্টিতে সুমির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছি। রীতিমত কান্না পেয়ে গেল। চোখ ভরে গেছে পানিতে।
আমার মেয়ে আমাকে চেনে না।
বাবা হিসেবে এই কষ্টটা আমি কিছুতেই নিতে পারছিলাম না।
০০৫
বাচ্চা কে ঘুমে রেখে সাতসকালে বাইরে চলে যাই। ফিরে আসি গভীর রাতে। তখন সে থাকে ঘুমিয়ে। জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থেকে, এভাবেই বাচ্চার চোখে অচেনা হয়ে গেলাম। রাত বারোটায় ঘরে ফিরে, এই ঘটনায় আমি আক্ষরিক অর্থেই বোবা হয়ে বসে আছি। দীর্ঘক্ষণ কথা সরছিলো না মুখে।
আমার স্ত্রী সুমি খুব স্বল্পভাষী মেয়ে। সেও চুপচাপ বসে রইলো। কয়েক মিনিট ধরে দুজনেই নীরব। আমিই নীরবতা ভাঙলাম।
সুমিকে জিজ্ঞেস করলাম,
: এরকম যে হতে পারে, মা হয়ে তুমি বোঝ নি আগে? এটা তো নিশ্চয়ই একদিনে হয়নি। আমাকে সাবধান করলে না কেন?
ক্ষোভে আমি ফুঁসে উঠলাম।
: কে বলছে এসব কথা? তুমি?
সারাদিন সারারাত টাকার খনি নিয়ে ব্যস্ত থাকো তুমি। ঘরে ফিরে, খাওয়ার সময় পর্যন্ত, ফোন বাজতেই থাকে। পারিবারিক কথা বলার বা শোনার সময় কই তোমার?
আমি ভীষণ অবাক হয়ে বললাম,
: আমি কি আমার একার জন্য এগুলো করছি? টাকা তো সবারই লাগবে। আর টাকা যেখান থেকে আসে, সেখানে সময় দিতে হয়। এর বাইরে একটাই রাস্তা। লটারি ভাগ্য। ওটা যে আমার নেই, তা তুমি ভালো করেই জানো। বহু কষ্টে আমি এই জায়গাটা তৈরি করেছি। সবকিছুর বেনিফিসিয়ারি হয়ে, এখন উল্টাপাল্টা কথা বলছো কেন?
দৃষ্টিতে গভীর দুঃখ নিয়ে সুমি আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,
: আমি কি টাকাওয়ালা কুসুম কে ভালোবেসেছিলাম? নাকি, অনেক বড়লোক হতে হবে, এমন কোন শর্ত দিয়েছিলাম?
আমি অভাবে থেকেও, তোমাকে নিয়ে অনেক আনন্দে ছিলাম। তোমার দেয়া সময়টুকু ছিলো, আমার কাছে অনেক দামি।
উত্তেজিত হয়ে সুমি একনাগাড়ে বলে চলেছে,
: অথচ, টাকা আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। রাত বারোটা একটায়ও বন্ধু কে সাথে নিয়ে খেতে বসো। তোমাদেরকে খাইয়ে, আমি ঠিকমতো খাই কিনা, একবারও জিজ্ঞেস করেছো?
এখন এগুলো নিয়ে আফসোস করে লাভ কি? এভাবেই চলতে থাকো। টাকার পাহাড় বানাও। কিন্তু বাচ্চাকে নিয়ে কোন কষ্টের কথা আমাকে বলতে পারবে না।
হাহাকার করে উঠলো আমার ভেতরটা।
অনুনয়ের সুরে বললাম,
: আমি যদি সব ছেড়ে, কাল ভোরেই তোমাদেরকে নিয়ে, কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই, খুশি হবে তুমি?
সুমির চোখে অবিশ্বাসের ছোঁয়া।
বললো,
: হাহ্… তুমি যাবে কক্সবাজার?
নিজের বাচ্চাকে দেখার টাইম নাই তোমার।
এতো রাতে এসব ফালতু কথা বন্ধ করো!
