ছিয়াং বাঁশির সুর।যে শুনে নাই সম্ভবত অনেক কিছু বাকি রয়ে গেলো তার জীবনে। ছিয়াং জাতির ঐতিহ্য এটি। এই বাঁশির তৈরির কৌশল খুব ভিন্ন আর কষ্টসাধ্য। বাঁশির সাথে আন্তরিকতা আর শ্রম দুটোর মিশেল লাগে।
সাধারণ পেনসিলের মতো লম্বা ছিয়াং বাঁশি সবচেয়ে ভালো সুর বের করতে চাইলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০ মিটার উঁচু পাহাড়ে উঠে তীর বাঁশ কেটে আনতে হয়। তারপর বাঁশকে কয়েক মাস তেলে ডুবিয়ে রাখার পর হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ঘষতে হয়। এক কথায় ছিয়াং বাঁশি তৈরির পদ্ধতি খুব জটিল।
ছিয়াং বাঁশির উত্তরসূরী হিসেবে হো ওয়াং ছুয়ান দীর্ঘকাল ধরে ছিয়াং জাতির সংস্কৃতির প্রসার ও সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। তিনি নিজেই ছিয়াং বাঁশি তৈরি করেন। হো ওয়াং ছুয়ান ছিয়াং বাঁশি তৈরির পাশাপাশি ছিয়াং বাঁশির সুর সংগ্রহের কাজ করেন। তিনি স্থানীয় মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে ছিয়াং বাঁশি শেখানোর কোর্স খুলেছেন। এখন দশ বারো জন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রী তার সঙ্গে ছিয়াং বাঁশি বাজানো শিখছে। এভাবে তিনি ছিয়াং জাতির সংগীত ও সংস্কৃতি আগামী প্রজন্মের কাছে রেখে যাবার জন্যে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
ছিয়াং জাতি যাদের কেবলই ভাষা আছে, কিন্তু অক্ষর নেই। জাতিগত সংস্কৃতি প্রধানতঃ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় চলে আসছে।এটি চীনের সবচেয়ে প্রাচীন জাতিগুলোর অন্যতম। এ জাতির ইতিহাস তিন হাজার বছরেরও বেশি। প্রাচীনকালে ছিয়াং জাতির মানুষ প্রধানতঃ উত্তর-পশ্চিম চীনের সীমান্ত অঞ্চলে থাকতেন। পরে তারা ধাপে ধাপে সিছুয়ান প্রদেশে সরে যান। তারা পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় নির্মিত পাথরের ঘরে থাকতে পছন্দ করতেন। ফলে তাদেরকে ‘মেঘের ওপরের জাতি’ বলে ডাকা হয়। ছিয়াং জাতির পাথর ঘরকে বলা হয় ‘দিয়াও লো’ । এ ঘর ছিয়াং জাতির ঐতিহ্য অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়। চীন তথা বিশ্বের স্থাপত্য ইতিহাসে ছিয়াং জাতির পাথর ঘরের বিশেষ স্থান রয়েছে। তা ছাড়া তাদের পোশাক, নাচ গান ও বাদ্যযন্ত্রের জাতিগত বৈশিষ্ট্যও আছে।
এখন ছিয়াং জাতির জনসংখ্যা ৩ লাখেরও বেশি। ছিয়াং জাতির ৮০ শতাংশ মানুষ সিছুয়ান প্রদেশের আবা তিব্বতী জাতি ও ছিয়াং জাতি স্বায়ত্তশাসিত বিভাগের মাও জেলা, ওয়েনছুয়ান, লি জেলা, হেইসুই এবং মিয়ানইয়াং শহরের পেইছুয়ান ছিয়াং জাতি স্বায়ত্তশাসিত জেলায় থাকেন। রিক্টার স্কেলে ৮ মাত্রার এক ভূমিকম্প ছিয়াং জাতি অধ্যুষিত অধিকাংশ নগর ও গ্রাম মাটির সাথে মিশে যায়। ছিয়াং জাতির বাঁশির অন্যতম উত্তরসূরী হো ওয়াং ছুয়ান এই ভূমিকম্পের তান্ডবের মধ্যে বেঁচে যাওয়া শিল্পীদের একজন । কিন্তু তাঁর অনেক বন্ধু-বান্ধব ও মূল্যবান সংগীত তথ্য আর উদ্ধার করা যায় নি। তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু স্থাপত্য, যেমন তিয়াও লো অর্থাৎ ছিয়াং জাতির পাথর ঘরও বিধ্বস্ত হয়েছে। মাও জেলার জাদুঘরের অনেক পুরাকীর্তি বিনষ্ট হয়েছে। বাড়িঘর ভেঙে পড়ার পর অনেক সংগীত ও নৃত্য দলিল ধ্বংসাবশেষে চাপা পড়ে গেছে। পেইছুয়ান সংস্কৃতি কেন্দ্রও বিধ্বস্ত হয়েছে। কর্মীরা সবই মারা গেছে।
