অনলাইন ডেস্কঃ শরতে সোনালী ধানের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে এমনই সময় সুজলা-সুফলা বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফর। ছয় বছর পর আমার দ্বিতীয় বাংলাদেশ সফর। এ সফরে নতুন ও পুরোনো বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক ঝালাই, যৌথভাবে উন্নয়নের নতুন ধারণা অন্বেষণ, এবং একসঙ্গে সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মচন।
বাংলাদেশ এক অদ্ভুত সুন্দর ও মনোরম স্থান। এখানে আছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মতো তিনটি বড় নদী; আছে হাজার হাজার বর্গমাইলের উর্বর ভূমি। বছরের অধিকাংশ সময়ই বাংলাদেশ সবুজ জেইড পাথরের মতো রঙিন। ফসল তোলার সময়ে এই দেশই আবার সোনালী পোশাকে আবৃত হয়। অদ্বিতীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই দেশের মানুষ পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান। বাঙালি ও বাংলা ভাষার রয়েছে হাজার বছরের উজ্জ্বল ইতিহাস। বাংলায় সাহিত্যচর্চা করে বিশ্বখ্যাত হয়েছেন নোবেলবিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে আসছে এবং দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক দারিদ্র্য বিমোচনেও বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সংস্কার ও উন্নয়নের পথে হেঁটেছে এবং এর ফলস্বরূপ দেশটির অর্থনীতিতে ৬ শতাংশের বেশি করে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। দেশটিতে শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রক্রিয়াও ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ‘২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবার লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে।
চীন ও বাংলাদেশের জনগণ প্রাচীনকাল থেকেই পরস্পরের ভালো প্রতিবেশী ও বন্ধু। প্রাচীনকালের দক্ষিণ রেশমপথ এবং সামুদ্রিক রেশমপথ ছিল দু’পক্ষের যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার মূল মাধ্যম। এ নিয়ে হাজার বছর ধরে প্রচলিত অনেক গল্প-কাহিনীও রয়েছে। চীনের ফাহিয়েন ও হিউয়েন সাং বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সন্ধানে এতদঞ্চলে এসেছিলেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অতীশ দীপঙ্কর চীনে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছেন। চীনের মিং রাজবংশ আমলের সমুদ্রচারী চাং হো’ও দু’বার বাংলা সফর করেন। তিনি লিখেছেন: “এ অঞ্চলের রীতিনীতি সরল। এলাকাটি জনবহুল ও শস্যসমৃদ্ধ। এখানকার উর্বর জমিতে প্রচুর ফলন হয়।’ বঙ্গদেশের তত্কালীন রাজা চীনের মিং রাজবংশ আমলের সম্রাটকে একটি জিরাফ উপহার দিয়েছিলেন। তখন ওই জিরাফ চীনে ‘চীনা ড্রাগন ছিলিন’ নামে খ্যাতি অর্জন করেছিল।
আধুনিক যুগে এসে চীন ও বাংলাদেশের জনগণকে যুদ্ধ ও দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। দু’দেশের জনগণই জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য সফল লড়াই করেছে। পরবর্তী কালে নিজ নিজ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য তারা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন।
চীন-বাংলাদেশ মৈত্রীর ইতিহাসও দীর্ঘ। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তত্কালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই দু’বার ঢাকা সফর করেন। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেসময় দু’বার চীন সফর করেন। চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই দু’দেশের প্রবীণ নেতৃবৃন্দ মৈত্রীবৃক্ষের চারাটি রোপণ করেছিলেন। আজ সেই বৃক্ষ অনেক বড় হয়েছে, যার শিকড় অনেক গভীরে প্রথিত। এই বৃক্ষের ‘ফল’ও দু’দেশের জনগণ পেয়েছে এবং পাচ্ছে।
চীনারা বলে, ‘মনের মিল থাকলেই কেবল দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব হতে পারে।’ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৪১ বছর ধরেই চীন বাংলাদেশকে আন্তরিক বন্ধু ও উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে গণ্য করে আসছে। চীন সবসময় দু’দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় এবং কেন্দ্রীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে পরস্পরের পাশে থাকার নীতিতে বিশ্বাস করে।
চীন ও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজন্মের নেতৃবৃন্দ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে সুষ্ঠু যোগাযোগ বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করে এসেছেন এবং দু’দেশের সম্পর্কোন্নয়নে বরাবরই কাজ করে গেছেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের শীর্ষসম্মেলন চলাকালে আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাত হয়। তখন তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ, যৌথভাবে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ কৌশল বাস্তবায়ন ও ‘বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর’ নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত, এবং দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করতে একমত হয়।