সেরাতে ঘরে ঢুকেই এসব ঘটনায় জড়িয়ে পড়াতে, ড্রাইভারকে বিদায় দেয়া হয়নি।
দরজা খুলে গলা চড়িয়ে ডাকলাম তাকে।
খুব বিশ্বস্ত এবং অভিজ্ঞ ড্রাইভার এই তোতা মিয়া। বয়সে জোয়ান এবং ডিউটিতে কোন ক্লান্তি দেখিনি কখনও।
তবু ভয়ে ভয়ে বললাম,
: এখন বাজে রাত দেড়টা। সকাল ছয়টায় রওনা দিতে চাই। কক্সবাজারে যাবো।
তুমি বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া এবং কাপড়চোপড় আনার জন্য সময় পাবে মাত্র এক ঘন্টা। গাড়ি নিয়ে যাও। ফিরে এসে পার্কিং এ একটু রেস্ট নিও। সম্ভব?
তোতা মিয়া নির্বিকার ভাবে মাথা ঝাঁকালো।
বললো,
: আপনারা রেডি হন। আমি যামু আর আসমু।
এই হঠাৎ প্রাপ্তির আনন্দে সুমির চোখ ঝলমলে হয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি জিনিস পত্র গোছাতে লেগে গেল।
আমি কয়েকটা ফোন করে সবাইকে জানিয়ে দিলাম যে আগামী সাত দিন আমাকে পাওয়া যাবে না। ফোন বন্ধ থাকবে। বন্ধু কাম পার্টনার ভয় দেখালো যে এরকম হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলে, বিজনেসের ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে।
আমি শক্ত কথায় বুঝিয়ে দিলাম যে ফ্যামিলি আগে। বিজনেস পরে।
ভোর ছয়টার দিকেই আমরা কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। অনেক দিন পর ব্যবসায়িক যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেয়ে আমারও খুব ভালো লাগছিলো।
সুমির কাছে জানতে চাইলাম যে তার কেমন লাগছে? সে মৃদু হেসে বললো,
: আমি এই কুসুমকেই ভালোবাসি।
বাস্তববাদী, কিন্তু একটু পাগলাটে টাইপ। হুট করে ডিসিশন নিয়ে যে কোন কিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
আমি ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
: তার মানে আমি পাগল?
: হুম। পাগলই তো। না হলে, এতো সাধের ব্যবসা ছেড়ে, বৌ বাচ্চা কে সময় দেয়ার জন্য, এতো শর্ট নোটিশে, কেউ এগুলো করতে পারে? যে মোবাইল ফোন আমার লাইফ হেল করে দিচ্ছিলো, ওইটাও বন্ধ করে দিয়েছো। হোয়াট এ স্যাক্রিফাইস!
: যাক, তুমি বুঝলেই হলো!
পুরুষ মানুষ হলো রাজা বাদশাহর জাত।
রাজা বাদশাহরা শুধু আকাম কুকাম নিয়েই ব্যস্ত থাকেনি। কেউ কেউ ভালোবাসার জন্য রাজ্য ছেড়ে বনবাসীও হয়েছে। এখন দেখতে হবে, ঢাকায় ফেরার পর, রাজ্যটা আবার ফিরে পাই কিনা।
: এখন ওই বাদশাহগীরি রাখো!
এই ক’দিন, জাস্ট বৌ বাচ্চার গোলাম হয়ে থাকতে হবে। যা বলবো, তাই শুনতে হবে।
শুধু ঘুরে বেড়াবো। একটা মূহুর্ত আমি নষ্ট হতে দেবো না!