ভূমিকম্পের পর পেইছুয়ান ও মাও জেলার দুটি ছিয়াং জাতির জাদুঘরও ধ্বংস হয়েছে। কেবল পেইছুয়ান জেলায় ৪০০টিরও বেশি মূল্যবান পুরাকীর্তি ও জরিপের বিপুল তথ্য ধ্বংসাবশেষে চাপা পড়েছে । ওয়েনছুয়ান জেলার বৃহত্তম ও সবচেয়ে প্রাচীন ছিয়াং জাতির রোব গ্রামের সকল বাড়িঘর ভেঙে গেছে। দুর্গত অঞ্চলের শতাধিক ছিয়াং জাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন তিয়াও লো, আবাস ভবন ও সেতু ধ্বংস হয়ে গেছে। ভূমিকম্পে ছিয়াং জাতির ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে পারদর্শী কত জন উত্তরসূরী নিহত হয়েছে তার হিসেব এখনো পাওয়া যায় নি।
চীন সরকার, উত্তরাধিকার বিশেষজ্ঞ ও সংখ্যালঘু জাতির কর্মীরা ছিয়াং জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার উদ্ধার করার জন্য নিরলস চেষ্টা চালাচ্ছে। ভালোভাবে ছিয়াং জাতির প্রাচীন সংস্কৃতি ও সভ্যতা রক্ষা করা জন্যে সরকার খুব আন্তরিক। চীনের বিষয়গত সাংস্কৃতিক ছিয়াং জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ক্ষতি কমানোর জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ চালিয়ে তারা।
চীনের বিষয়গত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক চাং ছিং শানের মতে, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সংখ্যালঘু জাতির আদি অবস্থাকে সম্মান প্রদর্শন এবং যথা সম্ভব তাদের আগের পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অপরিমেয়। মনোরম গ্রামে ছিয়াং জাতি ও তিব্বতী জাতির মানুষ বংশপরম্পরায় বসবাস করে। তাদের প্রথা আর এই প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়ে আছে। আমাদেরকে পুনর্গঠনের সময় স্থানীয় প্রথা এবং জনসাধারণের ইচ্ছাকে সম্মান দিয়ে আগের রূপ পুনরুদ্ধার করতে হবে। তারা ছিয়াং জাতি, তিব্বতী জাতি ও ই জাতির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই, এমন একটি নতুন গ্রাম চায় না।’
৫৯ বছর বয়স্ক ইয়ু কুয়াং ইউয়ান হচ্ছেন ছিয়াং জাতির শালাং নৃত্যের উত্তরসূরী। তার বাড়ি সংস্কৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের কেন্দ্রস্থল মাও জেলায়। তিনি চীনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত ছিয়াং জাতির সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অঞ্চলের পরিকল্পনা সংক্রান্ত আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এখন মাও জেলায় ছিয়াং জাতির জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৮০ শতাংশ ছিয়াং জাতির মানুষ ছিয়াং ভাষায় কথা বলে। তাদের থাকার পরিবেশেও ঐতিহ্যিক স্থাপত্য স্টাইল বজায় রয়েছে। মাও জেলায় লোক প্রথা, নৃত্য, সংগীত, পোশাক ও খাদ্য অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে সংরক্ষিত আছে। এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আশেপাশের লি জেলা, সোং পান, হেই সুই ও ওয়েনছুয়ান প্রভৃতি অঞ্চলে সংরক্ষণ কাজ চালালে ভালো ফল পাওয়া যাবে।’
ইয়ু কুয়াং ইউয়ান বলেন, ছিয়াং জাতির সংস্কৃতি ভালো জানেন এমন অনেক বৃদ্ধবৃদ্ধা মারা গেছেন। কিন্তু বাচ্চারা জীবিত আছে। ছিয়াং জাতি হাজার হাজার বৃষ্টি ও বাতাস অতিক্রম করেছে। ছিয়াং জাতির মর্ম চিরকাল থাকবে। তারা সাহস করে সামনে এগিয়ে যাবে। আকর্ষণীয় ছিয়াং বাঁশির সুর অদূর ভবিষ্যতে আবার ছিয়াং জাতির গ্রামে ভেসে উঠবে।
সূত্র: কুয়াং ইউয়ে আনন্দী