এএন্টারপ্রেনার ডেস্ক: বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে অভিযোগ উঠছে ইউরোপের কিছু নেতা এই স্বাস্থ্য সংকটকে ভিন্নমত দমন এবং নিজেদের ক্ষমতাকে সংহত করার জন্য কাজে লাগাচ্ছেন। তুরস্ক এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকম পোস্ট দেবার কারণে শত শত লোককে গ্রেফতার করেছে।
রাশিয়ায় লোকজনকে হুমকি দেয়া হচ্ছে ভুয়া খবর বা ফেইক নিউজ বলে বিবেচিত হতে পারে এমন যে কোন কিছুর জন্য শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ড দেয়া হতে পারে।
পোল্যান্ডকে নিয়ে ইতোমধ্যেই ভয় তৈরি হয়েছে যে সেখানে গণতন্ত্র বানচাল হবার পথে, আর হাঙ্গেরিতে গণতন্ত্র এখন কার্যত নেই হয়ে গেছে।
বিবিসির অরলা গেরিন লিখছেন, তুরস্কের মানবাধিকার আন্দোলনকারীরা মনে করেন মি. এরদোয়ানের হাতে এখনই এত ক্ষমতা রয়েছে যে তার আরো ক্ষমতার জন্য করোনাভাইরাস সংকট ব্যবহারের দরকার নেই।
করোনাভাইরাস লকডাউন অমান্যের জন্য জরিমানা করা হচ্ছে
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তুরস্ক বিষয়ক পরিচালক এমা সিনক্লেয়ার-ওয়েব বলছেন, এদেশের ব্যবস্থা এখন এতটাই এক-কেন্দ্রিক যে আরো ক্ষমতা দখলের কোন প্রয়োজন নেই।
তবে তিনি বলছেন, এর মধ্যে একটা চেষ্টা হয়েছিল, সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরো বাড়ানোর প্রস্তাব ছেড়ে দিয়ে লোকে এটা কিভাবে নেয়- তা পরীক্ষা করে দেখার।
এ প্রস্তাব লুকোনো ছিল করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া মোকাবিলার জন্য কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপের বিলের মধ্যে।
এমা সিনক্লেয়ার-ওয়েব বলছেন, এর লক্ষ্য ছিল – সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো যেন সরকারের নিয়ন্ত্রণ আর সেন্সরশিপ মানতে বাধ্য হয় এমন ব্যবস্থা করা।
প্রস্তাবটি অবশ্য হঠাৎ করেই বাদ দেয়া হয়েছে তবে এমা সিনক্লেয়ার-ওয়েব মনে করেন ভবিষ্যতে এটা আবার ফেরত আসতে পারে।
তুরস্কে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব সংক্রান্ত তথ্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কোভিড ১৯ নিয়ে উস্কানিমূলক’ পোস্টের জন্য শত শত লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডাক্তাররা এ নিয়ে কথা বলতে সাহস পান না।
তুরস্কের মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের আলি সেরকেজোগলু বলে – ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকমীরা গত ২০ বছরে এ পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
আইনজীবী হুরেম সোনমেজ বলছেন, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জন্য এই করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব এক সুযোগ নিয়ে এসেছে – কারণ মহামরির পরিস্থিতি সমাজ এবং বিরোধীদল দুর্বল হয়ে পড়েছে।
রাশিয়ায় পুতিনের উচ্চাভিলাষের পথে কাঁটা হয়ে এসেছে মহামারি
বিবিসির মস্কো সংবাদদাতা স্টিভ রোজেনবার্গ বলছেন, এ বছর জানুয়ারি মাসেই মনে হচ্ছিল যে ক্রেমলিন যেন সবকিছু নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে।
কথা ছিল, রাশিয়ার সংবিধানে পরিবর্তন হবে, ভ্লাদিমির পুতিন আরো দু মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। তার পর ২২শে এপ্রিল জাতীয় ভোট হবে যাতে রুশ জনগণ এ পরিবর্তন অনুমোদন করবে।
মি. পুতিনের সমালোচকরা যতই বলুন যে এটা এক সাংবিধানিক অভ্যুত্থান, কিন্তু এটাই যে হবে তা ছিল যেন অবধারিত।
কিন্তু কোভিড ১৯ এসে সবকিছু আটকে দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন ভোট পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এখন ক্রেমলিনের সমস্যা হলো শেষ পর্যন্ত ভোট যখন হবে – তখন কি নতুন সংবিধান অনুমোদনের ব্যাপারে রুশরা অত আগ্রহী থাকবেন?