: জ্বী ম্যাডাম। অ্যাট ইয়োর সার্ভিস।
গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে।
সারাক্ষণ ধরে গান বাজছে।
আমার মেয়ে গানের তালে তালে নাচছে।
বারবার ক্যাসেট বদলে দিয়ে, গানের ব্যাপারটা চালু রাখলাম আমি। এটা ওর নজর এড়ায়নি। ব্যস, গান শুনিয়ে শুনিয়েই মেয়ের সাথে খাতির করে ফেললাম।
একটা ক্যাসেট শেষ হলেই ও বদলে দিতে বলে। আমিও তাই করি। অর্ডার মানলে সবাই খুশি হয়। আমার মেয়েও খুশি।
যাত্রাবিরতির সময় মিলিয়ে দুপুর তিনটার দিকে আমরা কক্সবাজারে, মোটেল শৈবালে পৌঁছে গেলাম। সেসময়ের সেরা আবাসিক হোটেল।
০০৬
কোনরকম পরিকল্পনা ছাড়াই, কক্সবাজারে আমাদের ফ্যামিলি ট্যুর শুরু হয়ে গেল।
সেই সময়ে কক্সবাজার ভ্রমন বলতে, সি বিচে সাগরের পানিতে ভেজা, ছাতার নিচে বসে ছবি তোলা, ঝিনুক শামুকের তৈরি কিছু স্যুভেনির কেনা, সন্ধ্যার পর বার্মিজ মার্কেটে একটু টো টো করা, এগুলোকেই বোঝাতো।
এতো সুন্দর সব হোটেল, রাস্তা ঘাট তখনও তৈরি হয়নি। ডিপ ফরেস্ট এরিয়াগুলো, তখন সাধারণ মানুষের জন্য অধরাই থেকে যেতো। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের রাস্তায় সন্ধ্যার পর চলাচল করা বিপদজনক ছিলো। রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ডাকাতি হতো।
শুনলাম, চান্দের গাড়ি ( বহু পুরনো জীপ টাইপ গাড়ি ) দিয়ে ইনানী নামে একটা জায়গায় যাওয়া যায়। পুরো জার্নিটাই হবে সি বিচের বালুর ওপর দিয়ে। জোয়ার ভাটা হিসেব করে চলতে হবে।
হোটেল স্টাফরা বললো, কষ্ট করে একবার যেতে পারলে নাকি, খুব ভালো লাগবে। নতুন একটা ফরেস্ট বাংলোও নাকি বানানো হয়েছে ওখানে। ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নিয়ে গেলে, বিশ্রাম নেয়া, প্রয়োজনে থাকার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। ব্যস, আর পায় কে! ডিসিশন ফাইনাল।
একদিন খুব ভোরে, আমরা অভিযাত্রীরা রওনা দিলাম। আমাদের ড্রাইভার তোতা মিয়া ও আছে সহযাত্রী হিসেবে। ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে এরকম রাস্তায় যে কতোরকম ফ্যাসাদ হতে পারে, এটা একবারও মাথায় আসেনি।
খুব এক্সাইটিং একটা জার্নি ছিলো এটা।
ডানপাশে নিরবিচ্ছিন্ন সাগরের ঢেউ, বামপাশে পাহাড়। ভেজা বালুর ওপর দিয়ে পঙ্খিরাজের মতো চলছে গাড়ি। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই, সাগরের ঢেউয়ের ঝাপটা এসে, আমাদেরকে আলতো করে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। মাথার ওপর কোন শেড নেই। তাই সবদিকেই দৃষ্টি অবারিত। কন্যা ওয়ামিয়াকে দেখলাম, সুপার এনার্জেটিক।
ক্লান্তিহীন ভাবে সাগরের ঢেউ দেখে দেখে চিৎকার করে যাচ্ছিলো। যা আশা করেছিলাম, তার চাইতে অনেক বেশি মজার হয়ে গেল জার্নিটা।
খানাখন্দ, ছোটখাটো পানির নালা পেরিয়ে, প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর পৌঁছে গেলাম ইনানী বিচে। ঘড়িতে দেখলাম, দশটার মতো বাজে। দীর্ঘক্ষণ ধরে কোন স্থাপনা চোখে পড়েনি। দূর থেকে দোতলা ফরেস্ট বাংলাটাকে দেখে, হোয়াইট হাউসের মতো বিশাল মনে হলো।
দীর্ঘ সময় ধরে লক্কর ঝক্কর গাড়িতে ট্র্যাভেল করে সবাই ক্লান্ত ছিলাম। ফ্রেশ হতে হবে। তাছাড়া, একটু বিশ্রামও দরকার।
চান্দের গাড়ির ড্রাইভার বললো,
: পারমিশন লইয়া আইছেন তো?
