১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর চীন কেবলমাত্র রাজনৈতিক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল পুরো জাতিকে একটি কমিউনিস্ট অথবা সমাজতান্ত্রিক বলয়ের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করা। এর আগে চীনা সমাজ আফিমে আসক্ত ছিল এবং নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। শক্তিশালী সরকারের অভাব ছিল। দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের শাসন করত। সভাপতি মাও সে তুং নৈতিকভাবে জাতিকে পরিবর্তন করেন এবং চীনাদেরকে একটি জাতিতে পরিণত করেন। এটি ছিল আধুনিক চীনা ইতিহাসের প্রথম ধাপ (১৯৪৯-১৯৭৮), কেবলমাত্র রাজনৈতিক সংস্কারের যুগ। সেই সময়ে চীন দুর্ভিক্ষ এবং অন্যান্য বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিল। অর্থনীতি পতনের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল এবং দেশটি বিচ্ছিন্নতায় ভুগছিল। এই সময়ে বাকি বিশ্বের কাছে চীন রক্ষণশীল বলে পরিচিত ছিল। চীনের বাইরে থেকে কেউ দেশটির ভেতরে কী হচ্ছে তা জানতে পারত না।
কিন্তু ১৯৭৮ সালে চীন সংস্কারের নীতি গ্রহণ করে এবং বাকি বিশ্বের কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করে। তখন থেকেই অসাধারণ অগ্রগতি শুরু হয় দেশটির। একটি খাদ্যাভাবের দেশ থেকে খাদ্য রপ্তানির দেশে পরিণত হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পর চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। দেশটি এখন বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রায় ৮০ কোটি জনগণ দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হয়েছে। মাত্র চার দশকে চীন প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেছে। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত। এই ৪০ বছরে পশ্চিমারা চীনকে উন্নত হতে সমর্থন জুগিয়েছে এবং সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য করেছে। চীন এখনো উন্নয়নের জন্য উপযোগী একটি আন্তর্জাতিক পরিবেশ উপভোগ করছে। সামনের দিনগুলোতে উন্নয়নের এই গতি ধরে রাখতে হলে চীনকে একটি কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। পশ্চিমারা কঠোর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে এবং চীনকে খর্বশক্তিতে পরিণত করার চেষ্টা করবে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে বলেছেন, ‘চীনের জাতীয় এবং
আন্তর্জাতিক শর্তাবলিকে অক্ষুণ রাখতে আমরা উন্মুক্তকরণের জাতীয় নীতিকে অব্যাহত রাখতে দায়বদ্ধ। আমরা বিস্তৃত, বহুপাক্ষিক ও সুদরপ্রসারী উন্মুক্তকরণের একটি নতুন ধাপে পৌঁছেছি যাতে একটি শাণিতপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং চীনের অগ্রযাত্রা আরো সমুন্নত হবে।’ চীন তার সংস্কার এবং খোলা নীতি অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর। একজন কূটনীতিক হিসেবে ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চীনে থাকার সময় আমি খাদ্যের এবং ভোগ্য পণ্যের প্রাচুর্য দেখেছি। শুধু নিজেদের উৎপাদিত পণ্য নয়, বাজারে সারা পৃথিবী থেকে আমদানীকৃত পণ্যেরও প্রাচুর্য দেখেছি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সন্তোষজনক অবস্থানের প্রতিফলন আমি নাগরিকদের হাসিমাখা মুখে দেখতে পেয়েছি। নাগরিকরা হরহামেশা তাদের ছুটি এবং উৎসবে চীনের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করতে পারছে। যেসব রাস্তা একসময় বাইসাইকেলে পূর্ণ ছিল, সেগুলোতে এখন অসংখ্য গাড়ির জন্য ট্রাফিক জ্যাম লেগে থাকে। চীন শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। এর অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত বিশ বছরে ‘বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে’র মর্যাদাপূর্ণ ক্লাবে স্থান পেয়েছে। এই সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। শিক্ষার মান সারা বিশ্বের বিদেশি ছাত্রদের আকর্ষণ করছে। চীনে এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন চলছে এবং বৃহৎ অবকাঠামো গড়ে উঠছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগে চীনের যে অর্জন, তা পৃথিবীর অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। ৫জি চালু করে চীন প্রত্যাশা করছে এই খাতে সারা বিশ্বকে পেছনে ফেলবে। স্বাস্থ্য খাতে চীনের উন্নতি বিস্ময়কর।
কৃষিতে প্রভূত সংস্কার সাধন হয়েছে। সামরিক খাতের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। আইন ও বিচারিক ব্যবস্থা উন্নত হয়ে একটি মানসম্মত পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানবাধিকার উন্নত হয়েছে। বিনোদনজগৎ সমৃদ্ধ হচ্ছে। চীন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সামাজিক-নিরাপত্তা সৃষ্টি করেছে। ৯০ কোটি লোকের জন্য বয়স্কভাতা চালু হয়েছে এবং ১৩০ কোটি লোক স্বাস্থ্যবীমার আওতায় এসেছে।
সর্বোপরি, চীনে দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় আছে, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত আছে; যেখানে বাকি বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা এবং অস্থিতিশীলতার মধ্যে দিনানুপাত করছে। চীনা জনগণের কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা, সংস্কারের সুফল এবং খোলা নীতি দেশটিকে ভূ-রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে। চীন এখন বিশ্বরাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করছে। একটা সময় ছিল যখন অন্যান্য দেশের বাধা ছাড়াই কিছু দেশ যেকোনো দেশকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিতে পারত-যেমনটা ইরাক ও লিবিয়ায় ঘটেছিল। কিন্তু এখন বিশ্ব বহুকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।
বাকি বিশ্ব, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে চীন এখন উন্নয়নের একটি সফল উদাহরণ। সৌভাগ্যবশত চীন তার এই অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে বিনিময় করতে চায় এবং অন্যদেরকে সহায়তা করতে কৃপা করে না। চীন অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও তার এই আধুনিকতার ছোঁয়া পৌছে দিতে চায়। চীনা জাতি মানবসভ্যতায় বড় ধরনের অবদান রেখে চলেছে। চীন সারা বিশ্বের সংযুক্তি, শান্তি, সঙ্গতি এবং উন্নতির জন্য বেল্ট এবং রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) চালু করেছে। ভূরাজনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ঘটেছে এবং তা অনেক জাতির কাছে আশাপ্রদ হয়েছে। পরিবেশ কিংবা বৈশ্বিক অর্থনীতি কিংবা বৈশ্বিক শান্তি বা রাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই চীনের ভূমিকা ইতিবাচক। চীনের এই অর্জন এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে সারা বিশ্ব অবহিত। অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশই চীনের এই উন্নয়নের মডেলকে অনুসরণ করতে চাইছে।
এশিয়া টাইমস থেকে ভাষান্তর