তা ছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক সমস্যা, মন্দা, লক্ষ লক্ষ চাকরি ছাঁটাই – এগুলো তো আছেই।
সাধারণত রুশরা এসব সমস্যার জন্য আমলা ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের দায়ী করে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দোষারোপ করে না।
কিন্তু ইতিহাস বলে – নিজের অর্থকষ্ট চরমে উঠলে তাদের রাগ গিয়ে পড়ে দেশের নেতার ওপর। যা এখন মনে হচ্ছে অনিবার্য।
হয়তো এ জন্যই ক্রেমলিনের নেতা সম্প্রতি আঞ্চলিক গভর্নরদের ওপর করোনাভাইরাস মোকাবিলার দায়িত্ব দিয়েছেন। মি. পুতিনের সমর্থকরা এখন বলবেন এরকম জাতীয় সংকটের সময়ই রাশিয়ার দরকার একজন শক্তিধর স্থিতিশীল নেতা।
ক্রেমলিনের সমালোচকরা ইতোমধ্যেই নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করার জন্য করোনাভাইরাস সংকটকে ব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন।
পার্লামেন্টে এর মধ্যে দ্রুত একটি আইন পাস হয়েছে, যাতে ভাইরাস নিয়ে ‘মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর জন্য’ কঠোর শাস্তির বিধান আছে – পাঁচ বছর কারাদন্ড অথবা ২৫ হাজার ডলার জেল।
কোয়ারেন্টিন বলবৎ করার জন্য যে নজরদারির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা নিয়েও উদ্বেগ আছে। আর লকডাউন মানে হলো, জনসমাগম বন্ধ, বিরোধীদলের কোন প্রতিবাদ সমাবেশ করাও বন্ধ।
হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট থেকে বিবিসির নিক থর্প বলছেন, হাংগেরির ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে অভিযোগ উঠেছে যে তিনি – দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে – নিজের হাতে আরো ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য করোনাভাইরাস সংকটকে ব্যবহার করছেন।
গত ১১ই মার্চ তার তার ফিডেজ সরকার দেশে বিপদজনক পরিস্থিতি ঘোষণা করে – যাতে মহামারি মোকাবিলার পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়। কিন্তু তার পরই মি. অরবান তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে অনির্দিষ্টকালের জন্য এর মেয়াদ বাড়িয়ে দেন।
ফলে সরকারের হাতে এখন ক্ষমতা আছে যতদিন খুশি ডিক্রির মাধ্যমে দেশ শাসন করার, এবং কখন বিপদ কেটে যাবে তা-ও ঠিক করবে তারাই।
এতে হাঙ্গেরির গণতন্ত্র শেষ হয়ে গেছে বলে সমালোচকরা অভিযোগ করছেন
কিন্তু দেশটির বিচারমন্ত্রী বলেছেন, এর দরকার ছিল এবং জরুরি অবস্থা শেষ হলেই অথরাইজেশন এ্যাক্ট নামে আইনটি উঠে যাবে।
তবে দেশটির সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সোলতান সিয়েন্তে বলছেন, যেহেতু এখন সরকারই ঠিক করবে যে কখন দেশে বিপজ্জনক পরিস্থিতির অবসান হয়েছে – তাই পার্লামেন্ট তার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের হাতে ছেড়ে দিয়ে কার্যত আসলে “আত্মহত্যা করেছে।“
অবশ্য পার্লামেন্ট এখনো আছে, সাংবিধানিক আদালতও আছে, তা ছাড়া ২০২২ সালে নির্বাচন হবার কথা।
তবে মি. অরবানের ফিডেজ পার্টির বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে পার্লামেন্টে। সাংবিধানিক আদালতেও তার পছন্দের লোকরা বসে আছেন।
তবে যদি ২০২০-এর শেষ নাগাদ দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বহাল রাখতে পারেন মি. অরবান তাহলে তিনি সুপ্রিম কোর্টের একজন নতুন প্রধান নিয়োগ করতে পারবেন।
পোল্যান্ডে কেন ক্ষমতায় থাকতে মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছে সরকার?
বিবিসির ওয়ারশ’ সংবাদদাতা এ্যাডাম ইস্টন জানাচ্ছেন, মে মাসে দেশটিতে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবার কথা – তার আগে সমালোচনা হচ্ছে যে কেন সরকার মহামরির মধ্যে এ নির্বাচন করছে?
ব্যাপার হলো, প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেই দুদা হচ্ছেন সরকারের মিত্র এবং এখন ভোট হলে জনমত জরিপ অনুযায়ী তিনিই নিশ্চিতভাবে জিতবেন।
ক্ষমতাসীন দল বলছে, এ নির্বাচন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, আর ডাকযোগ ভোট হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ।
যদিও বিরোধীদল এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও এ ভোট কতটা নিরাপদ হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিরোদীদল বলছে, জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে নির্বাচন পেছানো হোক, কিন্তু সরকার তাতে রাজি নয়।
সরকার আরো বলছে, তিনি যদি পুনঃনির্বাচন করতে না পারেন তাহলে তারা মি. দুদাকে আরো দু বছর ক্ষমতায় রাখতে সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার এক প্রস্তাব সমর্থন করবে।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, মে মাসে নির্বাচন হলে তা অবাধ -সুষ্ঠ হবে না। কারণ প্রার্থীরা প্রচার চালাতে পারছে না, আর ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সরকারি মিডিয়ার সুবিধা নিয়ে জনসংযোগ করছেন।
পোল্যান্ডের সরকার চায়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এখনি হযে যাক, কারণ করোনাভাইরাসের কারণে মন্দা দেখা দিলে মি. দুদার জেতার সম্ভাবনা কমে যেতে পারে। তখন সরকারের জন্য আগামী তিন বছর তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করানো অসুবিধাজনক হবে।
মানবাধিকার কর্মী মালগোরিয়াতা জুলেকা বলছেন, কীভাবে একটি সংকটকে ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হাসিল করে নেয়া যায় – এটা হচ্ছে তার “টেক্সটবুক” উদাহরণ। বিবিসি।