নাইলে কিন্তু এই বাড়িত ঢুকবার দিবো না।
এরিমধ্যে তোতা মিয়া বাংলোর দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। সে নাকি পারমিশন ছাড়া গেটের ভেতরেও ঢুকতে দেবে না। দেওয়ার অনুমতি নাই।
সুমির মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। বললো,
: সবসময় বাড়াবাড়ি! আসার আগে পারমিশনটা নিয়ে আসলেই হতো। তোমার মামাতো ফরেস্টের বড় কর্তা। এখন এই বাচ্চাটা নিয়ে কি আমি সাগরের পাড়ে বসে থাকবো?
আমি অনেকক্ষন পর সুযোগ পেয়ে আরাম করে সিগারেট খাচ্ছিলাম। গভীর ধোঁয়ার রিং টা সুমির মুখের দিকে ছুঁড়ে দিলাম।
বললাম,
: এতো সহজেই হার মেনে নাও কেন?
মানুষ ভয়ংকর আফ্রিকার জঙ্গল দখল করে বসতি বানিয়েছে। থাকার ব্যবস্থা করেছে। আর এটাতো মামুলি হামজ্বর।
আমার সঙ্গে আসো।
বলে, ওদেরকে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। সুমি একটু কনফিউজড। কিন্তু আমার ফাইটিং টেনডেন্সির ওপর তার কিছুটা আস্থা আছে। ওয়ামিয়াকে নিয়ে আমার পেছনে পেছনে এগুলো।
মাঝ বয়সী দারোয়ান বন্ধ গেটের ভেতর থেকেই কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। আমি কাছে গিয়ে, তার উদ্দেশ্যে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলাম। বললাম,
: পারমিশন আছে। এতো দূরে পারমিশন ছাড়া কি আসা যায়? গেট খোলেন! কাগজ দেখাচ্ছি।
এবার দারোয়ান একটু হকচকিয়ে গেল।
তাড়াতাড়ি গেট খুলে দিলো।
সবাই ভেতরে ঢুকে গেলাম।
সুমির চেহারায় খানিকটা শংকার ছাপ দেখতে পাচ্ছি।
দারোয়ান কে ইশারায় একটু সাইডে নিয়ে গেলাম। পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে ওর হাতে দিলাম।
সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।
বললাম,
: সবচেয়ে ভালো রুমটা খুলে দিন!
সাফসুতরো হওয়া চাই। বাজারের জন্য এক্সট্রা টাকা দিচ্ছি। বলে, আরো এক হাজার টাকা দিলাম তাকে। বনমোরগ কিনে রান্না করার ব্যবস্থা করবেন। আমরা দুপুরে খেয়েদেয়ে রওনা হবো। কি, এই পারমিশনে চলবে তো?
দারোয়ান ব্যাটা আবেগপ্রবণ হয়ে, আর্মি কায়দায় জোরে পা ঠুকে একটা স্যালুট দিলো। কথা বলার সময় অতিরিক্ত আবেগে তার কন্ঠস্বর কেঁপে উঠলো:
: স্যার এই বাড়ি এহন আপনের। যতক্ষণ লাগে, থাকবেন। আমি নিজেই রান্না জানি। রান্না খাইলে সারাজীবন আমার কথা কওন লাগবো।
বলেই আমাদের ছোট ট্র্যাভল ব্যাগটা নিয়ে ভেতরের দিকে দৌড় দিলো।
আমাদের জন্য, বাংলোর দোতলায় ভিআইপি রুমটা খুলে, ঝাড়মোছ করে দিয়েছে। আমরা কিছুটা সময় ড্রইংরুমে কাটিয়ে, বেডরুমে ঢুকলাম। ফ্রেশটেশ হবার পর দোতলার বারান্দায় গেলাম সুমিকে নিয়ে। এরিমধ্যে অবশ্য ফিডারে দুধ ভরে, মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। সে দুধ খেতে খেতে, খুব গম্ভীর চেহারা নিয়ে, বড়কর্তা স্টাইলে বাংলো পরিদর্শন করা শুরু করেছে।
সুমিকে বললাম,
: কেমন দেখলে?
