অনলাইন ডেস্: করোনাভাইরাসের ভয়াল ছোবলে আমেরিকার শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থা বর্তমানে চরম বিপর্যস্ত। ইতিমধ্যে হাজার হাজার আমেরিকান নাগরিক কর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। আমেরিকাবাসীর বেকারত্ব দূর করার লক্ষ্যে গত ২২ জুন সাময়িকভাবে এইচ-ওয়ান বি (H-1B) ভিসাসহ কর্মক্ষেত্রের প্রায় সব ভিসা বাতিল করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বাতিল হয়েছে H-1B, H-4, H-2B ভিসা। একই সঙ্গে বাতিল হচ্ছে L ও J ভিসাও। চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কেউ আর এসব ক্যাটাগরিতে ভিসা ও গ্রিন কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন, তাতে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমেরিকা কোনো বিদেশিকে H-1B, H-2B এবং L ভিসা দেবে না। নতুন নিয়ম কার্যকর হচ্ছে ২৪ জুন থেকেই।
গত সপ্তাহ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কারণে আমেরিকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় ৪৬ মিলিয়ন মার্কিনি। এ অবস্থায় আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ভিসায় রাশ টানার সিদ্ধান্তে ট্রাম্প কিছুটা এগিয়ে থাকবেন বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, বর্তমানে আমেরিকার কাজের বাজারে ভয়াবহ সংকট চলছে। এ অবস্থায় আমেরিকানদের স্বার্থের কথা আমাদের ভাবতেই হবে। দেশে বিদেশি কর্মীদের আসার কারণে আমেরিকার কাজের বাজারে বিরাট প্রভাব পড়ছে।
ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটিকে দেওয়া নির্দেশে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যারা আমেরিকায় কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অথবা যাদের ইতিমধ্যে ডিপোর্ট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাদের ওয়ার্ক পারমিট অবিলম্বে বাতিল করা হোক। তাদের চ‚ড়ান্ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমেরিকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। এর ফলে মার্কিনিদের জন্য প্রায় ৫০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০২০ সালের বাকি সময়ের মধ্যেই আমেরিকায় ৫ লাখ ২৫ হাজার কর্ম খালি হবে।
সাময়িক ভিসা বন্ধের এই সিদ্ধান্তের মধ্যে আছে গেস্ট-ওয়ার্কার প্রোগ্রাম। রয়েছে এইচ-১ বি কর্মসূচি, যার আওতায় কিছু বিশেষায়িত খাত, যেমন প্রযুক্তি খাতে দক্ষ কর্মী সাময়িক কাজের জন্য বিদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আনার অনুমতি দেওয়া হতো। এছাড়া আছে এইচ-২ বি কর্মসূচি, যাতে অকৃষি খাতে মৌসুমি কর্মী আনা হতো। রয়েছে সংস্কৃতি বিনিময়ের ভিসা জে-১ এবং শর্ট টার্ম ওয়ার্কার বা ক্ষুদ্র সময়ের জন্য কর্মী আনার ভিসা, এইচ-১ বি এবং এইচ-২ বি ভিসাধারীদের স্ত্রীদের জন্য ভিসা এবং যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বিদেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কর্মী আনার ভিসা। তবে শিক্ষা খাতের ভিসা, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অধ্যাপক, গবেষক, স্কলার, যারা সাধারণত জে-১ ভিসায় আসেন, তারা এর বাইরে থাকবেন। এইচ-২ বি এর আওতায় খাদ্য প্রস্তুতকারী কর্মীরাও এর বাইরে থাকবেন।
শ্রম বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ২০ মিলিয়ন মানুষ বেকার ভাতা নিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ডাইভার্সিটি গ্রিন কার্ড লটারি বন্ধসহ গত এপ্রিলে সাময়িকভাবে আরো কিছু ভিসা বন্ধের কথা বলা হয়েছিল। হোয়াইট হাউস বলছে, এই ভিসা বন্ধের পরিকল্পনা কার্যকর হলে বছর শেষে ৫ লাখ ২৫ হাজার চাকরির সংস্থান হবে। আর non-partisan Migration Policy Institute-এর মতে, এই সিদ্ধান্তের কারণে ৩ লাখ ২৫ হাজার লোক, যাদের অভিবাসী বা সাময়িক কর্মী হয়ে আসার কথা ছিল, সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন সে দেশের শিল্পপতিরা। ভিসা স্থগিতের খবরে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক ও অ্যামাজনের মতো সিলিকন ভ্যালির নামী কোম্পানিগুলোও। আমেরিকার সংকটময় অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে এই সিদ্ধান্ত মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তের কারণে সবচেয়ে ক্ষতি হবে প্রযুক্তি খাতের। বিশ্বের প্রযুক্তি রাজধানী খ্যাত সিলিকন ভ্যালির বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা এই পরিকল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, যেখানে আরো লোক আনা দরকার, সেখানে ভিসা বন্ধ করায় বিপুল নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সিলিকন ভ্যালির একটি ডেটা প্রাইভেসি ফার্মের প্রধান নির্বাহী অংশু শর্মা এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘এইচ-১ বি ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ মানে হচ্ছে আমার মতো যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিইও, তাদেরকে কানাডার মতো যেসব দেশ অভিবাসন দিতে চায়, সেখানে গিয়ে অফিস খোলা এবং সেখানে লোকজন নিয়োগ করা।’
গুগলের প্রধান সুন্দার পিচাই টুইট করে বলেন, ‘আমেরিকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে অভিবাসনের বড় একটি ভ‚মিকা রয়েছে। এরই মাধ্যমে প্রযুক্তি খাতে বিশ্বের নেতৃত্ব আমেরিকার কাছে। গুগল কোম্পানিও তারই অবদান। তবে প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণায় আমরা আশাহত হয়েছি।’
আমেরিকাকে বলা হয় ইমিগ্র্যান্টদের দেশ। প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে আমেরিকায় ইমিগ্র্যান্ট আনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাত অনেকাংশেই নির্ভরশীল বিদেশি কর্মীদের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সাফল্যের পেছনেও তাদের অবদান। বছরে ৮৫ হাজার বিদেশি কর্মী যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এই ভিসায়। সিলিকন ভ্যালির বেশির ভাগ কর্মীর মধ্যে বিশাল একটি অংশ আসেন ভারত ও চীন থেকে। বলা যায়, সিলিকন ভ্যালির কম্পিউটার, অঙ্ক ও প্রকৌশল খাতের ৬০ শতাংশই বিদেশ থেকে আসা কর্মী।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিদেশি কর্মীদের আসা বন্ধ হওয়া মানেই হচ্ছে প্রযুক্তি বাণিজ্যের বিরাট ক্ষতি। তবে তারা আশা করছেন, এই আদেশ যেহেতু সাময়িক সময়ের জন্য করা হয়েছে, তাই মহামারি চলে যাওয়ার পর সবকিছু আবারো আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।