চীন ও বাংলাদেশের জনগণের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় সুফল অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। আর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২০০০ সালের ৯০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৫ সালে ১৪৭০ কোটি ডলারে পৌঁছায়। এক্ষেত্রে বার্ষিক বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ শতাংশ। বাংলাদেশের পাটজাতীয় পণ্যও চীনের বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সর্বাধুনিক নির্মাণপ্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শাহজালাল সার কারখানা ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্র। বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের ‘স্বপ্নের সেতু’ পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। পরিবহন, বিদ্যুত, জ্বালানি ও টেলিযোগাযোগসহ নানা ক্ষেত্রে চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এই নির্মাণকাজের সাথে জড়িত আছে। চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক প্রথম দফায় যেসব প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুত বিতরণব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের এক কোটির বেশি গ্রামবাসী উপকৃত হবেন। তা ছাড়া, দু’দেশ প্রতিরক্ষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতায়ও লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে।
চীন ও বাংলাদেশ জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশ। দু’দেশের মধ্যে অনেক মিল আছে; দু’দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও কাছাকাছি। ‘সোনার বাংলা’-র স্বপ্ন বাংলাদেশের জনগণের সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী হবার স্বপ্ন। এ স্বপ্নের সাথে চীনা জাতির মহান পুনরুত্থানের ‘চীনা স্বপ্ন’র মিল রয়েছে। চীনের উত্থাপিত ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ কৌশল দু’দেশের সামনে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ ও অভিন্ন কল্যাণ লাভের নতুন সুযোগও সৃষ্টি করেছে। ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার পরিমাণ, বাজারের সুপ্তশক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ কৌশল বাস্তবায়নে চীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মান উন্নত করতে, দু’দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতার দিক নির্ধারণ করতে, চীন-বাংলাদেশ বিনিময় ও সহযোগিতা বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে এবং সার্বিকভাবে দু’দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চীন কাজ করছে।
রাজনৈতিক যোগাযোগ জোরদার করা, আন্তরিক ও পারস্পরিক আস্থার সুফল অর্জন করা চীনের লক্ষ্য। বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা গোটা বিশ্বে বন্ধুত্ব স্থাপন করবো। কোনো দেশের সাথে আমাদের শত্রুতা থাকবে না।’ চীন সবসময় বাংলাদেশের বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু ও অংশীদার। দু’পক্ষের উচিত কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের আদান-প্রদান জোরদার করা, ঐতিহ্যগত মৈত্রীর ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করা, রাজনৈতিক সম্পর্ক সুসংবদ্ধ করা, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আরও উচ্চ ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নির্ধারণ করা, সম্পর্কের বিদ্যমান সুষম কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করা।
পরস্পরের উন্নয়নকৌশল সমন্বয় করে পারস্পরিক কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব। চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতার সুপ্তশক্তি বিশাল।চীনের ত্রয়োদশ পাঁচশালা পরিকল্পনা এবং বাংলাদেশের সপ্তম পাঁচশালা পরিকল্পনার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহ চীনের আগ্রহ আছে। এতে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক আদান-প্রদান সম্প্রসারিত হবে এবং অবকাঠামো, উত্পাদন, জ্বালানি, বিদ্যুত, পরিবহন, তথ্য, টেলিযোগাযোগ, কৃষিসহ নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর’-এর কাঠামোতে দু’পক্ষের বাস্তব সহযোগিতা জোরদার করলে, দু’দেশের জনসাধারণ সত্যিকার অর্থেই উপকৃত হতে পারে।
দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা জোরদার করে অভিন্ন উন্নয়নের সুফল অর্জনের মাধ্যমে চীন অব্যাহতভাবে যথাসাধ্য বাংলাদেশকে আরো বেশি সমর্থন ও সাহায্য দিয়ে যেতে ইচ্ছুক। দুর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রশমন, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, চিকিত্সা ও স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, নারী ও শিশুসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করা ও যৌথভাবে জাতিসংঘের ‘এজেন্ডা ২০৩০’ বাস্তবায়নে কাজ করা যা চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতা দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার নতুন দৃষ্টান্ত গড়ে তুলবে।
চীন-বাংলাদেশ মৈত্রীর সেতু শক্তিশালি; পরস্পরকে বোঝা ও ভালোবাসার সুফল অর্জন হয়েছে। চীন ও বাংলাদেশের জনগণ একসাথে ইয়া লু জান বু চিয়াং নদী তথা যমুনা নদীর পানি খায়। দু’দেশের বন্ধুত্ব সুদীর্ঘকালের। চীন চীনা সংস্কৃতি ও বাংলা সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটাতে, পরস্পরের কাছ থেকে শিখতে, এবং দু’দেশের জনগণের মধ্যে মানসিক-সেতু স্থাপন হয়ে আছে।এখন উচিত শিক্ষা, তথ্যমাধ্যম, পর্যটন, যুব, স্থানীয় সরকারসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিময় ও সহযোগিতা সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা চালানো।