সুমি জবাব দেবার বদলে অনেকক্ষণ ধরে হাসলো। চোখে গভীর আস্থা নিয়ে বললো,
: তোমার কাছে মনে হয়, পৃথিবীর কোন কিছুই সমস্যা না। তাই না? এরকম অনেক কিছু আগেও দেখেছি। তবুও হঠাৎ হঠাৎ ঘাবড়ে যাই।
দুপুরে আমরা সবাই অনেক মজা করে খেলাম। কঠিন ঝাল দিয়ে বনমোরগের ঝোল আর ডাল। সাথে ডিম ভাজা।
একেবারে বেহেশতি খাবার।
জোয়ার ভাটা হিসেব করে, আড়াইটায় আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম।
আসার সময় রোদ নরম ছিলো বলে, অতোটা গা করিনি। এবার কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। দুপুরের কড়া রোদে শুধু মাথা নয়, কলজে পর্যন্ত বার্ণ হয়ে যাচ্ছে।
তবু খোলামেলা গাড়িতে, বাতাস পাচ্ছি বলে, কিছুটা রক্ষা।
ছোট একটা নালার কাছে এসে, গাড়িটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকবার ট্রাই করেও স্টার্ট করাতে পারলো না। আমি আঁতকে উঠলাম। তাড়া দিলাম ড্রাইভারকে।
সে মোলায়েম হাসি দিয়ে আমাকে আশ্বাস দিলো। বললো,
: পাঁচ মিনিটের মামলা। এখনই ঠিক হয়ে যাবে।
বলেই, চট করে গাড়ির নিচে ঢুকে গেল। তার হেল্পার তাকে যন্ত্রপাতি এগিয়ে দিচ্ছে।
সময় পার হচ্ছে। সূর্যের তাপ সবকিছু পুড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েকে এই তাপ থেকে বাঁচানোর জন্য অস্থির হয়ে গেলাম।
খোলামেলা গাড়ি নিয়ে অনেক আনন্দে ছিলাম। এখন এটাকেই অভিশাপ মনে হচ্ছে। সুমি শুধু বলছিলো, প্লিজ, ওয়ামিয়ার জন্য কিছু একটা করো। আমি বললাম,
: মানুষের ব্যাপার হলে নিশ্চয়ই ম্যানেজ করা যেতো। কারণ চান্স পেলে অধিকাংশ মানুষ দূর্নীতি করে। যেমন, দারোয়ান টা করলো। কিন্তু প্রকৃতি কোনরকম ফাঁকি দেয়না। যখন যা দেবার, পুরোটাই দেয়। কি শীত, কি গরম। এখানে আমিও অসহায়।
দেখা যাক!
কিছুক্ষণ পর আমি নিজের শার্ট খুলে ফেললাম। তোতা মিয়াও হয়তো আন্দাজ করে, তার শার্টটাও খুলে দিলো। বোতামের সাহায্য নিয়ে দু’টোকে একটা বানিয়ে সাইজ বড় করলাম। তারপর ওটার চারটা কোনাকে গাড়ির ওপরের পাইপগুলোর সাথে বেঁধে দিলাম। এভাবে গাড়ির একটা কর্নারে সামান্য একটু ছায়া তৈরি হলো।
ওয়ামিয়াকে নিয়ে সুমি কোনরকমে ওই ছায়ায় আশ্রয় নিলো। আমি আর তোতা মিয়া, অনলবর্ষী ওই রোদে খালি গায়ে গ্রীক ভাস্কর্যের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
পাঁচ মিনিটের জায়গায় প্রায় ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেল। তারপর বের হয়ে এসে ড্রাইভার বললো,
: বলছি না! চিন্তার কোন কারন নাই।
হাসিমুখে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে আবার বন্ধ করে দিলো।
খেঁকিয়ে উঠলাম,
: আবার কি হলো? গাড়ি বন্ধ করলে কেন?
ড্রাইভার বিনয়ের সঙ্গেই জবাব দিলো,
: সামনে এবং পিছনের সব নালা এখন জোয়ারের পানিত সয়লাব হইয়া গেছে।
নড়াচড়া করন যাইবো না। আরও দেড় ঘন্টা পরে, ভাটা শুরু হইলে গাড়ি যাইবো।
আমরা সবাই, রনাঙ্গনে মার খাওয়া সৈনিকের মতো মুখ করে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
চলবে….